পাবনার সাঁথিয়া থেকে ফিরে: জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকরের আগেই অফিসের অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে রওনা দিয়েছিলাম পাবনার সাঁথিয়ার উদ্দেশ্যে, যেখানে তাকে সমাহিত করা হয়েছে।
ঢাকা থেকে মঙ্গলবার রাত এগারটার দিকে মাইক্রোবাসে রওনা দেয়ার পর সাঁথিয়ার মনমথপুর গ্রামে পৌঁছাই বুবধার ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে। এর প্রায় পৌনে একঘণ্টা পরে সকাল ৬টা ২০ মিনিটে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির কড়া প্রহরায় এখানে পৌঁছায় নিজামীর মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্স।
এ সময় সেখানে এক আবেগঘন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
নিজামীর মরদেহ পৌঁছানোর আগে থেকেই সেখানে অপেক্ষা করছিলেন দুই ছেলে ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন ও ডা. নাইমুর রহমান খালিদ। বুধবার ভোর হতেই পুলিশের চেকপোষ্ট-কড়াকড়ি অতিক্রম করে পায়ে হাঁটা মানুষের ঢল নামে।
মাওলানা নিজামীর গ্রামের বাড়ির প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূর থেকেই সকল প্রকার যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করে প্রশাসন।
সকাল ৬টা ৪৫ মিনিটে নিজামীর মরদেহ জানাজার জন্য কবরস্থান সংলঘ্ন মাঠে নেয়া হয়। পূর্ব থেকেই সেখানে অর্ধ লক্ষ জনতার সমাগম লক্ষ্য করা যায়। প্রশাসনের তাগাদায় দ্রুতই জানাজার নামাজ শুরু করতে হয়। জানাজার পূর্বে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন মাওলানা নিজামীর মেজো ছেলে ব্যারিষ্টার নাজিব মোমেন।
আবেগতাড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, সারা দুনিয়ার মানুষ জানে আমার বাবা একজন ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি কখনো মিথ্যা বলেননি। কোনো অন্যায় করেননি। তারপরেও বর্তমান সরকার কালো আইন তৈরি করে মিথ্যা অভিযোগ এনে দলীয় কর্মীদের সাক্ষী সাজিয়ে তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। শাহাদাতের তামান্না ছিলো তার জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে। তার এই শাহাদাতের বিনিময়ে এদেশে শান্তির ফায়সালা হবে।
তিনি বলেন, যারা জুলুম করেছে আল্লাহ যেন তাদের উত্তম শিক্ষা দেন। তিনি সমবেত জনতাকে জিজ্ঞাসা করেন মাওলানা নিজামী কেমন মানুষ ছিলেন। উপস্থিত সবাই একবাক্যে বলেন তিনি ভালো মানুষ ছিলেন। আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি।
তিনি বলেন, আপনাদের এই সাক্ষ্যই উত্তম মর্যাদা দান করবেন। আল্লাহ যেন তার শাহাদাত কবুল করেন। তার শাহাদাতের বিনিময়ে এদেশে ইসলামের বিজয় দান করেন।
তিনি বলেন, আপনাদের শেষ ইচ্ছা ছিল আপনাদের প্রাণপ্রিয় নেতার চেহারা দেখার। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। এতে আফসোস করার কিছুই নেই। কেয়ামতের ময়দানে আল্লাহ আপনাদের সাথে তার দেখা করার সুযোগ করে দিবেন। তার সাথে আপনারা জান্নাতে যাবেন। রাসুল (স) এর আদর্শের পূর্ণ অনুসরণ ছিলো তার সারা জীবনের সাধনা। সেই সাধনা তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত করে গেছেন।
তিনি বলেন, কালো আইন দিয়ে মানুষ হত্যা করা যায় কিন্তু আদর্শকে হত্যা করা যায় না।
জানাজায় উপস্থিত ছিলেন জামায়াতে ইসলামী ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান, নির্বাহী পরিষদ সদস্য মাওলানা আব্দুল হালিম, পাবনা জেলা জামায়াতের সেক্রেটারী অধ্যাপক আবু তালেব মন্ডল, শিবিরের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান, শিবিরের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি শোয়ের শাহরিয়ার, পাবনা শহর সভাপতি মঞ্জুরুল ইসলাম প্রমুখ।
জানাজা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আইন শৃংখলা বাহিনীর লোকেরা লাশ নিয়ে যায় কবরস্থানে। বাধ ভাঙ্গা জোয়ারের মতো সাধারণ মানুষ কবরস্থানে ঢুকে পড়তে চাইলে আইন শৃংখলা বাহিনী তাদের বাঁধা দেয়। তাদের বাধা উপেক্ষা করে হাজার মানুষ প্রাচীর টপকে কবরস্থানে প্রবেশ করে। দাফন সম্পন্ন হলে দোয়া করা হয়। দোয়া করেন ব্যারিষ্টার নাজিম মোমেন।
প্রশাসনের তিন স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনী এবং পথে পথে বাধা, মানুষকে ফিরিয়ে দেয়াসহ নানা বিপত্তি সত্ত্বেও হাজার হাজার মানুষ শরিক হয় মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী জানাজায়।
আগের দিন সন্ধ্যা থেকে মনমথপুরের গ্রাম, কবরস্থানগামী সকল রাস্তা ওলি গোলী ও মেঠোপথ পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়া হয়। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি কোনো সংবাদকর্মীকেও এসময় এলাকায় ঢুকতে দেয়া হয়নি। কোনো প্রকার ছবি তোলায় ছিলো পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের অভিযোগে মাওলানা নিজামীর মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলেও এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে পাওয়া গেল তার ভিন্ন তথ্য।
বুধবার সকাল ৬টায় কফিন পৌঁছানোর আগেই কবরস্থান সংলঘ্ন মাঠে অবস্থান করছিলেন ৭৫ বছর বয়সী লুৎফর রহমান।
তিনি জানান, ‘স্বাধীনতার আগে নিজামীকে কখনো দেখিনি। শুনেছিলাম মনমথপুরের লুৎফর মাওলানার এক ছেলে আছে, খুবই জ্ঞানী। তবে তিনি এলাকায় আসেন না। স্বাধীনতার ২ বছর পরে ১৯৭৩ সালে তাকে প্রথম দেখি গ্রামের মসজিদের কাছে এক তাফসীর মাহফিলে, সেখানে বক্তব্য রাখেন তিনি। সেটাই তার প্রথম সাঁথিয়ায় আসা।’
জানাজার পরে কথা হয় সাঁথিয়া উপজেলা বিএনপির সহ সভাপতি ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান মো. সালাহউদ্দিন খাঁনের সাথে। তিনি বলেন, ছোট বেলা থেকে তাকে দেখে আসছি অত্যন্ত ভালো মানুষ হিসেবে।
সালাহউদ্দিন শহীদ পরিবারের সন্তান। উনার পিতার নাম শহীদ হাবিলদার আব্দুল রাজ্জাক। তিনি সিলেট থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
আবেগাপ্লুত কন্ঠে তিনি বলেন, শহীদ পরিবারের সন্তান হিসেবে বলছি মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ মিথ্যা। তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার স্বীকার, শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারলেই তাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে।
পার্শবর্তী গোলবাড়ী গ্রাম থেকে জানাজায় এসেছিলেন ছানাউল্লাহ ফকির (৭২) এবং আব্দুর রাজ্জাক (৬৫)। নিজামী সম্পর্কে জানতে চাইলে কেঁদে দিলেন তারা।
ছানাউল্লাহ ফকীর জানান, নিজামী যখন মন্ত্রী ছিলেন তখন তার গ্রামের এক মসজিদের অনুদানের জন্য ঢাকায় তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন তিনি। একজন মন্ত্রী যে এতটা সাধারণ স্বভাবের হয় তা দেখে অবাক হয়েছিলাম।
তিনি, নিজ হাতে তাকে নাস্তা খাইয়েছিলেন। রেখেছিলেন নিজ বাসায়, পরদিন অনুদানের টাকাসহ পাবনার সাঁথিয়ায় পৌঁছানোর ব্যবস্থাও করেছিলেন।
জানাজায় এসেছিলেন স্কুলছাত্র আকাশ, হেলাল সহ আরো অনেকেই। তারা জানান, ‘কখনো দেখিনি নিজামী সাহেবকে তবে আব্বু-আম্মুর কাছে শুনেছি খুবই ভালো ছিলেন তিনি। টিভিতে যা দেখি বাস্তবে তা মেলাতে পারছি না, ভালো মানুষ না হলে কারো জানাজায় এতো মানুষ আসে।’
নিজামীর চেয়ে বছর দশেকের বড় মনমথপুর গ্রামের ইমান আলী শেখ (৮৬) জানান, নিজামীকে আমি ছোট বেলা থেকেই দেখে আসছি। আমি কখনো দেখি নাই তিনি কোনো মুরুব্বিকে অসম্মান করেছেন। তাকে সবাই আদর করতো। ছোটরা সবাই তাকে শ্রদ্ধা করতো। ছোটবেলা থেকেই তিনি এই গুণ অর্জন করেছিলেন। তিনি এমন কোনো অন্যায় করতে পারেন না যাতে করে তাকে ফাঁসির মতো দণ্ড দেয়া যায়।
মনমথপুর গ্রামের আব্দুল মাবুদ (৬০) বলেন, অত্যান্ত ভাল মানুষ ছিলেন নিজামী। তার বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ আনা হয়েছে তা শুধু আমি কেন, যে তার সাথে একবার সাক্ষাৎ করেছে সেও বিশ্বাস করে না।
জহুরুল ইসলাম (৭০) বলেন, মাওলানা নিজামী শতশত বছরেও একজন জন্ম নেয় না। সে একজন ক্ষণজন্মা পুরুষ। আমরা শুধু তাকে হারালাম না। জাতি অনেক বড় এ্যাসেট হারালো, যা পুরণ হওয়ার নয়।
প্রায় শতবর্ষী এক নারী বসেছিলেন রাস্তায় নিজামীর লাশ দেখার জন্য, লাশ দেখা তার হয়নি। যেমনটি হয়নি অন্য কারোরই। তিনি আক্ষেপ করছিলেন, এমন ভাল মানুষটারে কে মেরে ফেলল। ভাল মানুষকে যারা মারে তারা ভাল হতে পারে না। তিনি এভাবে নানা প্রলাপ বকছিলেন।
কথা হয় সাথিয়ার আমোষ গ্রামের দিন মজুর মো. ফয়সালের সাথে, কথা বলছিলেন আর কাঁদছিলেন। তিনি বলেন, নিজামীকে ভালোবাসেন বলেই পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে কয়েক মাইল পথ পায়ে হেঁটে ধানের মাঠ পেরিয়ে পাড়ি দিয়ে এসেছেন। তার মতো অনেকেই এসেছে, কেউই বিশ্বাস করে না নিজামী কোনো খারাপ কাজ করতে পারেন।
প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘পুলিশের বাঁধা পাড়ি দিয়ে এতো মানুষ দেখে কি আপনাদের মনে হয় নিজামী সাহেব খারাপ মানুষ ছিলেন?’
প্রথম জানাজা শেষে কবরস্থান সংলঘ্ন মাঠেই বুধবার সকাল পৌনে ১০টায় অনুষ্টিত হয় গায়েবানা জানাজা। লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতি দেখা যায় এসময়। জানাজার পূর্বে বক্তব্য রাখেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মাওলানা আব্দুল হালিম।
তিনি বলেন, ব্যক্তি নিজামীকে হত্যা করা যেতে পারে কিন্তু তার আদর্শকে হত্যা করা যাবে না। নিজামীর সাথিরা তার আদর্শকে এদেশে বাস্তবায়ন করে এই হত্যার প্রতিশোধ নিবে।
এসময় উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘মাওলানা নিজামী বলেছেন নিজেদের দক্ষতা উন্নয়নের পাশপাশি ইসলামী সমাজ বিনির্মানের কাজ করে যেতে হবে। আপনাদের সবাইকে এক একজন নিজামী হতে হবে।’
জানাজার পুর্বে জনতার উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন পাবনা জেলা জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর মাওলানা জহুরুল ইসলাম। সেক্রেটারী অধ্যাপক আবু তালেব মন্ডল, সদর উপজেলা আমীর মাওলানা আব্দুল গাফফার খান, সাঁথিয়া উপজেলা আমীর মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস, নাটোর জেলা নায়েবে আমীর মীর নুরুল ইসলাম, ইসলামী ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান এবং আঞ্চলিক ও স্থানীয় জামায়াত ও শিবির নেতৃবৃন্দ।
প্রশাসন এলাকাবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে প্রথম জানাজা করার অনুমতি দিলেও কোনো প্রকার মাইক ব্যবহার করতে দেয়নি। পরবর্তী জানাযায় মাইক ব্যবহার শুরু হলেও প্রশাসন তা বন্ধ করে দেয়।
আলোকচিত্রী: ফখরুল ইসলাম
সূত্রঃ আরটিএনএন
সূত্রঃ আরটিএনএন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন