ছবিটির ইনসেটে যে বাচ্চা মেয়েটিকে দেখতে পাচ্ছেন সে আমার মেয়ে, আমার রাজকন্যা । সুন্দর ফুটফুটে মায়াবী চেহারার আমার রাজকন্যার বয়স মাত্র ৮ বছর। চঞ্চল নিস্পাপ এই রাজকন্যার জন্মের পর ওর মা খুব আদর করে ওর নাম রেখেছিল নুসরাত জাহান নুশু। আদর করে আমরা সবাই ওকে নুশু বলেই ডাকতাম ।
মেয়েটিকে নিয়ে অনেক বড় আশা ও স্বপ্ন দেখেছিলাম, স্বপ্ন দেখেছিলাম মেয়েটিকে নূরানি মাদ্রাসায় পবিত্র কোরআন এবং ধর্মিয় শিক্ষা দিয়ে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিব। জেডিসি, জিএসসি, এসএসসি, এইচএসসি শেষ করিয়ে ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার বানাবো । দেশ ও জাতির সেবা করবে একদিন বড় হয়ে । সাধারন মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের সুখদুঃখ ভাগ করে নিয়ে তাঁদের কাঁধের সাথে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যাবে আমার রাজকন্যা ।
কিন্তু বিঁধি বাম !
আমার সমস্ত স্বপ্নকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিল আমারই দেশের আমার কিছু ভাই ও ছেলেরা । তিনদিন আগে আমার মেয়েটি হারিয়ে যায়, এমন কোন জায়গা বাকি নেই যেখানে আমার রাজকন্যাকে খুজিনি। সারাদিন খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে ক্লান্ত শরীরে ঘরে ফিরে দেখতাম ওর মা তখনও হাউমাউ করে কাঁদছে । নিজ গর্ভের সন্তানকে হারিয়ে বেচারি পাগলপ্রায়। নিজ পেটের সন্তানকে হারানোর বেদনা তাঁরা বুঝবেনা যারা আমার মেয়েকে আমার কাছ থেকে কেঁড়ে নিয়েছে। কারন তাঁরা তখনও সন্তানের বাবা হতে পারেনি, তাঁরা তখনও বাবার বয়সে পৌঁছায়নি । একদিন হয়তো বুঝবে তাঁরা সন্তান হারানোর বেদনা কতটা কষ্টের ।
তিনদিন পর হটাত এলাকায় গুঞ্জন শুনছি পার্শ্ববর্তী খালের উপর ব্রিজের নিচে এক রাজকন্যার বস্তাবন্ধি লাশ পাওয়া গিয়েছে । কথাটা শুনেই বুকের এক কোনে তীব্র ব্যথা অনুভব করলাম, ওর মা'কে নিয়ে দৌড়ে ছুটলাম সেই ব্রিজের কাছে । যাবার পথে বিধির কাছে বারবার ফরিয়াদ করছিলাম -
" হে আল্লাহ, ওই বস্তাবন্ধি লাশটা যেন আমার মেয়ের না হয় " ।কিন্তু এখানেও বিঁধি বাম !
ঘটনাস্থলে পৌঁছে গিয়ে দেখি ব্রিজের উপর শোয়ানো অবস্থায় বস্তা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে একটি মৃতদেহকে।ধীরে ধীরে মৃতদেহের উপর থেকে বস্তাটা সরিয়ে আঁতকে উঠি ভয়ে।বস্তায় ঢাকা বীভৎস এক বাচ্চার লাশ। এতটাই নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়েছে যে তাঁর চেহারা দেখে চেনার কোন উপায় নেই।পাঠক বিশ্বাস করুন আপনিও সেই বীভৎস মৃতদেহের চেহারার দিকে তাকালে ভয়ে আঁতকে উঠবেন ।
এবার আরেকটূ ভালো করে তাকালাম মৃতদেহটির দিকে - কিন্তু এ কি !
এ যে আমারই রাজকন্যা !
এই তো আমার মিষ্টি মায়াবী রাজকন্যা নুশু, এই তো সেই নুশু জন্মের পর যাকে দেখে আমি প্রথম হেসেছিলাম, যাকে পেয়ে আমি পৃথিবীটা আমার হাতের মুঠোয় পাওয়ার অনুভূতি পেয়েছিলাম।ওর জন্মের দিন দেখেছিলাম ওর মায়ের গর্ভ থেকে এক চাঁদমুখ পুতুল বেরিয়েছে, আর আজ এ কি অবস্থা আমার সেই পুতুলটার ? যাকে আমি আর ওর মা কোলে পিঠে করে বড় করেছি, যাকে মাটিতে রাখিনি পিঁপড়া খাবে বলে আর মাথায় রাখিনি উকুনের ভয়ে সেই নুশু আজ বীভৎস অবস্থায় লাশ হয়ে শুয়ে আছে !! এসব ভাবতে ভাবতে কখন জ্ঞান হারালাম টেরই পাইনি।ওর মায়ের অবস্থাটা না হয় নাইবা বললাম। জ্ঞান ফিরে আসার পর আমি এখনও একটিবারের জন্যেও কাঁদতে পারিনি। আমি কাঁদতে ভুলে গেছি।প্রতিজ্ঞা করেছি আমি আর কাঁদবো না । শুধু এই দেশ, এই জাতি, এই জাতির কর্ণধারদের কাছে আমার কিছু প্রশ্ন রেখে গেলাম -
* কি অপরাধ করেছিলো আমার এই ছোট্র রাজকন্যা ? যেই অপরাধের শাস্তি হিসেবে আমার ৮ বছরের বাচ্চাটিকে এতটা নির্মম ভাবে হত্যা করা হল ?
* আমার রাজকন্যার কোন ড্রেসটা খারাপ ছিল যার শাস্তি হিসেবে আমার নিষ্পাপ বাচ্চা মেয়েটাকে ধর্ষিত হতে হল ?
* কি অপরাধ ছিল আমার এই অবুঝ রাজকন্যার যার শাস্তি হিসেবে ওকে তুলে নিয়ে ধর্ষন শেষে নির্মম ভাবে হত্যা করে বস্তায় বন্ধী করে পানিতে ফেলে দেওয়া হল ?
* দেশের কর্ণধার, দেশের সরকার, দেশের পরিচালকরা বরাবরই বলেন এই দেশ উন্নয়নশীল দেশ। এই দেশ নারী অধিকারের দেশ, এই দেশের নারীরা অধিক নিরাপদ । তবে কেন আজ আমার রাজকন্যা ধর্ষনের শিকার হল ? কেন আজ তাঁকে হত্যা করা হল ?
* নিজ মেয়ের বীভৎস মৃতদেহ কাঁধে বয়ে বেড়াবার জন্যেই কি এই দেশটা স্বাধীন করেছিলাম ?আমি এই প্রশগুলির জবাব চাই, এই প্রশ্নগুলির জবাব আপনাদেরকে দিতেই হবে।
আপনাদের জানা না থাকলে যারা জানেন তাঁদের থেকে এই প্রশ্নগুলির উত্তর আদায় করতে হবে। আমার মেয়ের হত্যাকারীদের বিচার করতে হবে, কঠিন শাস্তি দিতে হবে, ওকে হত্যার প্রতিবাদ করতে হবে।
যদি কেউ তা না করেন তবে আমি অভিশাপ দিচ্ছি আপনার কন্যাও একদিন এমন পরিস্থিতির শিকার হবেন, আপনার বোন ও একদিন ওই কুকুরদের খাদ্যে পরিনত হবে।
এবং হতেই হবে-
কারন এই গুনে ধরা সমাজের মানুষগুলো মনুষ্যত্ব হারিয়েছে সে অনেক আগে।
এদের পঁচা গন্ধটা এখন ছড়াচ্ছে মারাত্মক ভাবে, কুকুর গুলোর তীব্র লালসা থেকে বাদ পড়েনি আমার ৮ বছরের রাজকন্যা নুশু, কাল বাদ পড়বেনা আপনার রাজকন্যা।
- লেখাটি নুসরাত জাহান নুশুর বাবার কল্পনার সাথে মিল রেখে লেখা ।
মেজর ডালিমের টাইমলাইন থেকে
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন