কারা কর্তৃপক্ষের নিয়ম মেনে কনডেম সেল থেকে সম্পূর্ণ ধীরস্থিরভাবেই হেটে ফাঁসির মঞ্চের দিকে যান বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী। মাত্র তিন মিনিটের ব্যবধানে জল্লাদ লিভার টেনে তার ফাঁসি কার্যকর করেন। মঙ্গলবার দিনগত মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
এর আগে স্বাভাবিকভাবে তিনি কনডেম সেলে গোসল, অজু ও নামাজ আদায় করেন। ফাঁসি হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি শুধু দোয়া দরূদ পড়েন। তাকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যেতে জল্লাদদের বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হয়নি।
কারা অধিদফতরের একাধিক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজ বুধবার নয়া দিগন্তকে ফাঁসি কার্যকরের শেষ মুহূর্তের ঘটনাগুলো বলতে গিয়ে নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর সাথে পরিবারের সদস্যরা কনডেম সেলের সামনে শেষ দেখা করেন। এরপরই কারা কর্মকর্তারা তাকে জানান, আপনি প্রস্তুত হতে থাকেন। জবাবে তিনি বলেন, আমি প্রস্তুত হচ্ছি। তিনি নিজেই গোসল সেরে নেন। গা মুছেন। অজু করেন। এরপর থেকে নামাজ আদায় করতে থাকেন। রাত ১১টা ৫৮ মিনিট পর্যন্ত তিনি নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত ও দোয়া দরূদ পড়েন। রাত ১২টা ২ মিনিটে ফাঁসি কার্যকরের জন্য সিনিয়র জেল সুপার ও কারা মসজিদের ইমাম মনির হোসেন ৮ নম্বর ফাঁসির সেলে হাজির হন। এসময় জল্লাদ রাজু, আবুল, মাসুম (১) ও মাসুমসহ (২) পাঁচ জল্লাদ উপস্থিত হন। তখন কারা কর্মকর্তা (সিনিয়র জেল সুপার) মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে বলেন, আদালতের রায় অনুযায়ী আপনার ফাঁসি এই মুহূর্তে কার্যকর করতে হবে। জবাবে তিনি শুধু বলেন, আমি প্রস্তুত। তখন তিনি দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করতে সিনিয়র জেল সুপারের কাছে অনুমতি চান। জেল সুপার তাকে নামাজ পড়ার অনুমতি দিলে তিনি নামাজ আদায় করে নেন।
তখন রাত ১২টা ৭ মিনিট। নামাজ শেষেই তিনি জল্লাদদের প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করার কথা জানান। তখন দুই জল্লাদ সেলে ঢুকে তাকে জমটুপি পরান এবং পেছনে দু হাত হ্যান্ডকাপ দিয়ে বেঁধে দেন। তিনি ধীরস্থিরভাবে হেঁটে ফাঁসির মঞ্চে চলে যান। মঞ্চে উঠার পরও তিনি কোরআন তেলাওয়াত ও দোয়া পড়তে থাকেন। ঠিক ১২টা ১০ মিনিটে সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির তার হাতে থাকা লাল রুমাল ফেলে দেন। সাথে সাথে জল্লাদ রাজু লিভার টান দিয়ে ফাঁসি কার্যকর করেন।
আজ কারাগারের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, কনডেম সেল থেকে বের করে মঞ্চে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত তিনি একদম চুপ ছিলেন। শুধু দোয়া দরূদ পড়েছেন। তিনি অত্যন্ত ভদ্র লোক এটা কারাগারে থাকাকালেও দেখা যেত। সুন্দরভাবে দোয়া কালাম পড়তে পড়তে ফাঁসির মঞ্চে যান।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, গোসল, অজু, নামাজ ও দোয়া দরূদ পড়া সব তিনি নিজে করেছেন। কোনো কথাই বলেননি।
ফাঁসি কার্যকরের সময়ের ব্যাপারে তিনি বলেন, সেল থেকে ফাঁসি কার্যকর হওয়া পর্যন্ত সময় লেগেছে ৩ মিনিট। ফাঁসির কার্যকরের জন্য কি ১২টা ১ মিনিট নির্ধারিত ছিল- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ফাঁসি দেয়ার সময় নির্ধারিত ছিলো না। তবে রাত ১২টার পর হবে এমন সিদ্ধান্ত ছিলো।
ফাঁসি হওয়ার আগে মাওলানা নিজামী কী খেয়েছেন জানতে চাইলে ওই কারা কর্মকর্তা বলেন, উনি সব সময় তাড়াতাড়ি খেয়ে নেন।
তবে অপর একটি সুত্র জানায়, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যাওয়া খাবারের মধ্যে তিনি শুধু একটু দুধ খেয়েছেন।
আজ বুধবার বিকেলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবিরের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, ১২টা ১০ মিনিটে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা সাক্ষাতের সময় উনি শুধু পারিবারিক বিষয় নিয়েই আলোচনা করেছেন বলে জানি। মাওলানা নিজামীর ব্যবহার্য মালামালের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার ব্যবহার্য মালামাল লকারে আটকানো আছে। তার বড় ছেলে যদি আসেন তাহলে আমি তার কাছেই সবগুলো মালামাল বুঝিয়ে দেবো।
ফাঁসি কার্যকরের রাতে কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন দেশে ছিলেন না। ভারপ্রাপ্ত আইজি প্রিজন কর্নেল ইকবাল হাসানের উপস্থিতিতে ফাঁসি কার্যকর করা হয়। তিনি রাত ১১টা ৫০ মিনিটে কারাগারে প্রবেশ করেন।
এসময় আরো উপস্থিত ছিলেন ঢাকার জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জন, ঢাকা বিভাগের ডিআইজি প্রিজন গোলাম হায়দার, জেলার নেছার আলম, ডেপুটি জেলার সর্বোত্তম দেওয়ান, কারা ডাক্তার ও পুলিশের ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তা।
ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর যা বলেছিলেন নিজামী
আমি মৃত্যু নিয়ে চিন্তিত নই। কারণ জীবন-মৃত্যু আল্লাহর হাতে। যার যেখানে মৃত্যু লেখা আছে সেখানেই হবে। নবী রাসুল (সা:) ও ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের উপর অতীতে জুলুম নির্যাতন ও মিথ্যা অপবাদ এসেছে। আজ আমরা যেহেতু ইসলামী আন্দোলনের কর্মী সেহেতু এ ধরনের জুলুম নির্যাতন আমাদের ওপর আসছে।
২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামের কাছে একথা বলেছিলেন। ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণার সময় মাওলানা নিজামী স্বাভাবিক ছিলেন। আদালতে তিনি কোনো কথা বলেননি। রায় ঘোষণার পর আদালতের অনুমতি নিয়ে আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম ও ছেলে ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন মাওলানা নিজামীর সাথে দেখা করেন।
সাক্ষাৎ শেষে অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম তখন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, মাওলানা নিজামী বলেছেন, একাত্তরে আমি এবং আমার দল কোনো অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম না। শুধুমাত্র জামায়াত দেশের সবচেয়ে বড় ইসলামী শক্তি এবং ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনে সমর্থন না দেয়ায় আমাকে এই বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। রায়ে যেসব ঘটনার কথা বলা হয়েছে আমি কখনো সেসব জায়গায় যাইনি। সরকার অন্যায়ভাবে আমাকে এই মামলায় সাজা দিয়েছে। এজন্য অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। তবে তা শান্তিপূর্ণভাবে করতে হবে।
তিনি আরো বলেছেন, রায়ে তার সম্পর্কে যা কিছু বলা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। তিনি জামায়াতের নেতা-কর্মীদের শান্ত থাকতে এবং কোনো প্রকার উস্কানিতে পা না দিতে বলেছিলেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন