রক্তাক্ত ২৮ অক্টোবর আজ। ২০০৬ সালের এই দিনে এ দেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক কলংকজনক অধ্যায় রচিত হয়। চারদলীয় জোট সরকারের শেষ সময়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের সমাবেশ থেকে প্রকাশ্য দিবালোকে লগি বৈঠা দিয়ে তরতাজা তরুণদের পিটিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এই দিনে যে নির্দয়, নিষ্ঠুর ও পাশবিক কায়দায় মানুষ হত্যা করা হয়, তা শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে হতবাক করেছে। এ নির্মম হত্যাকাণ্ড ও পাশবিকতায় কেঁদেছে বাংলাদেশ, কেঁদেছে বিশ্বমানবতা। প্রকাশ্য দিবালোকে লগি, বৈঠা ও মারাত্মক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সেদিন যে হত্যাকাণ্ড ও মানবতাবিরোধী ঘটনা সংঘটিত করা হয়েছিল তা ইতিহাসে বিরল। মৃত লাশের উপর নৃত্য করার দৃশ্য দেখে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। এ নির্মম হত্যাকান্ড সংঘটিত করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের স্বাভাবিক ধারাকে ব্যাহত করা হয়েছে। আটাশ অক্টোবর বাংলাদেশের ইতিহাসে মানবতাবিরোধী অপরাধের এক কলংকজনক দিবস।
জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব থেকে শুরু করে সারাবিশ্বে ওঠে প্রতিবাদের ঝড়। ২৮ অক্টোবরের পৈশাচিকতার বিচার হওয়াতো দূরের কথা, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মামলাই প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। ২৮ অক্টোবরের সেই ঘটনার পূনরাবৃত্তি বর্তমান সরকারের সময়ে দেখা যাচ্ছে। সমাজের বিশিষ্টজনেরা বলছেন, মামলা প্রত্যাহার করার মাধ্যমে বিচার পাওয়ার অধিকারও কেড়ে নেয়া হলো। এর মাধ্যমে অপরাধীরা উৎসাহিত হবে। আর হত্যার রাজনীতিকে উৎসাহিত করার পরিণতি কারো জন্যই শুভ নয়।
২০০৬ সালের ২৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া রেডিও-টিভিতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। মূলত এ ভাষণ শেষ হওয়ার পরপরই দেশব্যাপী শুরু হয় তা-ব। বিভিন্ন স্থানে বিএনপি-জামায়াত অফিসসহ নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি যেমন চালানো হয় পৈশাচিক হামলা, তেমনি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় অনেক অফিস, বাড়িঘর, পুরো দেশব্যাপী চলে তাণ্ডবতা। তার প্রথম শিকার হয় গাজীপুরে জামায়াতে ইসলামীর অফিস। এসময় শহীদ হন রুহুল আমিন।
চারদলীয় জোট সরকারের ৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরীর উদ্যোগে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বিকাল ৩টায় বায়তুল মোকাররমের উত্তর সড়কে পূর্ব নির্ধারিত সমাবেশ ছিলো। সকাল থেকেই সভার মঞ্চ তৈরির কাজ চলছিল। হঠাৎ করেই বেলা ১১টার দিকে লগি, বৈঠা ও অস্ত্রধারীরা জামায়াতের সমাবেশ স্থলে হামলা চালায়। তাদের পৈশাচিক হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হয় জামায়াত ও শিবিরের অসংখ্য নেতা-কর্মী। এই আক্রমণ ছিল সুপরিকল্পিত ও ভয়াবহ। তারা একযোগে বিজয়নগর, তোপখানা রোড ও মুক্তাঙ্গন থেকে পল্টন মোড় দিয়ে আক্রমণ চালায়। এক পর্যায়ে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা পল্টনের বিভিন্ন গলিতে ঢুকে পড়ে এবং নিরীহ জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের বেধড়ক পেটাতে থাকে।
সেদিন পুরো পল্টন জুড়ে ছিল লগি, বৈঠা বাহিনীর তাণ্ডবতা। লগি-বৈঠা আর অস্ত্রধারীদের হাতে একের পর এক আহত হতে থাকে নিরস্ত্র জামায়াত ও শিবিরের নেতাকর্মীরা। তারা শিবির নেতা মুজাহিদুল ইসলামকে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। লগি-বৈঠা দিয়ে একের পর এক আঘাত করে নির্মমভাবে হত্যা করে জামায়াত কর্মী জসিম উদ্দিনকে। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর তারা তার লাশের উপর ওঠে নৃত্য-উল্লাস করতে থাকে।
সে দিন দফায় দফায় হামলা চালানো হয়। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বায়তুল মোকাররমের উত্তর সড়কে জামায়াতের সমাবেশ শুরু হয়। এ সময় পল্টন মোড়ের দিকে না হলেও বিজয়নগরসহ অন্যান্য এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে চোরাগোপ্তা হামলা চালাতে থাকে লগি-বৈঠা বাহিনী। তবে সমাবেশ চলতে থাকে স্বাভাবিকভাবে। যথারীতি আসর নামাযের বিরতি হয়। বিরতির পর বক্তব্য রাখেন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মাওলানা আবদুস সুবহান, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। সভাপতি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ঢাকা মহানগরী আমীর মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান। এরপরই বক্তব্য দিতে দাঁড়ান জামায়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী।
মাওলানা নিজামীর বক্তব্য শুরু হওয়ার ৪/৫ মিনিট পর ৪টা ৪৩ মিনিটে পল্টন মোড়ে উত্তেজনা দেখা যায়। এ সময় নির্মাণাধীন র্যাংগস টাওয়ারের (বাসস ভবনের পূর্ব পাশের বিল্ডিং) ছাদ থেকে সমাবেশ লক্ষ্য করে ১০/১২টি বোমা ও প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে দফায় দফায় গুলী ছুঁড়ে সন্ত্রাসীরা। এ সময় পুলিশ নিজেদের নিরাপদ স্থানে হটিয়ে নেয়। আবার শুরু হয় মরণ কামড়ের মতো আক্রমণ। সমাবেশ ভ-ুল করে দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে তারা। একদিকে ভবনের ছাদ থেকে বৃষ্টির মতো বোমা বর্ষণ করতে থাকে। অপরদিকে পল্টন মোড় থেকে গুলী ছুঁড়তে ছুঁড়তে লগি বৈঠাধারীরা সমাবেশের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এসময় জামায়াত ও শিবিরের নেতাকর্মীরা তৈরী করে মানব ঢাল। আওয়ামী অস্ত্রধারীদের ছোঁড়া গুলী মাথায়বিদ্ধ হয়ে রাজপথে লুটিয়ে পড়েন জামায়াত কর্মী হাবিবুর রহমান ও জুরাইনের জামায়াত কর্মী জসিম উদ্দিন। এ ঘটনায় জামায়াত ও শিবিরের ৬ জন নেতাকর্মী শহীদ এবং আহত হন সহস্রাধিক। মাগরিবের আযানের পর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে আসে যখন বিডিআর পল্টন মোড়ে অবস্থান নেয়। এর আগে সমাবেশের কোন বক্তাই উত্তেজনাকর বক্তব্য দেননি, আক্রমণাত্মক কথাও বলেননি কেউ।
ঘটনার পরদিন জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে পল্টন থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের ৪০ জন নেতার নামসহ সহস্রাধিক ব্যক্তিকে আসামী করা হয়। ২০০৭ সালের ১১ এপ্রিল আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে পলাতক আসামী হিসেবে উল্লেখ করে ৪৬ জন আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। চার্জশিট দাখিলের পর ২২ এপ্রিল ২০০৭ মামলার চার্জশিট গ্রহণ করেন মহানগর হাকিম মীর আলী রেজা। চার্জশিট গ্রহণ করেই আদালত পলাতক আসামী শেখ হাসিনাসহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। পরদিন ২৩ এপ্রিল তদন্ত কর্মকর্তার নাটকীয় আবেদনের প্রেক্ষিতে পরোয়ানা স্থগিত করে মামলাটি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন মহানগর হাকিম মীর আলী রেজা। সেই থেকে অধিকতর তদন্তের নামে তিন বছর পার করে দেয়া হয়।
২০০৯ বছরের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তাদের দলীয় নেতাকর্মী, সমর্থক ও শুভাকাক্সক্ষীদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ৯ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব আবু সাঈদ পল্টন থানায় দায়ের করা হত্যা মামলাটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত জানিয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসককে একটি পত্র দেয়। ১৭ আগস্ট আদালত মামলাটি প্রত্যাহারের আবেদন মঞ্জুর করে।
আইন অনুযায়ী যেকোন হত্যা মামলা বাদীর সম্মতি ছাড়া প্রত্যাহার করার সুযোগ না থাকা সত্ত্বেও মহাজোট সরকার তাই করেছে। আইন বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, কোন হত্যাকা-ের মামলাই রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করার সুযোগ নেই। যদি কোন ব্যক্তিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত করা হয়েও থাকে তদন্ত শেষে আদালতই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
মামলা প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে বিচার পাওয়ার অধিকার কেড়ে নেয়া হলো। এর মধ্য দিয়ে অপরাধীরাই উৎসাহিত হয়। ২৮ অক্টোবরের পৈশাচিকতা বিশ্ব বিবেককে আঘাত দিয়েছে। নাড়া দিয়েছে বিবেকবান সকল মানুষকে। রাজনৈতিক সমাবেশ ভণ্ডুল করার জন্য প্রকাশ্য দিবালোকে এভাবে সাপের মতো পিটিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনা বিরল। যা এখনো হাজার হাজার মানুষকে কাঁদায়। এ লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমরা দেখতে পারছি। এই অক্টোবরেই একই কায়দায় নাটোরের বড়াইগ্রামের উপজেলা চেয়ারম্যানকে প্রকাশ্য পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা আরো ঘটেছে।
২৮ অক্টোবরের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। দেশ ও জাতির স্বার্থেই এ ঘটনার রহস্য উদঘাটন, দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং নেপথ্য নায়কদের খুঁজে বের করা প্রয়োজন।
কর্মসূচি: ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের নারকীয় হত্যাকাণ্ডর সাথে জড়িত খুনিদের বিচারের দাবিতে আজ বুধবার দেশব্যাপী শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে জামায়াতে ইসলামী। জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান গতকাল মঙ্গলবার দেয়া এক বিবৃতিতে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। (((সামছুল আরেফীন-The Daily Sangram)))
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন