বাংলাদেশ বার্তাঃ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের আসানসোল এলাকায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা থামিয়ে ভারতীয়দের কাছে হিরো বনে গেলেন মসজিদের ইমাম মাওলানা ইমদাদুল্লাহ রাশিদি।
নিজের ১৬ বছরের ছেলে মোহাম্মদ সিবগাতউল্লাহ রাশিদিকে কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদীরা নৃশংসভাবে হত্যা করার পর মাইকে এলান দিয়ে দাঙ্গা থামানোর ঘটনায় ভারতজুড়ে মাওলানা ইমদাদুল্লাহ রাশিদি সবার চোখে মুসলিমদের হিরো হিসেবে অনন্য নজির স্থাপন করেছেন।
ঘটনার সূত্রপাত হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে হয়।হিন্দু-মুসলিম সংঘাতের জের ধরে পুরো এলাকা থমথমে। সবকিছু বন্ধ। চারিদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে নানা গুজব। এরই মধ্যে খবর এলো – মসজিদের ইমাম মুহাম্মদ ইমদাদুল্লাহর নিখোঁজ ছেলের লাশ পড়ে আছে স্থানীয় হাসপাতালে। তাকে বলা হলো হাসপাতালে গিয়ে লাশ সনাক্ত করতে।
ইমাম মুহাম্মদ ইমদাদুল্লাহ হাসপাতালে গেলেন। নিজের ছেলের ক্ষত-বিক্ষত লাশ সনাক্ত করলেন তিনি।তার বুক চিরে কলজে বের করে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলেছে দাঙ্গাবাজরা। নখ উপড়ে নেয়া হয়েছে। ঘাড়ে ধারালো অস্ত্রের কোপ।নিজের সন্তানের সঙ্গে এমন পাশবিক আচরণে যেকোন বাবাই আঁৎকে উঠবেন। খুন চড়ে যাবে মাথায়। কিন্তু না, ইমাম শান্ত রইলেন।
এদিকে, ক্ষত-বিক্ষত লাশটি যখন মহল্লায় আনা হলো, পরিস্থিতি হয়ে উঠলো আরও অগ্নিগর্ভ। এলকার মানুষ ইমাম সাহেবের পূত্রের মৃত্যুর ঘটনায় ফুঁসে উঠলেন। দাঙ্গার আশঙ্কা বেড়ে গেল।
ইমাম মুহাম্মদ ইমদাদুল্লাহ বুঝতে পারলেন, এই প্রতিহিংসার অনল না নেভালে আরও রক্ত ঝরবে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা চলে যাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। প্রাণ যাবে আরও মানুষের। খালি হবে অন্য কোন বাবার বুক।
একটা মাইক হাতে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। মহল্লায় মহল্লায় ঘুরে সবার প্রতি আবেদন জানালেন, আপনারা শান্ত হোন।
শান্ত মাওলানা ইমদাদুল্লাহ বললেন, আল্লাহ আমার সন্তানকে যতদিন বাঁচার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন ততদিন বেঁচেছেন। আল্লাহর ইচ্ছায় তার মৃত্যু হয়েছে। তাকে যারা হত্যা করেছে, আল্লাহ্ তাদের কেয়ামতের ময়দানে শাস্তি দেবেন।
কিন্তু আমার সন্তানের মৃত্যুর প্রতিশোধ আপনারা নিন তা আমি চাই না। আমার সন্তানের মৃত্যুর জন্য একটি মানুষের ওপরও আক্রমণ চাই না। একটা বাড়িঘর, দোকানপাট কোথাও ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ বা লুটপাট করা যাবে না।
তিনি আরও বলেন, ইসলাম আমাদের নিরীহ কোনো মানুষকে হত্যা করতে শেখায় না। ইসলাম আমাদের শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রেখে বসবাস করতে শেখায়। আমাদের আসানসোলে আজ শান্তিশৃঙ্খলার প্রয়োজন। আপনারা যদি আমায় আপন মনে করেন, তা হলে ইসলাম নির্দেশিত শান্তি বজায় রাখবেন। শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব আপনাদের।
পুত্রশোকের মধ্যেও এলাকায় ঘুরে ছেলের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে অশান্তি না ছড়ানোর জন্য তার এই আবেদনে কাজ হলো। লোকজন ঘরে ফিরে গেল।
এদিকে, লাশের ময়নাতদন্তের পর বৃহস্পতিবার আসর নামাজের আগে সিবগাতুল্লাহর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
এতে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলেন। সিবগাতুল্লাহর বুক চিরে কলজে বের করার মতো নৃশংসতার কারণে মুসল্লিরা ছিলেন প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ।
কিন্তু ছেলের লাশের সামনে মাওলানা ইমদাদুল্লাহ উর্দুতে যে বক্তব্য দেন, তা সবাইকে রীতিমতো চমকে দেয়। সবাই ইসলামের প্রকৃত মর্মবাণীকে নতুন করে অনুধাবন করেন। ইমামের বক্তৃতা ভারতের বহু সংবাদমাধ্যমেও স্থান পায়।
ইমামের বক্তৃতার বিষয়ে আসানসোলের ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নাসিম আনসারী বলেন, জানাজার ময়দানকে কারবালার ময়দান বলে মনে হচ্ছিল। যুবকদের চোখেমুখে ফুটে উঠছিল প্রতিশোধগ্রহণের প্রতিজ্ঞা। আমি প্রায় হাল ছেড়েই দিয়েছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, না আর আসানসোলকে রক্ষা করা গেল না।
কাউন্সিলর আরও বলেন, জানাজা শুরুর আগে নিহত কিশোরের বাবা ইমাম ইমদাদুল্লাহ্ রাশিদি খুতবা দিতে উঠলেন। তার উর্দু বক্তব্য শুনে সঙ্গে সঙ্গেই পরিবেশ অদ্ভুতভাবে অত্যন্ত ঠাণ্ডা হয়ে যায়। জানাজার শেষ হয়। প্রত্যেকেই নিজের নিজের বাড়ি ফিরে যান। মাওলানা ফিরে যান মসজিদে।
কাউন্সিলর নাসিম আনসারী বলেন, না আসানসোলের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে শান্ত করার জন্য একজন পুলিশ বা একজন প্রশাসনিক লোকের দরকার পড়েনি। মাওলানার মোহিত করার বক্তব্যই পুরো পরিস্থিতিকে শান্ত করে দেয়।
ওই মহুয়াডাঙ্গাল এলাকারই বাসিন্দা প্রমোদ বিশ্বকর্মা বলছিলেন, “ইমাম সাহেবকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব! ছেলে হারানোর পরেও রাস্তায় মাইক নিয়ে বলে বেরিয়েছেন যে সবাই যেন শান্তি বজায় রাখে। তবে আমাদের এই পাড়াতে আমরা হিন্দু আর মুসলমান সবাই একসঙ্গেই থাকি বহু যুগ ধরে। পাড়ায় একটা মন্দির আছে প্রায় দেড়শা বছরের পুরনো, আবার মসজিদও আছে। বাইরে যা হয় হোক, আমাদের পাড়ায় কেউ ঝামেলা করতে পারে না।”
শিল্পশহর আসানসোলেরসৌভ্রাতৃত্বের শহর বলা হয়।ইমাম মাওলানা ইমদাদুল্লাহ রাশিদি আবারো সেই কথা প্রমাণ করে দেখিয়ে দিলেন।ভারতীয়দের কাছে মুসলিমদের হিরো বনে গেলেন তিনি।
রকিব মুহাম্মাদআওয়ার ইসলাম
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন