বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারী সদ্য স্বাধীন দেশে পা দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের সময়
যুদ্ধাপরাধী ১৯৮ জনের চূড়ান্ত তালিকা পূর্বক তাদের সবাইকে সাধারণ ক্ষমা
ঘোষনা পূর্বক মুক্তি প্রদান করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। পরবর্তীতে
মুক্তিযোদ্ধাদের দাবীর মুখে এ দেশের দালাল ঘাতকদের বিচারের দাবীর
প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু ঘাতকদের বিচারের ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর
রহমান। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় সবধরনের মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধের বিচারে
ওই বছরের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ দালাল আইন (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশ ১৯৭২
জারি করেন। এতে প্রায় লক্ষাধিক রাজাকার, আলবদর, আল শামস, পিচ কমিটির
সদস্যদের নামে সারা দেশে মামলা রুজু করা হয়। বঙ্গবন্ধু সরকার বিচারকাজ
সম্পন্ন করতে ৭৩টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেন। ১৯৭৩ সালের অক্টোবর
পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তি হয় দুই হাজার ৮৮৪টি মামলা। সর্বমোট
প্রায় ১১ হাজার আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। বাকী গুলোর বিরুদ্ধে
অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তারা মুক্তি পেয়ে যান। বিচারে সর্বমোট ৭৫২
জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় সাজা প্রদান করা হয়। তাদের মধ্যে ১৫
এবং মতান্তরে ১৯ জনের মৃত্যুদন্ড হয়েছিল। বাকিদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে
শুরু করে বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড প্রদান করা হয়। দালাল আইনে প্রথম
মৃত্যুদণ্ড রায় হয় রাজাকার চিকন আলীর। এ সম্পর্কে বাহাত্তরের ১১ জুন
দৈনিক বাংলায় প্রধান শিরোনাম ছিল 'দালালির দায়ে দায়রা জজ ও বিশেষ
ট্রাইব্যুনালের সদস্য রবীন্দ্র কুমার বিশ্বাস ৮ জুন রাজাকার চিকন আলীর
বিরুদ্ধে এ রায় দেন। কুষ্টিয়ার মিরপুর গ্রামের চিকন আলীর বিরুদ্ধে
একাত্তরের ১৯ অক্টোবর একই গ্রামের ইয়াজউদ্দিনকে গুলি করে হত্যার অভিযোগ
ছিল।কিন্তু বঙ্গবন্ধু মুত্যুদণ্ড প্রাপ্তদের সাজা প্রদান স্থগিত রাখেন।
অবশেষে আসামীদের সাধারণ ক্ষমা চাওয়ার প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে
দণ্ডিত ৭৫২ জনকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে তাদের মুক্তি প্রদানের
নির্দেশ দেন এ যুক্তিতে যে, যেখানে পাকিস্থানী ১৯৮ জন মূল যুদ্ধাপরাধীকে
সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানে তাদের দোসরদের শাস্তি প্রদান
অমানবিকা। এ কারণে দালাল আইন (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) অধ্যাদেশের আর কোন
কার্যকারিতা না থাকায় বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠনের সময় উক্ত আইন বাতিল করে
দেন।
উল্লিখিত মামলাগুলো পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, দেশ স্বাধীনতার
অব্যাবহিত পরে যাদের বিরুদ্ধে দালাল আইনে মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলা রুজু
হয়েছে, তাদের মধ্যে জামাতে ইসলামীর কোন নেতা ছিলেন না বা ঐ সময়ে তাদের
নামে কেও আদালতে অভিযোগ দায়ের করেন নি। এতে প্রমাণিত হয় ৭১ সালে জামাতের
অনেক নেতাই অন্যান্য ইসলামী দলের ন্যায় পাকিস্তান ভাঙ্গার পক্ষে না থাকলেও
তারা কোন মানবতা বিরোধী কোন কর্মকান্ডে লিপ্ত ছিলেন না। যদি কাদের মোল্লাহ
সহ অন্যান্য জামাত নেতারা মানবতা বিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত হতেন ঐ সময়ে
তাহলে সবার আগে কাদের মোল্লাহ গংদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু হতো। কেননা, আজকে
যারা কাদের মোল্লাহ, নিজামী, মুজাহিদ গংদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধী মামলা
রুজু ও সাক্ষ্য প্রদান করছে ও স্বাক্ষী দিচ্ছেন তারা সবাই সমাজের
প্রভাবশালী ব্যক্তি। কিন্তু কেন তারা বঙ্গবন্ধুর আমলে কাদের মোল্লাদের
বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন নি সেটাই নানা সন্দেহের উদ্রেক করেছে। যেখানে
গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল হতে গ্রামের নিরন্ন মানুষ রাজাকরদের বিরুদ্ধে
মামলা রুজু করার প্রয়াস পেয়েছে ৭২ সালে। সেখানে তখন এই প্রভাবশালী চক্র
তখন জামাত নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করার কোন উপাদান খুজে পায়নি। কাজেই এখন
প্রমাণিত যে, প্রভাবশালী পুজিপতি স্বার্থান্বেষী চক্র সবাই একটি বিশেষ
রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় জামাতকে বিলুপ্ত ও এর নেতাদের বিচারের নামে
ঠান্ডা মাথায় ধ্বংশ করার ষড়যন্ত্রে উঠে পড়ে লেগেছে। সরকার, মিডিয়া ও
দেশের পুজিপতিরা তাদের মদাদ দান করছে ঘৃণ্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত
হয়ে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন