08 Jan, 2014 আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি পায়নি ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন। ভারত ছাড়া বিশ্বের অন্য কোনো দেশ এ নির্বাচনের পক্ষে তাদের অবস্থান ব্যক্ত করেনি। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা ও ৫৩ জাতির সংস্থা কমনওয়েলথ অর্ধেকের বেশি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না হওয়া এবং বাকিগুলোতে নামমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ায় সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের ফলাফলে তাদের হতাশা ও অসন্তোষের কথা জানিয়েছে। বলেছে, বাংলাদেশের মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন অনুযায়ী এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় না। আর জাতিসঙ্ঘ নির্বাচনকে ‘বিভক্তি ও কম অংশগ্রহণমূলক’ বলে চিহ্নিত করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের প্রত্যাশার প্রতি সাড়া দিয়ে শিগগিরই অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও অর্থবহ সংলাপ শুরুর তাগিদ দিয়েছে।
পরিষ্কারভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নির্বাচনে তাদের অসন্তোষের কথা জানিয়ে নতুন নির্বাচন আয়োজনের তাগিদ দিয়েছে। সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাদের দীর্ঘ দিনের আহ্বান ও কূটনৈতিক তৎপরতা বিফলে যাওয়ায় হতাশ হয়েছে তারা। তাই দেশে-বিদেশে বিতর্কিত এই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারকে তারা ‘স্বল্প সময়ের সরকার’ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে শিগগির গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে নতুন করে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের অধীনে ইতঃপূর্বে অনুষ্ঠিত ছয় হাজারের বেশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য হিসেবে দাবি করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, জাতীয় নির্বাচনও ক্ষমতাসীন দলের অধীনে অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠান সম্ভব। কিন্তু প্রার্থী ও ভোটার সঙ্কটে ভুগে জালিয়াতির অভিযোগে দুষ্ট ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দলীয় সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য সংসদ নির্বাচন করতে পারার দাবি দেশে-বিদেশে আর ধোপে টিকবে না।
যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির গতকাল এ ব্যাপারে নয়া দিগন্তকে বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হতাশার বিষয়টি পরিষ্কার। আর একটু গভীরে গেলে বোঝা যাবে তারা এই নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক মনে করছে না এবং আরেকটি নির্বাচনের কথা বলছে। সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছে তারা।
তিনি বলেন, নির্বাচনের পর দেয়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বক্তব্যের সাথে তাদের পূর্ববর্তী অবস্থানের একটি ধারাবাহিকতা রয়েছে। তারা চায় একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনÑ যাতে সব দল অংশ নেবে। এই নির্বাচনে সেই বৈশিষ্ট্য নেই বলেই তারা এ কথা বলছে। এ জন্য তারা রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনায় বসার তাগিদ দিচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দীর্ঘ দিন ধরেই এ কথা বলে আসছে। কিন্তু সেটি কার্যকর করার ক্ষেত্রে তারা কী ভূমিকা রাখতে পারেÑ জানতে চাইলে হুমায়ুন কবির বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে তারা বরাবরই একটা চাপ সৃষ্টি করে রেখেছে। সরকারের জন্য এটা উপেক্ষা করা কঠিন। বাংলাদেশের মানুষ যে এই নির্বাচনকে খুব একটা গ্রহণযোগ্য মনে করছে তেমনও না। তাই এ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার ঘাটতি অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে আছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই এটিকে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার নির্বাচন হিসেবে আখ্যায়িত করে একাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনার কথা বলছেন। একটি টেকসই নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা সবাই উপলব্ধি করছে।
নির্বাচনটি আন্তর্জাতিকভাবে বৈধতা পাবে কি না এবং বিভিন্ন দেশের সাথে চুক্তি সই বা আলোচনার ক্ষেত্রে সমস্যা হবে কি না জানতে চাইলে হুমায়ুন কবির বলেন, সে ধরনের কোনো সমস্যা হবে বলে আমি মনে করি না। তাদের বক্তব্যে বোঝা যায় পরবর্তী সরকারকে তারা স্বল্প সময়ের সরকার বলে মনে করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মহসিন বলেন, আমরা জানি যে নির্বাচনটা বিতর্কিত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের নির্বাচনকে কিভাবে চায় সেটা বড় কথা নয়। আমরা কী চাই সেটাই আসল কথা। আমরা যদি স্থিতিশীল গণতন্ত্র চাই তবে নির্বাচনে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত প্রার্থীদের নিয়ে নির্বাচনকে আমরা গণতান্ত্রিক বলে দাবি করতে পারি না। এ ধরনের নির্বাচনের মাধ্যমে স্থিতিশীলতা আসে না। এতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশ। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেও বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রবাসী বাংলাদেশের সংখ্যাও অনেক। তাদেরও একটি মতামত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করছে। তারা চাইবে একটি স্থিতিশীল দক্ষিণ এশিয়া। বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল হলে অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মুসলিমপ্রধান দেশ হিসেবে পশ্চিমারা বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা চায়।
আন্তর্জাতিকভাবে নতুন সরকারের বৈধতার কোনো ঘাটতি দেখা দেবে কি নাÑ জানতে চাইলে আমেনা মহসিন বলেন, আইনত কোনো সমস্যা নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সেনাশাসিত সরকারের সাথেও চুক্তি করে। সাংবিধানিকভাবে না হলেও আমি প্রশ্ন তুলতে পারি গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে। সংবিধানের চেতনা নয়, আক্ষরিক অর্থে নতুন সরকারকে অবৈধ বলা যাবে না।
সংলাপ স্থগিত করে ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারের মনোভাব পরিষ্কার হওয়ার পরই কঠোর অবস্থান নিয়েছিল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। নির্বাচনে বিদেশী পর্যবেক্ষক না পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এরপর একে একে কমনওয়েলথ, যুক্তরাষ্ট্র, এমনকি বর্তমান সরকারের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে বিবেচিত রাশিয়াও পর্যবেক্ষক না পাঠানোর ব্যাপারে তাদের অবস্থানের কথা নির্বাচন কমিশনকে জানিয়ে দেয়। এ নির্বাচনে ভারত ও ভুটান দুইজন করে মোট চারজন পর্যবেক্ষক পাঠায়। আর নিরাপত্তার কারণে দেশীয় পর্যবেক্ষকেরা সীমিত সংখ্যায় সক্রিয় হয়।
নির্বাচন কমিশন ৪০ শতাংশ ভোট পড়ার দাবি করলেও দেশীয় পর্যবেক্ষকেরা তা ৩০ শতাংশেই সীমাবদ্ধ রেখেছে। এ নির্বাচনের ব্যাপারে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরউদ্দিন গত সোমবার এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, এটা (নির্বাচন) ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার অংশ। অন্য দিকে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের উপ-মুখপাত্র মেরি হার্ফ গতকাল এক বিবৃতিতে বলেছেন, জনগণের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য এমন একটি নতুন নির্বাচন দিয়ে বাংলাদেশ এখনো গণতন্ত্রের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারে। উৎসঃ নয়া দিগন্ত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন