ছাত্রসংবাদ: ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বাংলাদেশের ইতিহাসের জঘন্যতম এক কালো অধ্যায়। এদিন রাজপথে প্রকাশ্যে পিটিয়ে খুন করা হয়েছিল দেশপ্রেমিক জনতার পাশাপাশি অসংখ্য মেধাবী ছাত্রকে। এক সাথে এতগুলো মেধাবী ছাত্রকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে প্রকাশ্য রাজপথে হত্যা করার ঘটনা বিশ্ব ইতিহাসে ছিল বিরল। সেদিন পিচঢালা কালো রাজপথ লাল রঙে রঞ্জিত হয়েছিল মেধাবী ছাত্র আর দেশপ্রেমিক জনতার খুনঝরা রক্তে।
সেদিন যে সকল মেধাবীকে হত্যা করা হয়েছিল তাদের পরিচয় কী ছিল? তারা কি চিহ্নিত কোন সন্ত্রাসী ছিল? তারা কি ধর্ষণ কিংবা ধর্ষণের সেঞ্চুরি উদযাপনকারী কেউ ছিল? তারা কি কোন ধরনের চাঁদাবাজি কিংবা টেন্ডারবাজিতে জড়িত ছিল? তাদের হাতে কি কোন নারীর সম্ভ্রমহানি কিংবা কোন নারী ইভটিজিংয়ের শিকার হয়েছিল? তারা কি অস্ত্র কিংবা চাপাতি উঁচিয়ে কাউকে খুন কিংবা কোপানোর জন্য ধাওয়া করেছিল? তার কি কোন ক্যাম্পাস হল কিংবা ছাত্রাবাসে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল? তারা কি কোন শিক্ষককে লাঞ্ছনা কিংবা ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করেছিল? তারা কি প্রকাশ্য রাজপথে নিরীহ দর্জি দোকানি বিশ্বজিৎ কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু বকরের মতো কাউকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে পিটিয়ে খুন করেছিল? তাহলে কেন বেছে বেছে এই মেধাবীদের খুন করা হলো?
অথচ এ সকল মেধাবী ছিল দৃঢ় অকুতোভয়। তাদের বক্ষে ছিল মহাগ্রন্থ আল কুরআনের সুষমা। তাদের চেতনায় লালন করা ছিল সমৃদ্ধ বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। তাদের স্বপ্ন ছিল আলোকিত বাংলাদেশ, উন্নত পৃথিবী। এটাই কি ছিল তাদের অপরাধ? সে সময় পাঁচ মেধাবী ছাত্রের শাহাদাতের ঘটনায় ছাত্রশিবির কর্তৃক প্রকাশিত পোস্টারে আলোড়িত হয়েছিল সমগ্র বাংলাদেশ। দেয়ালে দেয়ালে, মসজিদের পাশে, অলিতে গলিতে সাঁটানো সেই পোস্টার দেখতে সেদিন উপচে পড়েছিল অগণিত জনতা। বিবেকসম্পন্ন সকল মানুষের হৃদয়কে সেদিন নাড়া দিয়েছিল এই পোস্টারটি। পোস্টার দেখেছেন অথছ হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়নি, চোখ থেকে অবলীলায় অশ্রু গড়িয়ে পড়েনি এমন মানুষের সংখ্যা নিতান্তই কম হবে। সেদিন অস্ফুটে সবাই বলেছিল হায় আমরা এ কী দেখলাম! নিরীহ মায়াবী চেহারার এই মেধাবী মুখগুলোকে নির্মমভাবে হত্যা করতে ওদের কি একটুও হৃদয় কাঁপেনি?
সেদিন পল্টন মোড়ে লগি-বৈঠা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খুন করা হয়েছিল স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিবিএ অনার্স তৃতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্র হোসাইন মুহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলামকে। যার মেধায় মুগ্ধ হয়েছিলেন তারই ক্যাম্পাসের প্রিয় শিক্ষকেরা। শিশু বয়স থেকেই শান্ত স্বভাবের এই মেধাবী সন্তানকে নিয়ে একবুক স্বপ্ন লালন করেছিলেন মুজাহিদের পিতা-মাতা, প্রিয় নানাসহ আত্মীয়স্বজনেরা। বিরক্ত আর বাবা-মাকে কষ্ট দেয়া কাকে বলে এমন ধরনের আচরণ কখনো ছিল না মুজাহিদের মাঝে।
২৮ অক্টোবরের সেই নারকীয় তাণ্ডবে শাহাদাত বরণ করেছিলেন আরো এক মেধাবী মুখ যার নাম শহীদ হাফেজ গোলাম কিবরিয়া শিপন। ঢাকা কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন এই মেধাবী ছাত্রটি। ছোট বয়সেই যিনি মেধার পরিস্ফুটন ঘটিয়েছিলেন মানবতার মুক্তির সনদ মহাগ্রন্থ আল কুরআনকে বক্ষে ধারণ (হিফজ) করে। শুধু তাই নয়, দাখিল (এসএসসি) পরীক্ষায় জাতীয় মেধায় সম্মিলিত তালিকার ১১তম স্থান দখল করে নিজের মেধার পরিচয় দিয়ে আগামীর নেতৃত্ব দেয়ার জানান দিয়েছিলেন।
রক্তাক্ত ২৮ শের সেই দিনে শাহাদাতের মিছিলের আরো একটি উজ্জ্বল নাম হলো নারায়ণগঞ্জের শহীদ আবদুল্লাহ আল ফয়সাল। সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন চিটাগাং রোডে আওয়ামী হায়েনারা নির্মমভাবে নৃশংস হামালা চালিয়ে মারাত্মক আহত করলে ২৯ অক্টোবর ঢাকার একটি হাসপাতালে শাহাদাত বরণ করেন তিনি। আবদুল্লাহ আল ফয়সাল ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অনার্স প্রথমবর্ষের ছাত্র। সদা হাস্যোজ্জ্বল আর মায়াবী চেহারার ফয়সালের ধীরস্থিরতা আর বুদ্ধির দ্বীপ্তিতে বিমোহিত হতো তার সহপাঠীরা। মরহুম বাবার সুশিক্ষাকে বুকে ধারণ করেই সামনে অগ্রসর হতে চেয়েছিলেন ফয়সাল। কিন্তু হায়েনাদের ছোবলে আর সম্ভব হয়নি সেটি।
রক্তাক্ত ২৮শের এই মিছিলের আরেক সাথী ছিলেন শহীদ মু.রফিকুল ইসলাম। কুড়িগ্রামের এসএসসি পরীক্ষার্থী মেধাবী এই ছোট্ট কিশোরটিকেও হত্যা করতে ওদের হৃদয়ও এতটুকুন কাঁপেনি। ২৮ অক্টোবর ১৪ দলীয় লগি-বৈঠাধারীদের পৈশাচিক হামলায় আহত হয়ে বিকেলে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শাহাদাতের পেয়ালা পান করেন এই মেধাবী কিশোর।
মেধাবীদের লাশের মিছিলে সেদিন শামিল হয়েছিলেন আরো এক মেধাবী ছাত্র যার নাম শহীদ সাইফুল্লাহ মোহাম্মদ মাসুম। ২৮ অক্টোবর বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে ১৪ দলের সন্ত্রাসী হায়েনাদের হামলায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ২ নভেম্বর শাহাদাতের মিছিলে যোগ দিয়ে চলে যান মহান প্রভুর সান্নিধ্যে। শিক্ষিকা মা আর চাকরীজীবী বাবার মেধাবী পরিবারের মেধাবী সন্তান মাসুম ছিলেন সরকারি তিতুমীর কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র। এসএসসি পরীক্ষায় মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে তিনটি লেটারসহ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, মেধার স্বাক্ষর রেখে দেশের সেরা কলেজ বিএএফ শাহীন কলেজে এইচএসসিতে পড়ার যোগ্যতাও অর্জন করেছিলেন তিনি। তিতুমীর কলেজে ইংরেজি পড়ার পাশাপাশি স্বপ্ন ছিল লন্ডনে গিয়ে উচ্চতর পড়াশোনার, সেই স্বপ্নটিকে লালন করে অগ্রসরও হয়েছিলেন। কিন্তু পারলেন না সেই স্বপ্নের বাস্তব রূপ দিতে। তার আগেই হায়েনারা কেড়ে নিলো তার জীবনপ্রদীপ। এভাবে শুধু মাছুম কেন- মুজাহিদ, শিপন, ফয়সাল, রফিক সবারইতো স্বপ্ন ছিল একটি স্বপ্নিল জীবন গড়ার। একটি সমৃদ্ধ দেশ গড়ার।
কিন্তু কারা সেদিন মেধাবী ছাত্র আর দেশপ্রেমিক জনতার ওপর হিংস্র হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তা গোটা জাতির কাছে অজানা নয়। সেদিন তারাই চেঙ্গিসীয় বর্বরতাকে হার মানিয়ে নির্মম হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল, যারা ছিল দেশ ও ইসলাম বিরোধী শক্তির পৃষ্ঠপোষক, যারা দেশকে পরাধীন বানাতে চেয়েছিল, যারা চেয়েছিল এ দেশ পরনির্ভরশীল থাকুক! যাদের প্রত্যাশা ছিল বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করে ভিনদেশীদের করদরাজ্যে পরিণত করা। যাদের স্বপ্ন ছিল আফগানিস্তানের হামিদ কারজাই আর ইরাকের মালিকির মত আধিপত্যবাদীদের পুতুল সেজে ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করা।
মেধাবীদেরকে হত্যা করে তারা কী চেয়েছিল? মেধাশূন্য বাংলাদেশ? পরনির্ভরশীল জাতি? নাকি রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নস্যাৎ করে শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করা যাতে মেধা পাচার করা যায়। যাতে দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা দেশের পরিবর্তে ভিনদেশে গিয়ে মেধা লালনকেই উপযুক্ত মনে করে।
২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের নারকীয় হত্যাযজ্ঞে সেদিন যারা নেতৃত্ব দিয়েছিল আজ তারা ক্ষমতার মসনদে সমাসীন। ক্ষমতার মসনদের বাইরে থেকে সেদিন তারা যা করেছিল ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করে আজ হিটলার, মুসোলিনি আর চেঙ্গিসীয় এই উত্তরসূরিরা সেদিনের নারকীয় নির্মমতাকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে মাত্র।
২৮শের সেই দিনে পিচঢালা কালো রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল মাত্র। কিন্তু আজকের এই দিনে বাংলাদেশের প্রান্তরে প্রান্তরে শুধু পিচঢালা কালো রাজপথ নয় বরং সবুজ জমিনও লাল রক্তে রঞ্জিত। সেদিন মেধাবীদের লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যার মাধ্যমে যে নির্মমতার শুরু হয়েছিল আজ সেটি যেন মেধাবী ছাত্রদের লাশের মিছিলে পরিণত হয়েছে। আজ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ছাত্রলীগ নামধারী জঙ্গি সন্ত্রাসীদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের আস্তানায় পরিণত হয়েছে। প্রকাশ্য দিবালোকে প্রতিপক্ষের পা কেটে বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে রক্তাক্ত ২৮শের লোমহর্ষক স্মৃতিকে নতুন করে সামনে এনেছে। আজ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সেদিনের উত্তরসূরিরা গোটা বাংলাদেশকে কারাগারে পরিণত করেছে।
আজ ঘরে ঘরে শোকের মাতম। সন্তান হারানোর বেদনায় মায়েদের আহাজারিতে আজ আকাশ বাতাস প্রকম্পিত। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ায় আজ শুধু মেধাবীদের লাশের মিছিল। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য রক্তাক্ত ২৮শে অক্টোবরের চেতনাকে শাণিত করতে হবে। শোককে শক্তিতে পরিণত করে আওয়ামী জুলুমশাহির মসনদ উপড়ে ফেলতে হবে। সেদিন জীবন দিয়ে যেভাবে শহীদ মুজাহিদ, মাসুম, শিপন, রফিক এবং ফয়সালরা বাতিলের কাছে মাথা নত না করার শিক্ষা আমাদের দিয়ে গেছেন। আজ আমাদের শপথ হোক এটাই যেÑ আমরা নীরব হবো না, নিথর হবো না, নিস্তব্ধ হবো না, যতদিন না বাংলার জমিনে ইসলামকে বিজয়ী শক্তি হিসেবে দেখতে না পাবো। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের কবুল কর। আমিন।।
লেখক : কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন