'১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি' বলে মন্তব্য করেছেন ভারতীয় এক গবেষক। তিনি বলেছেন, তারা যে দেশের স্বাধীনতা চান, সেটা মার্চ মাস পর্যন্ত কোথাও বলেননি।
ভারতের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়ার সাথে এক সাক্ষাৎকারে গবেষক শ্রীনাথ রাঘবন একথা বলেছেন। বাংলাদেশের উদ্ভব নিয়ে তিনি একটি বইও লিখেছেন।
শ্রীনাথ রাঘবন লন্ডনের কিংস কলেজের রিসার্স ফেলো এবং সেন্টার ফর পলিসি রিসার্সের সিনিয়র ফেলো।
টাইমস অব ইন্ডিয়া বলেছে, সহিংসতার মধ্যেই নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত বলেই মনে হচ্ছে। এই সহিংসতার কিছু কারণ প্রথিত আছে অতীতের মাঝে। এরই সূত্র ধরে শ্রীনাথ রাঘবনের বই ‘১৯৭১ : বাংলাদেশ সৃষ্টির বৈশ্বিক ইতিহাস’ নিয়ে তার সাথে কথা বলেছেন টাইমস অব ইন্ডিয়ার সাংবাদিক আশিস ইয়েচুরি।
পরিবর্তন-এর পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি হুবহু অনুবাদ করা হলো-আপনার বই ‘১৯৭১ : বাংলাদেশ সৃষ্টির বৈশ্বিক ইতিহাস’ –কেন বৈশ্বিক?
শ্রীনাথ রাঘবন : সাধারণভাবে বাংলাদেশ সৃষ্টির বিষয়টিকে দেখা হয় উপমহাদেশীয় ব্যাপার হিসেবে। প্রচলিতভাবে এটাকে দেখা হয় দ্বিতীয় দেশভাগ হিসেবে। এটা আমার কাছে খুব সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি মনে হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি আন্তর্জাতিক। এখানে সেইসব পরিপ্রেক্ষিতকে বিবেচনায় নেয় না, যে পরিপ্রেক্ষিতের ফলে এটা সম্ভব হয়েছিল এবং নির্ধারিত হয়েছিল চূড়ান্ত ফলাফল। এটা ছিল বৈশ্বিক ঘটনা– পক্ষগুলো ভেবেছিল তাদের বৈশ্বিক সমর্থন আদায় করতে হবে। এক অর্থে মাঠের যুদ্ধের সাথে বৈশ্বিক মতামতের যুদ্ধের মিলন ঘটেছিল। এসব ঘটনা (একাত্তরের) অনুধাবনের ক্ষেত্রে এটাই কেন্দ্রীয় বিষয়।
আপনি মনে করেন বাংলাদেশ সৃষ্টি অনিবার্য ছিল না, বরং আপনি এমন কিছু বিষয়ের কথা বলেছেন যা ‘১৯৭১’ তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখে। এটা কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
শ্রীনাথ রাঘবন : বাংলাদেশ সম্পর্কে নির্ধারণমূলক যে পাঠ প্রথমেই আমাদের সামনে আসে তা হলো, ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের নাজুক অবস্থা। ভৌগলিক ব্যাপার নিয়েও যুক্তি আছে- একই দেশের দুই অংশ ভারত দ্বারা ভাগ হয়ে রয়েছে। সেই সাথে আছে অর্থনৈতিক বৈষম্য, বাঙালি ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাংস্কৃতিক ভিন্নতা এবং দুই অংশের ক্ষমতা বিভাজনে একপেশে অবস্থার যুক্তিও। কিন্তু আমার যুক্তি হলো, স্বায়ত্বশাসনের দাবি কীভাবে স্বাধীনতার দাবিতে পরিণত হলো সেটা বোঝার জন্য আসলে এইসব প্রেক্ষাপটের দিকে নজর দেওয়ার দরকার নেই। আমাদের দরকার একটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপট।
আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কি এমন যে, পাকিস্তান যদি অতো কঠোরভাবে জবাব না দিত, তাহলে স্বাধীন বাংলাদেশ হতো না?
শ্রীনাথ রাঘবন : সেক্ষেত্রে একটা শিথিল কনফেডারেশন হতো যা ১৯৭১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমান চেয়েছিলেন। মার্চ পর্যন্ত আওয়ামী বলত না যে, তারা সরাসরি স্বাধীনতা চায়। তারা পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বায়ত্বশাসনের অধিকার সংবলিত একটি শিথিল কনফেডারেশন চেয়ে আসছিলেন। ওই সময় আশা করা হচ্ছিল, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে শিথিল কনফেডারেশন করা হবে এবং বাঙালিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে তারা অধিকতর ক্ষমতা পাবে; ন্যায্য ভাগ পাবে।
কেন এটাকে ‘১৯৬৮ সালের চেতনার’ সাথে সম্পর্কিত করছেন?
শ্রীনাথ রাঘবন : আমার কাছে মনে হয়, ১৯৬৮ সালের ছাত্র আন্দোলন ছিল পাকিস্তানের ইতিহাসের বাঁক ঘুরিয়ে দেওয়ার ঘটনা। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সম্পদ দখল করা স্বত্ত্বেও পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে ভালো করছিল এবং আইয়ুব খান ১০ বছর ক্ষমতা থাকতে পেরেছিলেন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্র আন্দোলন পরিবর্তনের সূচনা করে। ছাত্র আন্দোলন তখন ছিল একটা বৈশ্বিক ঘটনা এবং আমি সিআইএ'র একটি নথির উদ্ধৃতি দিয়েছি, যেখানে তারা বলেছিল এটা বৈশ্বিক আন্দোলন। পাকিস্তানে এই ছাত্ররা ছিল ভিন্ন ভিন্ন প্রজন্মের। শেখ মুজিবুর রহমান নিজেও ১৯৪০-এর দশকের একজন ছাত্রনেতা ছিলেন; ভিন্ন আশা নিয়ে তিনি পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন করেছিলেন। এই ছাত্র আন্দোলনের প্রগতিবাদিতা আওয়ামী লীগকে বাধ্য করেছিল দরকষাকষিতে তাদের অবস্থান কম নমনীয় রাখতে।
এই সময় এর মধ্যে ইসরায়েল জড়িয়ে পড়ছে বলে আপনি মন্তব্য করেছেন– একটু বিস্তারিত বলবেন?
শ্রীনাথ রাঘবন : ভারতকে অস্ত্র সরবরাহের ইতিহাস ভারতের আছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা স্বত্ত্বেও ১৯৬২ ও ১৯৬৫ সালে তারা কিছু অস্ত্র পাঠিয়েছিল। সুতরাং ইসরায়েলের সাথে ভারতের একটি গোপন সম্পর্ক ছিল। ১৯৭১ সালে অস্ত্র দেওয়ার ব্যাপারে আমেরিকানরা জানে এমন কোনো প্রমাণ নেই। যেহেতু ওই সময় তারা নিজেদের মারাত্মক বিচ্ছিন্ন বোধ করছিল, সেহেতু ভারতের কাছে সম্পূর্ণ কূটনৈতিক স্বীকৃতি পাওয়া ইসরায়েলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তারা মনে করত, এটা তাদের জন্য সহায়ক হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন