আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেলো শেষে/হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে। নদীর কাছে গিয়েছিলাম আছে তোমার কাছে/ হাত দিও না আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে।
অথবা
আম্মা বলেন পড়রে সোনা আব্বা বলেন মন দে/ পাঠে আমার মন বসে না কাঁঠালচাঁপার গন্ধে। /আমার কেবল ইচ্ছে করে নদীর ধারে থাকতে/বকুল ডালে লুকিয়ে থেকে পাখির মতো ডাকতে। /সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে কর্ণফুলীর কূলটায়/ দুধভরা ওই চাঁদের বাটি ফেরেশতারা উল্টায়।
কিংবা
গ্লোবের পেটে কান লাগিয়ে খোকন শোনে কান্না/ বিশ্ব গোলক ফুঁপিয়ে ওঠে আর পারি না, আর না।/ মানুষ নামের বিজ্ঞানীরা আমায় নিয়ে খেলছে/ আমার সাগর পাহাড় নদী রোলার দিয়ে বেলছে। এমনই কালজয়ী কবিতার স্রষ্টা আল মাহমুদ। এমনই আনন্দঘন পঙ্ক্তির নির্মাতা তিনি। তার কবিতা বাংলাদেশের হৃদয় থেকে বেড়ে ওঠা বৃক্ষের মতো। যে বৃক্ষের পাতায় ফুলে ফলে লেগে আছে এ দেশেরই মাটির গন্ধ।
আজ আল মাহমুদের ৮২তম জন্মদিন। ৮৩ বছরে পা রাখলেন তিনি। আজ অন্য রকম প্রাণের স্পন্দনে দুলছে বাংলা কবিতার সময়। তার জন্ম ১১ জুলাই ১৯৩৬।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মৌড়াইলে মোল্লা বাড়িতে জন্মেছেন তিনি। তিতাশ নদীর পাড়েই তার বেড়ে ওঠা। কিশোরকালেই কবিতার ঘূর্ণিতে দুলে উঠেছেন তিনি। ক্রমে তিনি হয়ে উঠেছেন কবিতা পৃথিবীর পথিক। নির্মাণ করেছেন এক নিজস্ব কাব্যজগৎ। তার স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর তাকে অমর করে তুলেছে বাংলা কবিতায়। বিষয় বৈচিত্র্যে তিনি জীবনানন্দ ও জসীম উদ্দীনের কাছাকাছি। কিন্তু তিনি তাদের কারো পথে নয়। তিনি গেলেন তার নিজস্ব পথে। তার একান্ত পৃথিবীতে। বাংলা কবিতায় এখন তিনি আল মাহমুদ। তিনি অন্য রকম কবিতার রূপকার।
তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তর। দ্বিতীয় বই কালের কলস। এ দু’টি বই লিখেই তার ভাগ্যে জড়িয়ে গেলো বাংলা একাডেমি পুরস্কার। তৃতীয় বইটি সোনালী কাবিন। যে বই পৃথিবীর আলোয় এসে আল মাহমুদকে দিয়েছে খ্যাতির আশ্চর্য প্রদীপ। কবি হিসেবে একরকম রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন তিনি। তারপর তিনি লিখলেন মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো, অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না, বখতিয়ারের ঘোড়া, আরব্য রজনীর রাজহাঁস, এক চক্ষু হরিণ, মিথ্যাবাদী রাখাল, দোয়েল ও দয়িতা, দ্বিতীয় ভাঙ্গন, নদীর ভিতরে নদী, না কোনো শূন্যতা মানি না, বিরামপুরের যাত্রী, বারুদগন্ধি মানুষের দেশ, সেলাই করা মুখ, তোমার রক্তে তোমার গন্ধেসহ ত্রিশোর্র্ধ্ব কবিতার বই। পাশাপাশি লিখেছেন সাড়াজাগানো উপন্যাস : কাবিলের বোন, উপমহাদেশ, ডাহুকী, যেভাবে বেড়ে উঠি, আগুনের মেয়ে, যমুনাবতী, চেহারার চতুরঙ্গ, যে পারো ভুলিয়ে দাও, ধীরে খাও অজগরীসহ পঁচিশটির বেশি উপন্যাস।
ছোটগল্পের জগতেও অপ্রতিদ্বন্দ্বী তিনি। তার পানকৌড়ির রক্ত, সৌরভের কাছে পরাজিত, গন্ধবণিক, ময়ূরীর মুখ, নদীর সতীন তুমুল আলোচিত আলোড়িত গল্পগ্রন্থ। তার আত্মজীবনী বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ একটি আশ্চর্য জীবনালেখ্য। দিন যাপন, কবির আত্মবিশ্বাস, নারী নিগ্রহ, সময়ের সাক্ষী, সাহসের সমাচার, কবির কররেখা, দশ দিগন্তে উড়াল প্রবন্ধের বই। তার গদ্য কেমন সুখপাঠ্য এ বইগুলো তার সাক্ষী। ছোটদের জন্য তার রচনা পাখির কাছে ফুলের কাছে, একটি পাখি লেজ ঝোলা, মোল্লাবাড়ির ছড়া কি আনন্দময় গ্রন্থ।
সদ্যস্বাধীন দেশে সাহসী দৈনিক গণকণ্ঠের সম্পাদক ছিলেন তিনি। ছিলেন দৈনিক কর্ণফুলীর সম্পাদক। সম্পাদনা করেছেন কাফেলা, আফগানিস্তান আমার ভালোবাসা, আহত কোকিল।
সাহিত্যকর্মের জন্য পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, জয়বাংলা পুরস্কার, হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার, জীবনানন্দ স্মৃতি পুরস্কার, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার, নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক, সুফী মোতাহের হোসেন স্বর্ণপদক ইত্যাদি।
আল মাহমুদ লিখেছেন ক্রমাগত। লিখেছেন নানান বিষয়। সব কিছু ছাপিয়ে তিনি একজন কবি। তার কবিতায় বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের ঘ্রাণ। প্রকৃতি ও প্রেমের গুঞ্জন। নদী ও নারীর রহস্যময় বহমানতা বিঁধে আছে। কবিতার জায়গায় আল মাহমুদ এখন কিংবদন্তি। সব মিলিয়ে আল মাহমুদ বাংলা ভাষার একজন অপরিহার্য কবি।
বাঙালি চাষি পরিবারের মুখের ভাষাকে তিনি কবিতায় আধুনিক করে তুলেছেন। গ্রামীণ শব্দভাণ্ডারকে করেছেন নাগরিক। প্রেম প্রকৃতি ও প্রার্থনায় তিনি দিয়েছেন বিশিষ্টতা। বিশ্বাসের আনন্দে তিনি কবিতাকে জাগিয়ে দিয়েছেন অন্য মাত্রায়। ফলে ব্যক্তি আল মাহমুদের নিন্দুক যারা তারাও কবি আল মাহমুদের প্রেমিক।
আজ জন্মদিন ঘিরে আসর বসবে তার বাসায়। কবিতা জগতের মানুষ, সাহিত্যপ্রেমী, সংবাদজগতের কর্মীরা, কবির শুভানুধ্যায়ী, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক সংগঠনের কর্মীরা আসবেন কবির বাসায়। কারো হাতে থাকবে ফুলের তোড়া। কারো হাতে মিষ্টির প্যাকেট আবার কারো হাতে থাকবে কবির জন্য উপহার। সব মিলিয়ে ১১ জুলাই বাংলা কবিতার এক আনন্দের দিন। আল মাহমুদ, শুভ জন্মদিন।
@বাশের কেল্লা@
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন