বাংলাদেশ বার্তাঃ আজ কিছু পত্রিকার রিপোর্ট দেখলাম, 'হঠাৎ কেন ডিভিশন চাইলেন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী !!’ অভ্যাসগতভাবেই এই ডিভিশন চাওয়ার মাঝেও তারা রহস্য খুঁজে পেয়েছেন। অনেকে আবার এ আবেদনটিকেও ‘মানবতাবিরোধী’ বলার চেষ্টায় আছেন। কোনো কোনো পত্রিকা রিপোর্ট এমন করেছে যে, রিপোর্ট পড়ে মনে হয় ডিভিশন চাওয়াটাও যেন একটি অপরাধ।
পত্রিকার রিপোর্টের আলোকে কেন আমরা ডিভিশন চাইলাম সে বিষয়ে বিবেকবানদের কাছে আমি এর ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। যদিও লেখাটি একটু বড় হবে তবুও পুরো লেখাটি ধৈর্য্য সহকারে পড়ার জন্য আপনাদেরকে বিনীত অনুরোধ করছি। কারন, এক শ্রেণীর মানুষ এই আবেদনের মধ্যে 'সরকারের সাথে আঁতাত' এর গন্ধ খুঁজে পাচ্ছেন। বলা যায় না, এই আবেদনের প্রতিবাদে কেউবা আবার রাস্তা বন্ধ করে 'মঞ্চ' খুলে 'পদ্মা মেঘনা যমুনা, এই আবেদন মানিনা' শ্লোগান তুলে রাজপথ প্রকম্পিত করেও তুলতে পারেন।
আমার প্রানপ্রিয় পিতা আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সরকারের রাজনৈতিক রোষানলে ২৯.০৬.২০১০ তারিখে গ্রেফতার হওয়া থেকে শুরু করে ২৮.০২.২০১৩ তারিখে ট্রাইব্যুনালের রায় হওয়া পর্যন্ত ডিভিশন-১ প্রাপ্ত বন্দী হিসেবে কারাগারে অন্তরীন ছিলেন। রায় হওয়ার পরপরই আমার পিতার ডিভিশন বাতিল হয়ে যায়। এরপর সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগে ট্রাইব্যুনালের আদেশের বিরুদ্ধে আমরা আপীল ফাইল করলে আপীল বিভাগ শুনানী শেষে ১৭.০৯.২০১৪ তারিখে ট্রাইব্যুনালের রায় কমিয়ে আমার আব্বার যাবজ্জীবনের আদেশ প্রদান করে। আপীল বিভাগের এ আদেশের পর জেল কোডের ১৯২ পৃষ্টার ১৫ নং অধ্যায়ের ক্লাসিফিকেশন শিরোনামের অধীন ৬১৭ নম্বর বিধি মোতাবেক আমার পিতা ডিভিশন-২ পাওয়ার অধিকারী হন। কারাগারে বহু সংখ্যক ডিভিশন-২ প্রাপ্ত কয়েদী রয়েছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর দীর্ঘ ৪ বছর পার হয়ে গেলেও কারা কর্তৃপক্ষ আমার পিতাকে তার প্রাপ্য ডিভিশন-২ প্রদান করেনি।
যেহেতু আব্বার মামলাটি চুড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়ার কারনে আমাদের আদালতের যাওয়ার আর কোন সুযোগ নেই এবং যেহেতু আব্বা কারাগারে থাকার কারনে তার দেখভালের দ্বায়িত্ব একমাত্র স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়ের, তাই অন্য কোন উপায় না থাকায় আমি (মাসুদ সাঈদী) আব্বার প্রাপ্য ডিভিশন-২ চেয়ে গত ০৯.০৮.২০১৫ তারিখে কারা মহাপরিদর্শকের মাধ্যমে স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবরে একটি আবেদন করি। আমার আবেদন প্রাপ্তির পর কারা কর্তৃপক্ষ তাদের মতামত সহকারে অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক স্বাক্ষরিত একটি পত্র ১১.০৮.২০১৫ তারিখে স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবরে প্রেরণ করে।
এরপর কেটে যায় একে একে প্রায় ৩টি বছর। এই দীর্ঘ সময়ে বহুবার অসংখ্যবার মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেও আমরা আমাদের আবেদনের কোন জবাব পাইনি। ডিভিশন পাওয়া তো দূর, এর মাঝে আব্বা বেশ কয়েকবার কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন কিন্তু আব্বার চিকিৎসার জন্য তাকে হাসপাতালে নেয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি আমরা বারবার। কারন, ‘উপরের’ অনুমতি মেলেনি।
নিদারুন মনোকষ্ট নিয়ে আব্বার ডিভিশন চেয়ে ০৮.০৩.২০১৮ তারিখে আবারো স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবরে আমি আবেদন করি। আমার আবেদনটি স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের গ্রহন ও বিতরণ শাখা ১২.০৩.২০১৮ তারিখে গ্রহন করে। আমার এ আবেদনের পর আবারো কেটে গেছে প্রায় ৩ মাস। কিন্তু আগের মতোই এ আবেদনেরও কোন জবাব কিংবা আব্বার চিকিৎসা বা ডিভিশনের কোন ব্যবস্থা গ্রহন করেনি কারা কর্তৃপক্ষ বা স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়।
মাঝে হঠাৎ করে গত ০৩.০৫.২০১৮ তারিখে কারা কর্তৃপক্ষ আব্বাকে সকাল ১১টার দিকে চিকিৎসার নামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে নিয়ে আসে। প্রথমে আব্বাকে হাসপাতালের পরিচালকের ওয়েটিং রুমে আধা ঘন্টাখানিক বসিয়ে রাখার পর হাসপাতালের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগে নিয়ে যায়। সেখানের কর্তব্যরত চিকিৎসক আব্বার মেডিকেল ফাইল দেখে তাকে পাঠিয়ে দেয় হাসপাতালের রিউমেটোলজি বিভাগে। সেখানের কর্তব্যরত চিকিৎসক আব্বাকে পরীক্ষা নিরীক্ষার পর হাসপাতালে ভর্তি করার জন্য লিখিতভাবে কারা কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেয়। প্রায় ২ ঘন্টা ফোনালাপ শেষ ‘উপরের নির্দেশ নেই’ জানিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ দুপুর ৩টার দিকে আমার আব্বাকে বিনা চিকিৎসায় আবারো কারাগারে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
বিশ্বাস করুন, সেদিন (০৩.০৫.২০১৮) আব্বাকে হাসপাতালে ২/৩ ঘন্টা ঘোরাঘুরি করানো ছাড়া আর কিছুই করা হয়নি। আব্বার সকল রোগের বর্ণনা শোনার পরও তাকে সামান্য একটি ঔষধ লিখেও কোন প্রেসক্রিপশন দেয়া হয়নি।
আমার পরম শ্রদ্ধেয় পিতা আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী দীর্ঘ ৩৯ বছর যাবত ডায়াবেটিক রোগে আক্রান্ত। তিনি একই সাথে হৃদরোগেও আক্রান্ত। ২০০৩ সালে সর্ব প্রথম তার হার্টের করোনারী আর্টারীতে দুটি ব্লক ধরা পড়ে। একটিতে ৭০% অন্যটিতে ৯০%। তখন তার আর্টারীতে ২টি রিং স্থাপন করা হয়। এরপর আওয়ামী সরকার কর্তৃক অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করার পর ২০১২ সালে তিনি বুকে তীব্র ব্যাথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। তখন আবারো আমার পিতার আর্টারীতে ৩টি ব্লক ধরা পড়ে। একটিতে ৯৯%, একটিতে ৯৫% এবং অন্যটিতে ৮০%। এরই প্রেক্ষিতে তাৎক্ষনিকভাবে ডাক্তারের সিদ্ধান্তে তার আর্টারীতে ৩টি রিং স্থাপন করা হয়। প্রথমের ২টি এবং পরের ৩টি নিয়ে বর্তমানে সর্বমোট ৫টি রিং আমার পিতার করোনারী আর্টারীতে স্থাপন করা আছে।
এছাড়া আমার আব্বা আর্থাইটিস রোগেও আক্রান্ত। এ কারনে হাঁটু ও কোমড়ে রয়েছে তার তীব্র ব্যাথা। সরকার কর্তৃক অন্যায়ভাবে তাকে গ্রেফতারের পূর্বে তিনি নিয়মিত ফিজিওথেরাপী নিতেন। গ্রেফতার হওয়ার পর সেই রকম থেরাপী নেয়ার সুযোগ আর আমার পিতার হয়নি। যে কারনে তার হাঁটু ও কোমড়ের ব্যাথা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে।
আমার আব্বার বয়স এখন ৭৯ চলছে। এই বয়সেও উপরোক্ত নানাবিধ শারীরিক সমস্যার পরও শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালার মেহেরবাণীতে তিনি ভালোই আছেন। তবে বয়স ও অসুখজনিত সমস্যার কারনে তিনি শারীরিক কষ্টে আছেন। এখন তিনি দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে পারেন না। কারো সাহায্য ছাড়া বিছানা থেকে একা উঠে দাঁড়াতে পারেন না। ডায়াবেটিক কন্ট্রোল রাখার জন্য তার নিয়মিত হাঁটার প্রয়োজন হয় কিন্তু এখন তিনি কারো সাহায্য ছাড়া হাঁটতেও পারেন না।
এমতাবস্থায়, সংসদ সদস্য ছিলেন শুধু এই কারনে নয় বরং পিতার প্রতি দ্বায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ থেকে পিতাকে অসুস্থতাজনিত শারীরিক কষ্ট থেকে সামান্য প্রশান্তি দেয়ার প্রত্যাশায় ব্যাকুল এক সন্তান হিসেবে আমি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবরে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আমার পিতার চিকিৎসা ও প্রাপ্য ডিভিশন চেয়ে আবেদন করি।
এই আবেদনের মধ্যে কোন দল নেই-মত নেই, রাজনীতি নেই-কুটনীতিও নেই। আছে শুধু পিতার প্রতি সন্তানের ব্যাকুলতা, আছে শুধু পিতার প্রতি সন্তানের নিখাঁদ শ্রদ্ধা আর ভালবাসা।
তবুও আমার এ আবেদনের মাঝে যারা ‘রহস্য’ খুঁজে পেয়েছেন অথবা ‘সরকারের সাথে আঁতাত' এর গন্ধ খুঁজে পেয়েছেন, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ঐ সব লোকদের জন্য আমার ঘৃনা নয়, শুধু করুণাই হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন