গত ৩ নবেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল-২ কর্তৃক দেয়া মৃত্যুদন্ডাদেশ বহাল রেখেছেন। গত বছর ৯ মে এই মামলায় তার ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। ৩ নবেম্বর আপিল বিভাগ এক রায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ঐ ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন। এই রায় হওয়ার পর থেকে কীভাবে এবং কখন তা কার্যকর হবে- তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা উঠেছে। আসামীপক্ষ বলছে, তারা এই আদেশের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন দাখিল করবে এবং তারা আপিল আদালতে নোটিশও দিয়েছে। এই অবস্থায় এটর্নি জেনারেল ও আইনমন্ত্রীর বক্তব্যে তুমুল ঝড় বইছে। এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, এই আইনে রিভিউ করার সুযোগ নেই। অথচ জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার মামলায় আপিল বিভাগের ১১ ডিসেম্বর রায়ের পর ঐ রাতেই আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত তা স্টে দেন এবং পরের দিন সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে শুনানি শেষে রিভিউ পিটিশন খারিজ করে দেন। অর্থাৎ রিভিউ পিটিশন মেইটেইনেবল, কিন্তু অন গ্রাউন্ড পর্যাপ্ত যুক্তি না থাকায় রিভিউ আবেদনটি খারিজ করে দেন আপিল আদালত। সুতরাং এখন কামারুজ্জামানের ব্যাপারেও একইভাবে রিভিউ হবে, তারপর আদালত যে সিদ্ধান্ত দেন সেই অনুসারে ফয়সালা হবে। তাছাড়া রিভিউ করতে পারা একজন ব্যক্তির বাংলাদেশের সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে সাংবিধানিক অধিকার। এই অধিকার অন্য কোনো আইন দ্বারা রহিত করা যাবে না। এই বিষয়ে সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোনো আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহলে সে আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল বলে গণ্য হবে।’ সুতরাং এই বিধান অনুসারে রিভিউ না করতে পারা সংক্রান্ত ট্রাইব্যুনালের বিধান বাতিল বা অকার্যকর বলে গণ্য হবে এবং কামারুজ্জামানের রিভিউ করার সুযোগ বহাল থাকবে। তাছাড়া বলা হচ্ছে, সংবিধানের ৪৭ (ক) অনুচ্ছেদে যে অপ্রযোজ্যতা দিয়েছে, তা ১০৫ অনুচ্ছেদের জন্য প্রযোজ্য হবে না, সেখানে কেবলমাত্র ৩১, ৩৫ (১), ৩৫ (৩) এবং ৪৪নং অনুচ্ছেদে প্রযোজ্য। এই বিষয়ে মিডিয়ায় ব্যাপক বিতর্কের পর এটর্নি জেনারেল অবশ্য বলেছেন, এটা তার ব্যক্তিগত মত। প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি এটর্নি জেনারেলের চেয়ারে বসে এভাবে মতামত দেয়ার পর যদি কোনো ব্যক্তির ফাঁসি বিধিবহির্ভূতভাবে কার্যকর করা হয়, তখন তার দায়-দায়িত্ব কে নেবে? অন্যদিকে বাংলাদেশের আইনজীবীদের মধ্যে ক্লিন ইমেজের লোক আমাদের আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হক কাদের মোল্লার রায় প্রকাশ হওয়ার পর তা রিভিউ করা যাবে কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি এবং প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ সরকারিপক্ষের লোক হয়েও বলেছিলেন, কাদের মোল্লা সাহেব রিভিউ করার সুযোগ পাবেন। সেই আইনমন্ত্রীই এখন ফাঁসির আদেশ কার্যকর করতে কারা কর্তৃপক্ষকে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে আদেশ দিয়েছেন। সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদের বিধান ও ট্রাইব্যুনাল আইনের রিভিউ করতে না পারা সংক্রান্ত বিধান যখন সাংঘর্ষিক অবস্থানে আসবে, তখন সংবিধানের ৭ (২) অনুচ্ছেদ অনুসারে কোনো আইন কার্যকর করা হবে- তা আইনমন্ত্রীর অজানা নয়। তাছাড়া কামারুজ্জামান সাহেব এখনও আদালতের রায় হাতে পাননি। রায়ের কপি পাওয়ার পর আসামী রিভিউ করবেন, না প্রাণ ভিক্ষা চাবেন- তা তার নিজস্ব ব্যাপার।
গত ৮ নবেম্বর শনিবার আইনমন্ত্রী সম্পত্তি নিবন্ধন সারগ্রন্থ প্রকাশনা অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার ক্ষেত্রে রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশ প্রযোজ্য।’ বিলম্ব হলেও তিনি বলেছেন, ‘লিখিত সংক্ষিপ্ত রায় আইনানুগ প্রক্রিয়ায় কারা কর্তৃপক্ষের কাছে না পৌঁছানো পর্যন্ত ফাঁসির রায় কার্যকর করা যাবে না।’ গত ৮ নবেম্বর শনিবার সুপ্রিম কোর্টে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের অপর প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেছেন, ‘কারা বিধির ৯৯১ ধারা অনুসারে আসামীকে রায় অবহিত করার কথা বলা হয়েছে, তার মানে আনুষ্ঠানিকভাবে কাগজপত্রে জানাতে হবে, তা উল্লেখ নেই। কথা হচ্ছে, বিষয়টি তাকে জানানো হয়েছে।’ কীসের ভিত্তিতে জানানো হয়েছে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘তাকে মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে, আমি যতদূর জানি, প্রিজন অফিসিয়াল টোল্ড হিম দ্যাট, আপনার আপিল ডিসমিস হয়েছে, আপনার মৃত্যুদ- বহাল আছে। মন্ত্রী সাংবাদিকদের পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, তাহলে খবরের কাগজ কি মিথ্যা? এখন মন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন, সংবাদপত্রের কথা যদি আপনারা সত্য মনে করেন, তবে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সকল মিডিয়ায় বলেছে, এটা কোনো নির্বাচন হয়নি তাহলে আপনারা কীভাবে ক্ষমতায় আছেন? তাছাড়া একটা ফাঁসি কার্যকর করার মতো একটি মৌলিক বিষয়ে সংবাদপত্রের নিউজের ভিত্তিতে কীভাবে তা গ্রহণযোগ্য হবে- এটা তো মানুষের জীবনের একটি শেষ অধ্যায়। আইনমন্ত্রী ও এটর্নি জেনারেলের প্রতি আবেদন আপনাদের একটা বক্তব্যে দেশে মারাত্মক কিছু ঘটে যেতে পারে। সুতরাং কোনো কিছু মন্তব্য করার আগে একটু ভেবেচিন্তে করবেন। অন্যদিকে এই রায়টি একটি বিভক্ত রায়, সুতরাং বিভক্ত রায়ে এর পূর্ণাঙ্গ কপি হাতে না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাই শ্রেয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন