বিশেষ সংবাদদাতা : জনদাবি ও আন্তর্জাতিক মতামতকে উপেক্ষা করে সরকার ‘একতরফা’ নির্বাচনের পথে হাঁটায় অর্থনৈতিক অবরোধের মুখে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সরকারের কর্মকান্ডে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরকারের কাছে বার্তা পাঠানো হয়েছে, এভাবে চলতে থাকলে তারা জ্বালানি তেলের ওপর বাংলাদেশকে দেয়া সহায়তা প্রত্যাহার করবে। পাশাপাশি জনশক্তি আমদানির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। জনশক্তি রপ্তানি ও উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে সউদী আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মুসলিম রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশ থেকে কোন শ্রমিক নিচ্ছে না। আর আন্তর্জাতিক তৈরি পোশাকের বাজারেও পড়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতার কালো ছায়া। ইতোমধ্যেই গার্মেন্ট পণ্যের রপ্তানি আদেশ কমেছে আশঙ্কাজনকভাবে। সেইসাথে এদেশের প্রধান গার্মেন্ট পণ্য রপ্তানির বাজারে হানা দিয়েছে পাকিস্তান। এই সুযোগে বাংলাদেশের বাজার দখলে মরিয়া হয়ে উঠেছে ভারত। সরকারের অনমনীয় মনোভাবের কারণে মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি তেল আমদানি সুবিধা ও জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেলে এবং আন্তর্জাতিক তৈরি পোশাকের বাজার ভারত ও পাকিস্তানে চলে গেলে দেশের লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বে। যার প্রভাবে দেশে ভয়াবহ আর্থসামাজিক বিপর্যয় নেমে আসবে।
বাংলাদেশ জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে সহায়তা পেয়ে থাকে সউদী আরব ও কুয়েত থেকে। বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, সউদী এরাবিয়ান ওয়েল কোম্পানি ও কিংডম অব সউদী এরাবিয়া এবং আবুধাবী ন্যাশনাল কোম্পানী থেকে বাংলাদেশ অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে। আর কুয়েত পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন, মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস ট্রেডিং কর্পোরেশন, ইউএই, চীন, ঈজিপ্ট, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও সিঙ্গাপুর থেকে পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়। দেশে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার মেট্রিক টন ডিজেল ব্যবহার হয়। অন্যদিকে, রেন্টাল ও কুইক রেন্টালগুলো চালু রাখার জন্যও জ্বালানি তেলের বড় একটি অংশ সরবরাহ করতে হচ্ছে। এতে করে দেশে প্রতিবছরই জ্বলানী তেলের চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। এই চাহিদা মেটাতে সরকারকে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ব্যাংক থেকে গত বছর চড়া সুদে ঋণ পর্যন্ত নিতে হয়েছে। এবছর পরিস্থিতি আরও শোচনীয় বলে জানা যায়।
এ ব্যাপারে ইআরডি’র মধ্যপ্রাচ্য উইংয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, মূল্য পরিশোধ করতে না পারায় গত বছর বিপিসির জ্বালানি তেল আমদানি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আর এবার রাজনৈতিক অচলাবস্থার কবলে পড়ে কুয়েত ও সউদী আরব জ্বালানি তেলের ওপর দেয়া সুবিধা বন্ধ করে দেয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। একই ধরনের পূর্বাভাস দিয়েছে আইডিবি। এতে করে চলতি বোরো মৌসুমে জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে সরকারকে বড় ধরনের হোঁচটের মুখে পড়তে হবে। যার প্রভাব পড়বে কৃষি, বিদ্যুৎ ও শিল্পাঙ্গনে। আবাসিক ক্ষেত্রেও ভয়াবহ সঙ্কট নেমে আসবে। সরকার গত বছর আইডিবি থেকে চড়া সুদে প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ ২২০ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছিল।
এদিকে, সরকারের একগুঁয়েমি নীতির কারণে মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম দেশগুলো জনশক্তি আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। সউদী আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিচ্ছে না। জনশক্তি উন্নয়ন ও রপ্তানি ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, সউদীতে প্রতি মাসে শুধু হাতেগোনা কিছু শ্রমিক যাচ্ছে। গত বছরের তুলনায় গেল বছর বিদেশে কর্মী নিয়োগ প্রায় তিন লাখ হ্রাস পেয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, বন্ধকৃত শ্রম বাজার পুনরুদ্ধারে সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সরকারের ভ্রান্ত নীতি’র কারণে জনশক্তি রফতানিতে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। জিটুজি’ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণের সরকারী উদ্যোগও ভেস্তে গেছে। বেসরকারী রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে মালয়েশিয়া কর্মী প্রেরণের সুযোগ দেয়া হয়নি। জিটুজিতে মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়ায় বিএমইটি’র কল্যাণ তহবিলের কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হলে মাত্র ৬/৭শ’ কর্মীকে মালয়েশিয়ায় পাঠানো সম্ভব হয়েছে।
জানা যায়, সউদী আরবে বর্তমানে ১৫ লাখ শ্রমিক রয়েছে। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশেও কাজ করছে প্রায় ২০ লাখ শ্রমিক। মালয়েশিয়ায় রয়েছে প্রায় সাত লাখ বাংলাদেশী শ্রমিক। সরকারের দুর্বল নীতি ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এসব শ্রমিকের ভবিষ্যত নিয়েও দেখা দিয়েছে শঙ্কা। জানা যায়, কূটনৈতিক সম্পর্ক ভালো না থাকায় সউদী সরকার সাধারণ ক্ষমার মেয়াদ শেষে গত ৪ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশী প্রবাসী কর্মীদের ইকামা ট্রান্সফার বন্ধ করে দিয়েছে। অথচ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রবাসী কর্মীদের ইকামা ট্রান্সফার চালু রয়েছে। জেদ্দা থেকে প্রবাসী সাংবাদিক রুমী সাঈদ টেলিফোনে ইনকিলাবকে এ তথ্য জানান। তিনি মধ্যপ্রাচ্যের শ্রম বাজার ধরে রাখতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার উপর গুরুত্বারোপ করেন।
আন্তর্জাতিক শ্রম বাজার ক্রমেই বাংলাদেশের জন্য কঠিন হয়ে উঠায় রেমিটেন্স প্রবাহের গতি হ্রাস পেয়েছে। জানা যায়, অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) রেমিট্যান্স এসেছে ৬৭৫ কোটি ডলার। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬২ কোটি ডলার কম।
এদিকে, আন্তর্জাতিক তৈরি পোশাকের বাজারেও পড়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতার কালো প্রভাব। দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির কারণে দেশের রপ্তানিমুখী খাতগুলো যখন স্থবির হয়ে পড়ছে; তখন অদম্য গতিতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিযোগী দেশগুলো। বাংলাদেশের প্রধান গার্মেন্ট পণ্য রপ্তানির বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) ইতোমধ্যেই হানা দিয়েছে পাকিস্তান। এই বাজার দখলে মরিয়া ভারতও। গত সপ্তাহে ইইউ সংসদ পাাকিস্তানের অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুুবিধা (জিএসপি) পাস করেছে। এতে করে চলতি মাস থেকে ইইউ বাজারে পাকিস্তান শুল্কমুক্ত সুবিধায় গার্মেন্ট পণ্য রপ্তানির সুযোগ পাবে। ভারতও শিগগিরই ইইউ’র সঙ্গে জিএসপি চুক্তি করতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। বর্তমানে তিন দেশের মধ্যে বাংলাদেশ কেবল এই সুবিধা পেয়ে আসছে। সরকারের একরোখা মনোভাবের কারণে বাংলাদেশের এই বাজার ভারত ও পাকিস্তানে চলে গেলে এ দেশেআর্থ-সামাজিক খাতে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে।
এ ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে ক্রেতারা এ দেশে আসতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। তারা নতুন করে কোন অর্ডার দিতে চাচ্ছেন না। দেশীয় রপ্তানিকারকরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে মূলত ভারতের বাজারেই বেশি অর্ডার চলে যাচ্ছে। এ ছাড়াও শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান ও কম্বোডিয়ার মত দেশও বাংলাদেশের বড় প্রতিযোগী হয়ে উঠছে। বিদেশ থেকে অর্ডার এনে পোশাক তৈরি করতে হলে বিজিএমইএ’র কাছ থেকে কাঁচামাল ব্যবহারের সনদ ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন (ইউডি) নিতে হয়। এ সনদটি নেওয়ার হার দেখে সাধারণত আগামী কয়েক মাসে পোশাক রপ্তানির একটি গতিধারা বোঝা যায়। ইউডির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পোশাক খাতে চলতি বছর ১০ মাসের পাঁচ মাসই রপ্তানি আদেশে নেতিবাচক ধারা ছিল। এই নেতিবাচক প্রভাবে বিস্মিত ও শঙ্কিত বিজিএমইএ নেতারা।
এ নিয়ে বিজিএমইএ’র সহসভাপতি রিয়াজ বিন মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশের জন্য ভয়ের কারণ হয়ে উঠছে ভারত ও ভিয়েতনাম। সেখানে বাংলাদেশের অর্ডার চলে যাচ্ছে। বড় আশঙ্কার কথা হলো, পাকিস্তান ইউরোপে জিএসপি সুবিধা পেয়ে গেছে। ভারত ইউরোপের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করতে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক অচলাবস্থা চলছে তাতে করে ভবিষ্যতে এ দেশের পোশাক খাতে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে হিমায়িত চিংড়ি ও মাছ রপ্তানি, শুঁটকি রপ্তানি, কাঁচা সবজি রপ্তানি, পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিসহ অন্যান্য রপ্তানিমুখি পণ্য বাজার দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন