আজ সকাল ১০ ঘটিকায় মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় আমরা জনাব আলী আহসান মো: মুজাহিদের মুত্যুদন্ডাদেশের বিরুদ্ধে পুনর্বিবেচনার আবেদন (রিভিউ পিটিশন) দায়ের করেছি। ৩৮ পৃষ্ঠার অত্র আবেদনে ৩২টি যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
১.বুদ্ধিজীবি হত্যার অভিযোগের সমর্থনে রাষ্ট্রপক্ষ দুইজন সাক্ষী হাজির করে। যথা রুস্তম আলী মোল্লা ও জহির উদ্দিন জালাল। ১৯৭১ সালে রুস্তম আলী মোল্লার বয়স ছিল ১৪ বছর এবং জহির উদ্দিন জালালের বয়স ছিল ১৩ বছর। রুস্তম আলী মোল্লা নিজেকে এই ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হিসেবে দাবী করলেও তার সাক্ষ্যে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য বিদ্যমান। আর জহিরউদ্দিন জালাল একজন শোনা সাক্ষী।
২.রুস্তম আলী মোল্লা জনাব মুজাহিদকে আর্মি অফিসারের সাথে ষড়যন্ত্র এবং পরিকল্পনা করতে দেখেনি। সে দাবী করেছে যে, স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার ৩/৪ মাস পর জনাব মুজাহিদকে ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের গেইটে দেখেছে। সে স্বীকার করেছে যে, জনাব মুজাহিদকে পূর্ব থেকে চিনতো না। গেইটে প্রহরারত ব্যক্তিরা বলাবলি করছিল যে, জনাব গোলাম আযম, নিজামী ও মুজাহিদ কলেজে এসেছেন এবং তখন সে মুজাহিদ সাহেবকে চিনতে পারে। রুস্তম আলী মোল্লার সাক্ষ্যে এটি প্রতীয়মান হয় যে, সে পূর্ব থেকে এই তিনজনের কাউকেই চিনতো না। কেউ তাকে সুনির্দিষ্টভাবে মুজাহিদ সাহেবকে চিনিয়েও দেয়নি। তাহলে প্রশ্ন জাগে, পূর্ব থেকে না চেনা স্বত্বেও কিভাবে সে নিজেই কলেজের গেইটে মুজাহিদ সাহেবকে চিহ্নিত করল? তর্কের খাতিরে রুস্তম আলী মোল্লার কথা সত্য বলে ধরে নিলেও এর দ্বারা কি আদৌ এটি প্রমাণিত হয় যে, তিনি আর্মি অফিসারের সাথে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা করেছেন?
৩.জহির উদ্দিন জালাল তার সাক্ষ্যে বলেছেন যে, জনাব নিজামী, মুজাহিদরা ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে আসতেন-এই খবরগুলো রুস্তম আলী মোল্লা কেরানীগঞ্জে তাকে জানিয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা জেরায় স্বীকার করেছেন রুস্তম আলী মোল্লা তদন্তকালে তার কাছে বলেনি যে, বিচ্ছু জালাল নামে কারো সঙ্গে তার পূর্ব পরিচয় ছিল। সুতরাং জালালের দাবী অসত্য প্রমানিত।
৪.রুস্তম আলী মোল্লার পিতা মোঃ রহম আলী মোল্লা ১৯৭১ সালে ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজের প্রহরী হিসাবে কর্মরত ছিলেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা জেরায় স্বীকার করেছেন যে, তিনি আজও জীবিত আছেন। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ এই মামলায় তাকে সাক্ষী হিসাবে ট্রাইব্যুনালে হাজির করেনি। ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজের তদানিন্তন অধ্যক্ষ মুহিবুল্লাহ খান মজলিস এবং তার ছেলে বর্তমান অধ্যক্ষ তারেক ইকবাল খান মজলিসকেও (যিনি ১৯৭১ সালে অষ্টম শ্রেনীর ছাত্র ছিলেন) সাক্ষী হিসাবে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়নি। অধিকন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তা ১৯৭১ সালে অত্র কলেজে কর্মরত কোন শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীর সাথে কথাবার্তা বলেননি এবং তাদের কাউকে সাক্ষী মান্য করেননি। প্রাপ্ত বয়স্ক প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিবর্গ জীবিত থাকা স্বত্বেও অপ্রাপ্ত বয়স্ক একজন ব্যক্তির সন্দেহজনক ও প্রশ্নবিদ্ধ সাক্ষ্যের ভিত্তিতে জনাব মুজাহিদের মৃত্যুদন্ড কিভাবে বহাল রাখা হয়েছে?
৫.জনাব আলী আহসান মো: মুজাহিদের বিরুদ্ধে আর্মী অফিসারের সাথে বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ড সংঘটনের ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনার অভিযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি কবে কোথায় কোন্ আর্মী অফিসারের সাথে এই ষড়যন্ত্র করেছেন এই মর্মে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য প্রমান রাষ্ট্রপক্ষ উপস্থাপন করতে পারেনি। উল্লেখ্য যে, এই কথিত ষড়যন্ত্রের ফলে কে কাকে কোথায় কখন কিভাবে হত্যা করেছে এই মর্মে কোন মৌখিক ও দালিলিক সাক্ষ্য প্রমান উপস্থাপন করা হয়নি।
৬.রাষ্ট্রপক্ষের আনীত ১ নং অভিযোগে সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেনকে হত্যার কথা উল্লেখ থাকলেও মহামান্য আপীল বিভাগ অত্র অভিযোগ থেকে জনাব মুজাহিদকে বেকসুর খালাস প্রদান করেছেন।
৭.জনাব মুজাহিদকে আলবদরের কমান্ডার হিসাবে সাজা দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে নিম্নোক্ত প্রশ্নমালার কোন সদুত্তর রাষ্ট্রপক্ষ দিতে পারেননি-
ক.কে কখন কোথায় কিভাবে জনাব মুজাহিদকে আলবদরের কমান্ডার হিসাবে নিয়োগ প্রদান করেন?
খ.তিনিই কি আলবদরের প্রথম এবং শেষ কমান্ডার? তার আগে এবং পরে কে বা কারা এই দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন?
গ.রাষ্ট্রপক্ষের ভাষ্যমতে ১৯৭১ সালের মে মাসে জামালপুরে মেজর রিয়াজের প্রচেষ্টায় আলবদর বাহিনী গঠিত হয়। ঐ সময় জনাব মুজাহিদ ঢাকা জেলার ছাত্র সংঘের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। তাহলে ঢাকায় বসে কিভাবে তিনি জামালপুরে গঠিত আলবদর বাহিনীর কমান্ডার হলেন?
ঘ.জনাব মুনতাসির মামুন সম্পাদিত ‘দি ভ্যাঙ্কুইশড জেনারেলস’ বইয়ে রাও ফরমান আলী এবং জেনারেল এ, এ, কে, নিয়াজি স্বীকার করেছেন যে, আলবদর বাহিনী সরাসরি আর্মির কমান্ডে এবং কন্ট্রোলে পরিচালিত হতো। প্রশ্ন হলো জনাব মুজাহিদ একজন ছাত্রনেতা হয়ে কিভাবে এই বাহিনীর কমান্ডার হলেন? এই বইটি আমরা পুনর্বিবেচনার আবেদনের সাথে নতুন দালিলিক সাক্ষ্য (ঋৎবংয ঊারফবহপব) হিসেবে দাখিল করেছি।
ঙ.জেরায় তদন্তকারী কর্মকর্তা নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন যে, তার তদন্তকালে রাজাকার, আলবদর, আল-শামস বা শান্তি কমিটির সংশ্লিষ্ট কোন তালিকায় আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের নাম ছিল মর্মে তিনি কোন প্রমান পাননি। তাহলে আদালত কিসের ভিত্তিতে তাকে আলবদরের কমান্ডার সাব্যস্ত করলেন?
চ.স্বাধীনতার অব্যবহিত পরবর্তীকালে (১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত) তদানিন্তন জাতীয় গণমাধ্যমে আলবদরের কর্মকান্ড নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ ছাপা হয়েছে এমনকি ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে তাদেরকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছে। অথচ ঐসব সংবাদ ও বিজ্ঞপ্তিতে জনাব মুজাহিদের নাম কেউ উল্লেখ করেনি। সত্যিই যদি তিনি আলবদরের সারা দেশের কমান্ডার হতেন তাহলে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরবর্তী সময়ে তার নাম কেউ উল্লেখ করেনি কেন?
ছ.বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড নিয়ে ১৯৭২ সালে দালাল আইনে ৪২ টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এর একটিতেও জনাব মুজাহিদকে আসামী করা হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষ এই মামলাগুলোর নথি আদালতে উপস্থাপন করেনি। অথচ ৪২ বছর পর কিভাবে এই হত্যাকান্ডের সকল দায়-দায়িত্ব তার উপর চাপানো হয়েছে?
জ.২৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের তদন্তের জন্য জনাব জহির রায়হানকে আহবায়ক করে ৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। প্রথিতযশা সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার আমির-উল-ইসলাম এবং ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এই কমিটির সদস্য ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষ এই কমিটি কর্তৃক প্রস্তুতকৃত তদন্ত রিপোর্ট ট্রাইব্যুনালে জমা দেয়নি এবং তদন্তকালে তাঁদের কারো সাথে আলোচনাও করেনি। কেন রাষ্ট্রপক্ষ এই তদন্ত রিপোর্ট জাতির সামনে প্রকাশ করেনি?
৮.মহামান্য আপীল বিভাগ সুনির্দিষ্ট কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে হত্যার জন্য জনাব মুজাহিদকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করতে পারেননি। আন্দাজ ও অনুমানের উপর ভিত্তি করে ১৯৭১ সালে নিহত সকল বুদ্ধিজীবী হত্যার ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনার জন্য তাকে দায়ী করেছেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন