সিলেটের আলাপ. মঙ্গলবার, ১০ পৌষ ১৪২০; ২৪ ডিসেম্বর ২০১৩
তাইছির মাহমুদ:দৈনিক মানবজমিনে শফিকুর রহমান চৌধুরী এমপিকে নিয়ে ‘না জানি
কোন অভিশাপে এমন হয়ে গেলো’-শীরোনামে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট দেখে কিছু লিখার
তাগিদ অনুভব করলাম। রিপোর্টটি মানবজমিন থেকে বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে
আপলোড করা হয়েছে। ফেইসবুকেও ছড়িয়ে পড়েছে। আর ফেইসবুকের বদৌলতেই আমার চোখে
পড়লো। সংবাদের শিরোনামটি বেশ চটকদার। যেকারো দৃষ্টি কাড়বেই। শুধু শিরোনাম
দেখেই বুঝতে পারলাম, শফিক চৌধুরীর মনোনয়ন না পাওয়ার বিষয়টি নিয়েই সংবাদটি
লিখা হয়েছে। সাথে সাথে তাঁকে নিয়ে আমার একটি স্মৃতিবহুল ঘটনা মনে পড়লো।
তিনি যে এবার মনোনয়ন পেতে না পারেন তা টের পেয়েছিলাম অনেক আগেই। কারণ যে
কারণেই হোক দলীয় সভানেত্রীর (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) সুনজরে ছিলেন না
তিনি। ২০১১ সালের ২৯ জানুয়ারী যুক্তরাজ্য আওয়ামীলীগের সম্মলনে এসেছিলেন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুই তিনদিন আগে এসেছিলেন শফিক চৌধুরী এমপি। ঐ
সম্মলনে তাঁকে অন্যান্য মন্ত্রী এমপিদের সাথে স্টেইজে বসার আমন্ত্রণ জানানো
হয়নি। তাঁকে বসতে হয়েছিলো স্টেইজের সম্মুখে সাধারণ নেতাকর্মীদের সারিতে।
কিন্তু ওখানে বসেও রক্ষা হলোনা তাঁর। প্রধানমন্ত্রীর তীর্যক মন্তব্যের
শিকার হলেন তিনি। বাংলাদেশে বিভিন্ন সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের
কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে বলেন, কিভাবে আমরা পাশ
করবো? আমাদের নেতাকর্মীরা মাঠে নেই। এই যে দেখেন না শফিক চৌধুরী, উনি
আমাদের আগে-বাগে লন্ডন এসে বসে আছে। দেশে কাজ করবে কে?
সাংবাদিক ও
হাজার হাজার নেতাকর্মীর সামনে প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্য শফিক চৌধুরী’র
কাছে কেমন লেগেছিলো জানিনা। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে খুব খারাপ
লেগেছিলো। কারণ শফিক চৌধুরী আমাদের প্রবাসীদের প্রতিনিধি। জাতীয় সংসদে
প্রবাসী এমপি। তাঁকে লজ্জা দেয়া মানে আমাদেরকে দেয়া। প্রধানমন্ত্রীর মনে
ক্ষোভ থাকতেই পারে। কোনো কারণে শফিক চৌধূরীকে তাঁর কাছে চক্ষুশুল মনে হতে
পারে। কিন্তু এভাবে জনসমক্ষে লজ্জা দেয়াটা মোটেও সমিচীন মনে হয়নি। তবে ঐদিন
থেকেই আমার আশংকা হয়েছিলো, আগামী নির্বাচনে হয়তো মনোনয়ন বঞ্চিত হতে পারেন
শফিক চৌধুরী।
তবে মনোনয়ন পেলেও আরো একটি কারণে বিশ্বনাথ-বালাগঞ্জ
আসনটি তাঁর ধরে রাখতে না পারার আশংকা হয়েছিলো। আমাদের অনেক সহকর্মী
সাংবাদিক বলতেন, লন্ডনে থাকাকালে যেভাবে শফিক চৌধুরীর সাথে সহজে যোগাযোগ
করা যেতো, কথা বলা যেতো, এমপি হওয়ার পরে আর তা সম্ভব হচ্ছেনা। অনেকে লন্ডন
থেকে সিলেটে গিয়ে তাঁর সাথে সহজে দেখা করতে পারেন না। কেউ কেউ কাঠ-খড়
পুড়িয়ে দেখা করতে সক্ষম হয়েছেন। লন্ডনে আয়োজিত তাঁর বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলনে
অনেক সাংবাদিককে প্রকাশ্যে এমন কথা বলতে শুনেছি। আমার কাছে মনে হয়েছিলো,
একজন আওয়ামী লীগ নেতা শফিক চৌধুরী আর একজন সাংসদ শফিক চৌধুরীর মধ্যে ফারাক
থাকতেই পারে। সাংসদ হিশেবে দায়-দায়িত্ব, ব্যস্ততা অনেক বেশী। সংগত: কারণেই
হয়তো অনেকে সহজে তাঁর সাথে দেখা করতে পারছেন না। কিন্তু গত কয়েক মাস আগের
একটি ঘটনা আমার সে ধারণা পাল্টে দিলো।
তিনি লন্ডন এসেছিলেন। সফরকালে
পূর্ব লন্ডনের গ্রেটোরেক্স স্ট্রিটের তাঁর একটি পারিবারিক ব্যবসা
প্রতিষ্ঠানে কিছুক্ষণ অবস্থান করেছিলেন স্থানীয় একটি টিভি চ্যানেলকে
সাক্ষাতকার দিতে। খবর পেয়ে আমিও উপস্থিত হলাম সেখানে। অবশ্য বাংলাদেশে কোনো
রাস্তাঘাটের জন্য কাবিখা‘র গম বরাদ্দ কিংবা জায়গা-জমি সংক্রান্ত মামলায়
সাহায্য চাওয়ার মতো কোনো তদবির নিয়ে নয়। গিয়েছিলাম আমার একটি অনুসন্ধানী
প্রতিবেদনে তাঁর বক্তব্য নেয়ার জন্য। তিনি টিভিতে ইন্টারভিউ দিচ্ছিলেন। আমি
পাশেই দাড়িয়েছিলাম। ভাবছিলাম, শেষ হলেই দুই-এক মিনিটে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস
করে বিদায় নেবো। ইন্টারভিউ শেষ হলে তিনি কোনো কথা না বলেই বেরিয়ে যেতে
উদ্যত হলেন। ভাবখানা এমন যে, তিনি ইতোপূর্বে আমাকে কখনো দেখেননি। বললাম,
শফিক ভাই এক মিনিট সময় দেয়া যাবে? আপনার একটি কমেন্ট নেবো। তিনি তখন
তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিমায় সিলেটী ভাষায় বললেন-‘দুরো-রাবা আমার সময় নাই’। তাঁর
এই উত্তর শুনে আমি তো কিংকর্তব্যবিমুঢ়। হায়, এই আমাদের শফিক ভাই! যিনি
লন্ডনে থাকাকালে প্রায়ই তাঁর সেন্ট্রাল লন্ডনের দিলশাদ রেস্টুরেন্টে সংবাদ
সম্মেলন কিংবা মতবিনিময় অনুষ্ঠান আয়োজন করতেন। আমাদেরকে নিজে ফোনে অনুরোধ
করে নিয়ে যেতেন। আদর-যতœ করে খাওয়াতেন। ফেরার সময় সাথে টেকওয়েও দিয়ে দিতেন।
তিনি এভাবে আমার সাথে কুশল বিনিময় করা দুরে থাক; -‘দুরো-রাবা’ বলে
তাড়াবেন- এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো। জবাবে আমি বিনয়ের সাথে বলেছিলাম, শফিক
ভাই ঠিক আছে। কোনো অসুবিধা নেই। আপনার ব্যস্ততা থাকলে চলে যান, পরে কথা
হবে। তিনি কোনো কথা না বলে চলেই যান। অবশ্য ঘন্টাখানেক পরে তিনি আমাকে ফোন
করেছিলেন। ইন্টারভিউ দিতে অফিসেও আসতে চেয়েছিলেন। তখন আর সেটা হয়ে উঠেনি।
সম্ভবত: তাঁর সঙ্গীয় নেতাকর্মীদের কাছে বিষয়টি খারাপ লেগেছিলো। তাই তা্রাঁই
তাঁকে দিয়ে আমাকে ফোন করিয়েছিলেন। তবে শফিক ভাইয়ের এই আচরণে আমি মোটেও
ক্ষুব্ধ বা অসšু‘ষ্ট হইনি। কারণ ইতোমধ্যে অনেকেই এ ধরণের অভিজ্ঞতার কথা
আমার সাথে শেয়ার করেছিলেন।
মানুষের যখন খারাপ সময় আসে তখন অনেক সময়
ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় অনেক অস্বাভাবিক কিছু করে বসে। ঐদিনের ঘটনায় আমার আশংকা
আরো প্রকট হয়েছিলো-বোধহয় আমরা আগামীতে শফিক ভাইকে জাতীয় সংসদ থেকে হারাতে
বসেছি। তাইছির মাহমুদ: সংবাদিক, নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক নতুন দিন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন