বাংলাদেশ বার্তা ডেস্ক, ১৯ মে ২০১৬: জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে মানবতাবিরোধী অপরাধে দন্ডিত হওয়ার পর আদালতের দেয়া মৃত্যুদ-াদেশ কার্যকর নিয়ে প্রশ্নতুলেছে সৌদি গেজেট। সৌদি আরবের ওই পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে দেশটির সাবেক কূটনীতিক ড.আলী আল গামদী ‘কোন পাপে নিজামীকে ফাঁসি দেয়া হল’ এমন প্রশ্ন তুলে এক নিবন্ধ লিখেছেন। এ নিবন্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। প্রশ্ন তোলা হয়েছে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নিয়ে। আমাদের সময় ডটকমের সৌজন্যে পাঠকদের অবহিত করতে প্রতিবেদনটি পরিবেশন করা হল।
অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার বিরোধী দলের নেতা ও জামায়াতে ইসলামের আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করেছে। বাংলাদেশের বর্তমান শাসকরা আন্তর্জাতিক অনুরোধ উপেক্ষা করেই সাবেক এ মন্ত্রী ও সাংসদকে ফাঁসিরকাষ্ঠে ঝুঁলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকর করে।
অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ ‘বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে’র (আইসিটিবি)’র রায়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা বিরোধী নেতাদের মধ্যে মাওলানা নিজামী পঞ্চম। এ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার ও জবাবদিহিতার জন্য। কিন্তু পদ্ধতিগত অনিয়ম, বিচারে রাজনৈতিক কারসাজি ও আইনি পক্ষপাতদুষ্টতা এর বৈধতাকে কলঙ্কিত করেছে। ৪৫ বছর আগে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন যদ্ধাপরাধের অভিযোগে তার মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। এ যুদ্ধে অখ- পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ নামে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পরিহাসমূলক বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করার পর নিজামীর মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছে, যেখানে মৌলিক আন্তর্জাতিক মানদন্ডের ব্যাপক অভাব ছিল।
জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা, অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ইন্টারন্যাশনাল বার অ্যাসোসিয়েশন ও ব্রিটিশ হাউজ অব লর্ডস এর মতো প্রায় সকল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো আইসিটিবি ও এর বিচার প্রক্রিয়ায়কে আন্তর্জাতিক মানদ-ের পরিপন্থি ঘোষণা করেছে। এছাড়াও কয়েকজন আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় মানবাধিকার কর্মীও একই অভিযোগ করেছেন। এর মধ্যে আমেরিকার এক রাষ্ট্রদূত ও এক মানবাধিকার বিশেষজ্ঞের নাম উল্লেখযোগ্য।
এটি দুর্ভাগ্যজনক যে, বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক সমালোচনা ও অনুরোধে কোনো কর্ণপাতই করেনি। এর পরিবর্তে সরকার সেইসব বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে টার্গেট অব্যাহত রেখেছে, যাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭২ সালের শুরু থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকা- পর্যন্ত শাসনামলে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ করা হয়নি। মুজিবুর রহমান এমনকি যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ১৯৫ জন পাকিস্তানি সৈন্যকেও ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।
নয়া দিল্লিতে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সই হওয়া একটি ত্রিদেশীয় চুক্তির আওতায় তিনি এই রাজক্ষমা করেছিলেন। বাংলাদেশের দলগুলোর মধ্যে পুনরায় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই এ চুক্তি সই করা হয়। এ সবকিছুই করা হয় ‘ভুলে যাওয়া ও ক্ষমা করা’ নীতির ভিত্তিতে। সেই সাথে শেখ মুজিবুর রহমান একটি বিখ্যাত উক্তি করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘পৃথিবী জানুক, বাঙালিরা কিভাবে ক্ষমা করতে পারে। ’
যুদ্ধাপরাধের দায়ে এখন যাদের বিচার করা হচ্ছে এবং যাদের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছে, মুজিব কন্যা ও আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তার ক্ষমতাকালীন মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কখনই তাদের বিচারের কথা বলেননি। এই বিচারের পেছনে শেখ হাসিনার গোপন কৌশল রয়েছে। তিনি বিরোধী নেতাদের নির্মূলের মাধ্যমে বিরোধী দলগুলোকে অত্যধিক দুর্বল করতেই এই কৌশল নিয়েছেন। যাতে করে তিনি বাংলাদেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।
শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে বামপন্থিদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে পুনরায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে। অথচ এসব বামপন্থিরা তার বাবার প্রধান শত্রু ছিল। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে তিনি ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে তথা কথিত আইসিটিবি প্রতিষ্ঠা করেন। শুধু নাম ছাড়া এই ট্রাইব্যুনালে আন্তর্জাতিক মানের কিছুই নেই। ট্রাইব্যুনালে আন্তর্জাতিক বিচারকও নেই। যুদ্ধাপরাধের অভিযুক্তদের কোন আন্তর্জাতিক আইনজীবী নিয়োগের অনুমোদন দেওয়া হয়নি।
অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিশেষজ্ঞ ও বিখ্যাত আন্তর্জাতিক আইনবিদ টবি এম ক্যাডম্যানকেও বাংলাদেশে প্রবেশে অস্বীকৃতি জানানো হয়েছে। ঢাকা বিমানবন্দর নামার পর অবিলম্বে তাকে সেখান থেকেই ফেরত পাঠানো হয়। এমনকি যখন স্থানীয় আইনজীবীরা আসামী পক্ষের আইনজীবী হিসেবে কাজ করতে আসে, তাদেরও বিব্রতকর অবস্থায় ঠেলে দেয়া হয়। এধরনের এক আইনজীবীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। অন্যদিকে অন্য একজনকে হুমকি দেয়া হয় এবং যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কাজ করতে করা প্রস্তাব প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হয়।
মাওলানা নিজামী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন এবং কৃষি ও শিল্প বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার বিচারে আন্তর্জাতিক মান ও নিয়ম বজায় রাখা হয়নি।
দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, আসামি পক্ষের আইনজীবীদের তাদের মক্কেলের পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য মাত্র ২০ দিনের সময় দেওয়া হয়। অপর দিকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের সময় দেওয়া হয় প্রায় ২ বছর। একইভাবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের ২৬ জন সাক্ষীর অনুমোদন দেওয়া হয়। অন্যদিকে আসামীর পক্ষে মাত্র ৪ জন সাক্ষী হাজিরের অনুমোদন দেয়া হয়। এই সব দৃষ্টান্ত স্পষ্ট করে যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই এসব বিচার করা হয়েছে।
এখানে কোনো সন্দেহ নেই, এ ট্রাইব্যুনাল ও এর রায়ের সঙ্গে জড়িতরা ইতিহাসে জায়গা করে নেবে, যে ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে কয়েকজন নির্দোষ ব্যক্তির মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছে। এই ট্রাইব্যুনাল শুধু বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার উপর আঘাত হানবে না, এটি দেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের সুনামেও আঘাত হানবে। শেখ মুজিব পাকিস্তানি সেনাদের সহায়তাকারীদের ‘ভুলে যাওয়া ও মার্জনা’র ভিত্তিতে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।
চূড়ান্তভাবে পর্যবেক্ষক টবি এম ক্যাবম্যানের উদ্ধৃতি বলতে চাই। হাফিংটন পোস্টের ওয়েবসাইটে তিনি লিখেছেন, নিজামীকে অন্যায়ভাবে মৃত্যুদ- দেওয়া হয়েছে। ক্যাডম্যান ওই নিবন্ধে বলেন, ট্রাইব্যুনাল ও সুপ্রিমকোর্টের দেওয়া রায় আন্তর্জাতিক বিচারের মানদন্ড বজায় ছিল না।
আন্তর্জাতিক আইনি বিশারদরা নিজামীর ফাঁসির রায় কার্যকরের দুই দিন আগে সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে একটি বিবৃতি প্রদান করেন। ওই বিবৃতিতে ইন্ডিপেডেন্ট গ্রুপ অব প্রসিকিউটরস ও জাজেজ ও একাডেমিকদের স্বাক্ষর ছিল।
লেখক: ড.আলী আল গামদী সৌদি আরবের দক্ষিণপূর্ব এশিয়া বিষয়ক সাবেক কূটনৈতিক।
উৎসঃ আমাদের সময়
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন