বাংলাদেশ বার্তাঃ সমকালীন বাংলা ভাষার প্রধান কবি আল মাহমুদের ৮৩তম জন্মদিন বন্ধু স্বজন শুভানুধ্যায়ী ও বাংলা কবিতার অনুরাগিদের ফুলেল ভালোবাসার মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয়েছে। ১১ জুলাই বুধবার সকাল থেকেই কবির মগবাজারের বাসভবনে ভিড় জমান কবি ভক্ত আপনজনেরা । ফুল, কেক ও জন্মদিনের উপহারসামগ্রী নিয়ে তারা হাজির হন সেখানে। আল মাহমুদ ফাউন্ডেশনের আয়োজনে ঘরোয়া পরিবেশে প্রিয়জনদের কাছে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন দেশের প্রবীণ এ কবি।
আল মাহমুদ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সময় সম্পাদক সাঈদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে ফুল দিয়ে বরণ করা হয় প্রিয় কবিকে। তারপর সাঈদ চৌধুরী রচিত ‘কালজয়ী কবিতার স্রষ্টা আল মাহমুদ’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের মাধ্যমে শুরু হয় দিনব্যাপী আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম।
অনুষ্ঠানে কবি ও কথাসহিত্যিক আল মাহমুদকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বক্তব্য রাখেন কবি শাহীন রেজা, কবি জাহাঙ্গীর ফিরোজ, কবি সোলায়মান আহসান, কবি জাকির আবু জাফর, ড. ফজলুল হক তুহিন, রেডিও টুডের হেড অব প্রোগ্রাম আরজে টুটুল, সাংস্কৃতিক সংগঠক জাকীউল হক যাকি, কবি মাহমুদুল হাসান নিজামী, বাংলাদেশ কালচারাল একাডেমির চেয়ারম্যান শরীফ বায়জীদ মাহমুদ, বিসিএ সাধারন সম্পাদক আবেদুর রহমান, প্রচার সম্পাদক গল্পকার ইব্রাহিম বাহারী, কবি ফেরদৌস সালাম, কবি ফরিদ উদ্দীন ভূইয়া, কবি তৌফিক তপু, সাকিরা পারভীন সোমা, নূরুল আবছার, আলাউদ্দিন আদর, শিল্পী লিটন চৌধুরী, মোস্তফা কামাল মাহদি, মেহরাজ মিঠু, বাচিকশিল্পী মাহবুব মুকুল, সাংস্কৃতিক সংগঠক আবেদুর রহমান, আবৃতি শিল্পী ফারুক মো: ওমর প্রমুখ। কবিকে নিয়ে তাঁর বড় ছেলের স্ত্রী অনুভূতি প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন। এরপর কবির কবিতা থেকে আবৃত্তি ও গান পরিবেশন করা হয়। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন আল মাহমুদ ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারি কবি আবিদ আজম।
কবি জাকির আবু জাফর বলেন, বাংলা কবিতায় যাদের নিজস্ব কাব্য ভাষা আছে আল মাহমুদ তাদের একজন। তিনি একজন মৌলিক কবি। কবিতার জন্য গোটা জীবন কাটিয়েছেন। বলা যায়, কবিতা দিয়েই সাজিয়েছেন নিজের জীবনকে। কবিতাকে তিনি জীবনের একটি অপরিহার্যতা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এর মধ্য দিয়েই তিনি আনন্দ প্রেম ভালোবাসা খ্যাতি সবই পেয়েছেন। এর মধ্যেই তিনি স্বস্তি খুঁজেছেন। সুখ পেয়েছেন। সুখের সন্ধানে কবিতার জন্য তাঁকে দুঃখকেও সঙ্গী করতে হয়েছে।
কবি জাহাঙ্গীর ফিরোজ বলেন, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে আল মাহমুদ আজ অপরিহার্য বলে গণ্য হচ্ছেন। এদেশের মানুষ, প্রকৃতি, গৌরবের ইতিহাস সবই তাঁর কালজয়ী রচনায় স্থান পেয়েছে। তাঁর শ্রম সাধনা, কবিতার প্রতি ভালোবাসা তাঁকে আজ এ পর্যায়ে নিয়ে আসতে সাহায্য করেছে। তিনিও নিজেকে ইতিহাসের সমান্তরালে নিয়ে আসতে পেরেছেন সার্থকভাবে। কবিতা তাঁকে খ্যাতি যশ এনে দিয়েছে। তিনি কবিতাকে দিয়েছেন তাঁর অহঙ্কারে অলঙ্কারাবদ্ধ আবেগতাড়িত হৃদয়।
শরীফ বায়জীদ মাহমুদ বলেন, আল মাহমুদের মত কবি বার বার আসেন না। তাঁকে পেয়ে আমরা গর্বিত। আল মাহমুদকে নিয়ে আমরা একটি বায়োগ্রাফিকাল ডকুমেন্টরি তৈরী করছি।
শাহীন রেজা বলেন, আল মাহমুদ বেঁচে থাকবেন তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে। আমরা যারা আল মাহমুদকে ভালোবাসি, সাঈদ চৌধুরীর মত সবাই যেন তাঁকে নিয়ে কাজ করি।
আবেদুর রহমান বলেন, আসুন আমরা সকলে মিলে আল মাহমুদকে দেশের ষোল কোটি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে সুন্দর জাতি গঠনে ভূমিকা পালন করি।
জাকীউল হক যাকি বলেন, আল মাহমুদ আমাদের মাঝে বেঁচে থাকুন চির দিন। এটাই আজকের একান্ত কামনা।
আরজে টুটুল বলেন, আমরা যারা আল মাহমুদকে ধারন করি, আমাদেরকে কাজ করতে হবে, যাতে নতুন প্রজন্ম আল মাহমুদকে জানতে পেরে তাঁর সাহিত্য থেকে সমৃদ্ধ হয়।
ড. ফজলুল হক তুহিন বলেন, গভীর ভাবে পাঠ করার ফলে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, বাংলা ভাষায় ৫জন কবি আছেন বাংলার কবি, তাঁরা হলেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, জসীম ঊদ্দিন ও আল মাহমুদ। যারা বাংলার মানুষের কথা বলেছেন। তিনি সংস্কৃতি, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং আমাদের পার ভাঙ্গা নদীর কথা ও প্রকুতির কথা বলেছেন।
কবি সোলায়মান আহসান বলেন, আল মাহমুদ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন চলাকালে ভাষার ওপর কবিতা লিখে গ্রেফতারির মুখে পড়েন বলে তাকে এলাকা ছাড়তে হয়েছিল। সেই আল মাহমুদই আবার মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন সক্রিয়ভাবে। লেখায় লোকজ শব্দের ব্যবহারে অতুলনীয় হয়ে উঠেছে তার সৃষ্টিকর্ম। গণকণ্ঠ পত্রিকা সম্পাদনা করতে গিয়ে তিনি এক বছর কারাভোগ করেন।
অন্যান্য বক্তারা বলেন, আল মাহমুদ আধুনিক বাংলা কবিতার শহরমুখী প্রবণতার মধ্যেই ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ আবহ, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের জীবনপ্রবাহ এবং নর-নারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহকে পরম আন্তরিকতার সাথে তুলে এনেছেন তাঁর কবিতায়। বাংলা কবিতায় লোকজ ও গ্রামীণ শব্দের বুননশিল্পী কবি আল মাহমুদ নির্মাণ করেছেন এক মহিমান্বিত ঐশ্বর্য্যরে মিনার।
সভাপতির বক্তব্যে সাঈদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের প্রধান কবি আল মাহমুদ। খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প লেখক, শিশুসাহিত্যিক ও সাংবাদিক আল মাহমুদ আধুনিক বাংলা সাহিত্যকে নতুন আঙ্গিকে, চেতনায় ও বাক্ভঙ্গীতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। বাংলা কবিতাকে গৌরবোজ্জ্বল অবস্থানে নিয়ে এসেছেন তিনি। আমাদের কবিতায় যে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার ঊণ্মেষ ঘটেছে তিনিই তার নায়ক। দুই বাংলার অপরাজেয় এই কবিকে নিয়ে দেশ-বিদেশে গবেষণা হচ্ছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য আল মাহমুদের কবিতা । বইয়ের সংখ্যা শতাধিক। চল্লিশের বেশী কাব্যগ্রন্থ, বিশের অধিক উপন্যাস এবং দশটির মতো গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার শিশু সাহিত্য কিংবা কিশোর কবিতা বাংলা সাহিত্যে দুর্লভ। আট খণ্ডের রচনা সমগ্রও পাঠকের হৃদয় ছুঁয়েছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এবং আল মাহমুদ যেন এক ও অভিন্ন। তার এই বিশাল সৃষ্টিকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ঠিকমত তুলে ধরতে পারলে তিনি নোবেল প্রাইজ পেতে পারেন। বুকার প্রাইজ বা নোবেল প্রাইজ যারা বিবেচনা করেন, যারা বিচারক হন তারা যেন আল মাহমুদদের সাহিত্যের গভীরে যেতে পারেন সে জন্য ইংরেজি ভাষায় আল মাহমুদকে তুলে ধরতে হবে।
সকাল থেকে রাত অবধি চলে সোনালী কাবিনের শুভেচ্ছা জানানোর পালা। এ সময় তরুণ প্রজন্মের উচ্চাশ ছিল উল্লেখ করার মতো। বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্য সংগঠনের প্রতিনিধিদের প্রাণবন্ত উপস্থিতি এক উৎসবময় পরিবেশের সৃষ্টি করে।
কবিকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়েছেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন-ডিইউজে’র সভাপতি কাদের গনি চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক মো: শহিদুল ইসলাম, সিনিয়র সহ-সভাপতি বাছির জামাল, কোষাধ্যক্ষ গাজী আনোয়ার সহ বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার নেতৃবৃন্দ।
দিনব্যাপী কবিকে শুভেচ্ছা জানানো সংগঠনের মধ্যে রয়েছে সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র, বাংলাদেশ কালচারাল একাডেমি, নবধারা, ফুলকুঁড়ি আসর, সাহিত্য পত্রিকা নতুনমাত্রা, সময়ের জানালা, বাংলাদেশ প্রজন্ম সাহিত্য পরিষদ, দৈনিক যুগান্তর, রেডিও টুডে, সারেগামা অ্যাকাডেমি, চন্দ্রকথা, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি সাহিত্য ফোরাম, রেডিও টুডে, প্রাইম ভিশন অনলাইন টেলিভিশন, কবি এবং কবিতাসহ বিভিন্ন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে কবির সুস্বাস্থ ও দীর্ঘায়ূ কামনা করে দোআ মুনাজাতের মাধ্যমে।
প্রায় নির্বাক কবি আল মাহমুদ জন্মদিনের শুভেচ্ছার জবাব দিতে গিয়ে অনেক চেষ্টা করেও কিছুই বলতে পারলেন না। অস্ফুটভাবে শুধু বললেন, ‘বন্ধুগণ শুভেচ্ছা’।
অনুষ্ঠানে বক্তারা ১১ জুলাই আল মাহমুদের জন্মদিনটিকে বাংলা কবিতা দিবস ঘোষণারও দাবি জানান। তারা বলেন, আল মাহমুদের কবিতায় দেশমাতৃকার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও মানবিক আবেগ উঠে এসেছে। তার এ সাহিত্যকর্মকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিতে হবে। সেই সঙ্গে একজন ভাষা সংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আল মাহমুদকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়ারও দাবি জানান তারা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন