বাংলাদেশ বার্তাঃ বিশ্বাসের নাম ঈমান। এ বিশ্বাস আল্লাহর প্রতি। এ বিশ্বাস রাসূলের প্রতি। তাওহিদ রিসালাত ও আখিরাতই বিশ্বাসের অন্যতম মৌল বিষয়। আল্লাহ মানুষকে হেদায়েত করার জন্য পথ প্রদর্শক হিসেবে যুগে যুগে নবী ও রাসূল পাঠিয়েছেন। হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে হযরত মুহাম্মদ স. পর্যন্ত এক লাখ চব্বিশ হাজার মতান্তরে দুই লাখ চব্বিশ হাজার নবী ও রাসূলের আগমন ঘটেছে। হযরত মুহাম্মদ স. শেষ নবী এবং তারপর আর কোনো নবীর আগমন ঘটেনি বা ঘটবে না। আল্লাহ প্রত্যেক নবী বা রাসূলের প্রতি অহি বা প্রত্যাদেশ পাঠিয়েছেন। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনে মুহাম্মদ স.কে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে - (হে নবী!) আমি আপনার প্রতি ওহি পাঠিয়েছি, যেমন করে ওহি পাঠিয়েছিলাম নূহের প্রতি এবং তার পরবর্তী নবী-রাসূলদের প্রতি। আর ওহি পাঠিয়েছি ইব্রাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তার সন্তানদের প্রতি। আর আমি দাউদকে দান করেছি যাবুর কিতাব। এ ছাড়া এমন রাসূল পাঠিয়েছি যাদের ইতিবৃত্ত পূর্বে আপনাকে শুনিয়েছি এবং এমনও অনেক রাসূল পাঠিয়েছি যাদের বৃত্তান্ত আপনাকে শুনাইনি। আর আল্লাহ মূসার সঙ্গে কথোপকথন করেছেন সরাসরি। সুসংবাদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী রাসূলদের পাঠিয়েছি, যাতে রাসূলদের পরে আল্লাহর প্রতি অপবাদ আরোপ করার মতো কোনো অবকাশ মানুষের জন্য না থাকে। আল্লাহ পরাক্রমশালী বিজ্ঞানময়। আল্লাহ আপনার প্রতি যা নাজিল করেছেন তা তিনি জেনে শুনেই নাজিল করেছেন। আল্লাহ নিজেই এর সাক্ষী এবং ফিরেশতারাও সাক্ষী। আর সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট। (সূরা নিসা : ১৬৩-১৬৬)। এ সবের প্রতি বিশ্বাসের প্রতিধ্বণিই ঈমান।
যার ঈমান আছে তিনিই মুমিন। নবী রাসূলদের প্রতি ঈমান আনা প্রতিটি মুমিনের জন্য অবশ্য কর্তব্য। সব নবী রাসূলকে আল্লাহ দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন মানুষকে হেদায়েত করার জন্য। সব নবীর দাওয়াত ছিল অভিন্ন। তাদের কাউকে অস্বীকার করা ঈমান না থাকার শামিল। পবিত্র কুরআনের আগে হযরত দাউদ আ. এর উপর যাবুর, হযরত মূসা আ.এর উপর তাওরাত এবং হযরত ঈসা আ. এর উপর ইঞ্জিল কিতাব নাজিল হয়েছিল। তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর কুরআন নাজিলের পর অন্যসব আসমানী কিতাবের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। যে কারণে ওইসব কিতাব আমল করা যাবে না।
আজকের পৃথিবী কত আনন্দময়। কত আড়ম্বরপূর্ণ। আমাদের জীবন ও চালচলন কত জৌলুসপূর্ণ। আমরা কত আরামপ্রিয়। সুন্দর বাড়িতে থাকি। ভালো খাবার খাই। নরম বিছানায় ঘুমাই। ফ্যান-এসি ছাড়া থাকতে পারি না। একটু কষ্ট সহ্য হয় না। যার উছিলায় আল্লাহ তায়ালা এ আসমান জমিন সৃষ্টি করেছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সেই মহামানব রাসূলে আরাবী স. এর জীবনযাপন কেমন ছিল তা কি আমরা কখনো জেনেছি বা জানার চেষ্টা করেছি? হযরত আয়েশা রাজিআল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, হযরত মুহাম্মদ স. এর পরিবার পরিজন পরপর দুই বেলা জবের রুটি দ্বারা পরিতৃপ্ত হননি। এ অবস্থায়ই রাসূলুল্লাহ স. এর ইন্তেকাল হয়েছে। (বুখারী ও মুসলিম)। অর্থাৎ একবেলা খেয়েছেন তো আরেক বেলা না খেয়ে থেকেছেন। এই ছিল বিশ্বনবীর ঘরের অবস্থা।
হযরত ওমর রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, একদিন আমি রাসূলুল্লাহ স. এর কাছে গমন করে দেখলাম, তিনি একটি খেজুর পাতার চাটাইয়ের উপর শায়িত আছেন। চাটাইয়ের উপর কোন চাদর বা বিছানা ছিল না। তাঁর পবিত্র দেহে চাটাইয়ের দাগ পড়ে গিয়েছিল। তিনি ঠেস দিয়েছিলেন খেজুরের আঁশ ভর্তি একটি চামড়ার বালিশে। আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি আল্লাহর কাছে দুআ করুন তিনি যেন আপনার উম্মতকে স্বচ্ছলতা দান করেন। পারস্য ও রোমের লোকদের স্বচ্ছলতা প্রদান করা হয়েছে। অথচ তারা কাফির, আল্লাহ তায়ালার ইবাদত বিমুখ। তার এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ স. বললেন, হে খাত্তাবের পুত্র ওমর! তুমি কি এখনো এ ধারণা রাখছ? তারা তো এমন সম্প্রদায়, যাদের পার্থিব জীবনেই নিয়ামত দান করা হয়েছে। অন্য এক বর্ণনাতে রয়েছে, তুমি কি এতে খুশি নও, তারা দুনিয়া লাভ করুক আর আমাদের জন্য থাকুক পরকাল (বুখারী ও মুসলিম)।
হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, নবী করিম স. ইরশাদ করেছেন, হে আল্লাহ! আপনি আমাকে মিসকিন অবস্থায় জীবিত রাখুন। মিসকিন অবস্থায় মৃত্যু দিন এবং মিসকিনদের সঙ্গে হাশর করুন। হযরত আয়েশা রাজিআল্লাহু আনহা বললেন, তা কেন ইয়া রাসূলুল্লাহ! রাসূলুল্লাহ স. বললেন, মিসকিনগণ ধনী লোকদের থেকে ৪০ বছর আগে বেহেশতে প্রবেশ করবে। হে আয়েশা! কোনো মিসকিনকে তোমার দরজা থেকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিও না। অন্তত খেজুরের একটি টুকরা হলেও তাকে দিয়ে দিও। হে আয়েশা! মিসকিনকে ভালোবাসবে এবং তাকে নিজের কাছে স্থান দিবে। তাতে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামত দিবসে তোমাকে নিজের কাছে স্থান দান করবেন (তিরমিজি)।
গরিব-মিসকিনকে কাছে টানতে মহানবীর স. নিদের্শ রয়েছে। অসহায়কে ভালোবাসতে রাসূলুল্লাহ স. এর পক্ষ থেকে বিশেষ উপদেশ এসেছে। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ স. ইরশাদ করেছেন, যখন তোমাদের কেউ এরূপ লোককে দেখে যাদের ধন-সম্পদ, স্বাস্থ্য-সুস্থতা সব দিক দিয়ে তোমাদের তুলনায় অনেকগুণ বেশি দান করা হয়েছে। তখন সে যেন তার নিজের তুলনায় নি¤œপর্যায়ের লোকদের দিকে লক্ষ্য করে। (বুখারী ও মুসলিম)।
কেউই পরিপূর্ণ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না তার বিবেক ও প্রবৃত্তি মহানবী স. এর আনীত জীবন ব্যবস্থার অনুগামী হয়। অতএব, আমরা হুজুর স. এর সুন্নাতের তাবেদারির উপর অটল ও অবিচল থাকি। তিনি যেসব নিষেধ করেছেন সেসব থেকে পুরোপুরি দূরে থাকি ও মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য মৃত্যু পর্যন্ত সার্বক্ষণিক আপোসহীন সংগ্রাম ও চেষ্টা চালিয়ে যাই। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, যারা আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জনে কঠোর চেষ্টা ও সাধনা করবে, আমি তাদের আমার দিদার লাভের যাবতীয় পন্থাগুলো দেখিয়ে দেব। চেষ্টা বান্দার দায়িত্ব সাফল্য আল্লাহর জিম্মায়। সুতরাং একদিকে নফস বা কু-প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করা অন্যদিকে ইবাদত- বন্দেগি ও সৎ কাজগুলো বাস্তবায়নে সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া প্রত্যেক মুমিন বান্দার প্রতি আত্যাবশ্যক। পবিত্র কুরআন সুন্নাহ্ এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশন রয়েছে।
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে পাক স. বলেন, দোজখ অবৈধ কামনা-বাসনা ও অবাঞ্ছিত লোভ-লালসার দ্বারা বেষ্টিত এবং জান্নাত দুঃখ-দৈন্য ও কষ্ট-ক্লেশ কার্যাবলীর দ্বারা আবৃত। (বুখারী ও মুসলিম)। হযরত জুবায়ের বিন নুফাই রা. হতে মুরসাল সূত্রে বর্ণিত- হযরত রাসূলে পাক স. বলেন, আমার কাছে এই মর্মে ওহি আসেনি, আমি সম্পদ সঞ্চয় করব এবং আমি একজন ব্যবসায়ী হব বরং আমার কাছে এই মর্মেই ওহি এসেছে যে, হে রাসূল! আপনি আপনার প্রতিপালকের পবিত্রতা ঘোষণা করুন এবং তার সিজদাকারী হোন, অর্থাৎ ইবাদত করুন। আর আজীবন সর্বকাজে তার দাসত্ব অবলম্বন করুন। (রায়হাকী)।
হযরত হাসান রা. হতে মুরসাল সূত্রে বর্ণিত, হযরত রাসূলে পাক স. বলেন, দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা সমস্ত অন্যায়ের মূল। (রায়হাকি)। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে মরফু সূত্রে বর্ণিত, হযরত রাসূলে পাক স. বলেন, যখন মানুষ মারা যায় তখন ফেরেশতারা জিজ্ঞাসা করেন, এ লোক কি কি আমল (আল্লাহ পাকের নিকট) পেশ করেছে। কিন্তু সমাজের লোক জিজ্ঞাসা করে, এ লোক কি কি সম্পদ বা লোকজন রেখে গেছে, (বায়হাকি)। হযরত নাফে (রহ.) বলেন, একদিন হযরত ইবনে ওমর রা. কাবাগৃহের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর ঘর! তুমি কত বড় এবং তোমার সম্মান কত বেশি। কিন্তু একজন মুমিন ব্যক্তির মর্যাদা আল্লাহ তায়ালার কাছে তোমার চেয়েও অনেক বেশি। (তিরমিযি)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, মহানবী স. ইরশাদ করেন, প্রত্যেক মুমিন ব্যক্তির জন্য আসমানে দুটি দরজা আছে। একটি দিয়ে তার নেক আমল আসমানে উঠে। আর অপরটি দিয়ে আসমান থেকে তার রিজিক নাজিল হয়। যখন সে ইন্তেকাল করে, তখন দুটি দরজাই তার জন্য ক্রন্দন করে।
তাকওয়া শব্দের অর্থ বিরত থাকা, বেঁচে থাকা, ভয় করা, নিজেকে রক্ষা করা, আত্মসংযমশীল হওয়া। এককথায় বলতে গেলে আত্মশুদ্ধি বা খোদাভীতি। ইসলামী পরিভাষায়, আল্লাহর ভয়ে যাবতীয় অন্যায়, অত্যাচার ও পাপকাজ থেকে বিরত থাকাকে তাকওয়া বলা হয়। আর যিনি তাকওয়া অনুযায়ী জীবন ধারণ করেন তাকে বলা হয় মুত্তাকী। তাকওয়া অর্জনের প্রধান উপায় হলো আত্মশুদ্ধি। আত্মশুদ্ধি হলো অন্তর সংশোধন, খাঁটি করা, পাপমুক্ত করা। আল্লাহ তায়ালার স্মরণ, আনুগত্য ও ইবাদত ব্যতীত অন্য সমস্ত কিছু থেকে অন্তরকে পবিত্র রাখাকে আত্মশুদ্ধি বলা হয়।
মানুষের আত্মিক প্রশান্তি, উন্নতি ও বিকাশ সাধনের জন্যও আত্মশুদ্ধির গুরুত্ব অপরিসীম। আত্মশুদ্ধি মানুষকে বিকশিত করে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আত্মাকে পূতপবিত্র রাখল সেই সফলকাম হবে, আর সে ব্যক্তিই ব্যর্থ হবে যে নিজেকে কলুষিত করবে। (সূরা শাম্স: ৯-১০)। মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা শু-আরার ৮৮-৮৯ নম্বর আয়াতে উল্লেখ করেছেন, সেদিন ধনসম্পদ কোনো কাজে আসবে না আর না কাজে আসবে সন্তান-সন্তুতি। বরং সেদিন সে ব্যক্তিই মুক্তি পাবে, যে আল্লাহর কাছে বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ নিয়ে আসবে। মহান আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সামনে দ-ায়মান হওয়ার ভয় করবে ও কুপ্রবৃত্তি হতে বেঁচে থাকবে, তার স্থান হবে জান্নাতে। (সূরা নাযিয়াত: ৪০-৪১)। আল্লাহ তায়ালার কাছে তাকওয়ার গুরুত্ব অত্যধিক। তাই ইরশাদ করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানিত সেই ব্যক্তি যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তাকওয়াবান। (সূরা হুজরাত: ১৩)। মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে আরও ইরশাদ করেন, হে মুমিনগণ! যদি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর, তবে আল্লাহ তোমাদের ন্যায়-অন্যায় পার্থক্য করার শক্তি দেবেন, তোমাদের পাপ মোচন করবেন এবং তোমাদের ক্ষমা করবেন। আর আল্লাহ অতিশয় মঙ্গলময়। (সূরা আনফাল: ২৯)। রাসূলুল্লাহ স. ইরশাদ করেন, জেনে রেখ; শরীরের মধ্যে একটি গোস্ত পি- রয়েছে, যদি তা সংশোধিত হয়ে যায়, তবে গোটা শরীরই সংশোধিত হয়। আর যদি কলুষিত হয়ে যায় তবে গোটা শরীরই কলুষিত হয়ে যায়। মনে রেখ, তা হল কলব বা অন্তর। (বুখারী ও মুসলিম)। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করে সত্যিকারের মুমিনের জিন্দেগী ধারণ করার তৌফিক দান করুন, আমিন।
[ লেখক: কবি ও গবেষক; প্রফেসর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন