আব্দুল কাদের মোল্লা চলে গেলেন। মাথা উঁচু করেই চলে গেলেন। তিনি
প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করেননি। করবেন কেন? অপরাধী হলে ক্ষমা
ভিক্ষা করতেন। যিনি জানেন যে তিনি বিন্দুমাত্র কোনও অপরাধ করেননি। তিনি
ক্ষমা ভিক্ষা করবেন কেন। তিনি শাহাদাতের মৃত্যু চাইতেন। আল্লাহ তাঁর চাওয়া
এভাবেই পূর্ণ করেছেন। তাঁর জন্য আমাদের কোনও দুঃখ নেই। দুঃখ আমাদের নিজেদের
জন্যই। তাঁর উকিল রিভিউ আবেদন খারিজ হবার পর বলেছেন, ‘মোল্লা সাহেব
সুবিচার পাননি।’ দুঃখ আমাদের এ জন্যই যে, আমরা তাঁর প্রতি সুবিচার করতে
পারলাম না, সুবিচার নিশ্চিত করতে আমরা ব্যর্থ হলাম। আমাদের এ ব্যর্থতা তিনি
ক্ষমা করবেন। তাঁর উকিলও তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে এ ক্ষমাই চেয়েছেন। শহীদের
দরজা যারা পান তাদের জন্য দোআ করার প্রয়োজন হয় না। তার শাহাদাত মকবুল হোক এ
প্রার্থনা আমরা করি।
আব্দুল কাদের মোল্লা এখন
পুরস্কার-তিরস্কারের অনেক ঊর্ধ্বে। লক্ষ কোটি পুরস্কারও তার যেমন কাজে আসবে
না, তিরস্কারও তেমনই গায়ে লাগবে না। আমরা যারা আছি, তাদের কিন্তু
আনন্দ-বেদনা আছে। গতকাল সকালে পত্রিকাগুলোতে চোখ বুলাতে গিয়ে এ অনুভূতিই বড়
হয়ে ওঠে। মোল্লা সাহেব দীর্ঘদিন সক্রিয় সাংবাদিকতায় ছিলেন। তাই কিছু কিছু
সংবাদপত্রের কিছু কিছু কথা খুব বড় হয়েই মনে বাজে। একটি পত্রিকা শিরোনাম
করেছে ‘বুচার অব মিরপুর হ্যাংগড্’। বুচার খুব ভারি শব্দ। গণহত্যাকারী এর
বাংলা প্রতিশব্দ হতে পারে। মিরপুরের কোনও গণহত্যাকারী মিরপুরে তো বটেই
অন্তত ঢাকায় পরিচিত অবশ্যই হবে। তাঁর বিরুদ্ধে গ-া গ-া মামলা হবার কথা। এ
রকম ক্ষেত্রে হয়েছেও। কিন্তু ‘বুচার অব মিরপুর’-এর বিরুদ্ধে গত চল্লিশ বছরে
মিরপুর বা ঢাকার কোথাও কোনও মামলা হলো না। তাছাড়া স্বাধীনতার পরে ‘বুচার
অব মিরপুর’ মিরপুর ও ঢাকার ত্রি-সীমায় থাকার কথা ছিল না। পৃথিবীর অনেক
অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, এ ধরনের বুচাররা দেশ থেকেও ভেগে যায়। কিন্তু আব্দুল
কাদের মোল্লা স্বাধীনতার পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলে থেকে
লেখাপড়া করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে উদয়ন স্কুলে শিক্ষকতা
করেছেন। বিডিআর স্কুলে শিক্ষক ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন।
আব্দুল কাদের মোল্লা ‘বুচার অব মিরপুর’ হলে এটা কী করে সম্ভব? কিন্তু এ
যুক্তির কথা, বাস্তবতার কথা নিয়ে আলোচনা এখানে অবান্তর। প্রাসঙ্গিকভাবেই
কথাটা আমাদের আলোচনায় এসে গেল মাত্র।
আব্দুল কাদের মোল্লার এখন
কিছুরই প্রয়োজন নেই। তাঁর ওপর আরোপিত অভিযোগ, মামলা, রায়, কিছু নিয়েই তাঁর
এখন কোনও মাথাব্যথা নেই। এ মাথাব্যথা থাকতে পারে তাঁর আপনজন, বন্ধু-বান্ধব,
সহযাত্রী, সহকর্মীদের। এখন থেকেই তাঁর নির্দোষিতা প্রমাণের একটা প্রশ্ন
উঠতে পারে। তাঁর উকিলরা মনে করেন তিনি নির্দোষ। তাঁর পরিবার-পরিজন মনে
করেন তিনি নির্দোষ। তাঁর সংগঠনও মনে করে নির্দোষ তিনি এবং জনগণও
ব্যাপকভাবে মনে করে তিনি নিরপরাধ, যার প্রমাণ আমরা মাঠের প্রতিক্রিয়ায়
দেখতে পাচ্ছি। তাছাড়া বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষের তৎপরতা নিয়ে
এমন কিছু গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে যা এড়িয়ে যাবার মতো নয়। সুতরাং যারা নিরপরাধ
মনে করছেন তাদের সবার চাওয়া যদি একত্রিত হয়, কোনও সময় যদি তা পুনর্বিচারের
আবেদন হিসেবে বিচারালয়ে উপস্থাপিত হয় তাহলে বিচারের জন্য মামলাটি পুনরায়
উন্মুক্ত হতে পারে। আব্দুল কাদের মোল্লার জন্য এর প্রয়োজন নেই। কিন্তু
প্রয়োজন সত্য উদঘাটনের জন্য। চাপা দেয়া সত্য এক সময় বাধার প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে
মাথা তোলেই। সত্যের এটা নিজস্ব শক্তি। সত্যের এই শক্তিই আব্দুল কাদের
মোল্লাকে একদিন নির্দোষ প্রমাণ করতে পারে। আব্দুল কাদের মোল্লার উন্নতশির
চলে যাওয়া সঅর্থে সবার কাছে একদিন দেদীপ্যমান হয়ে উঠবে, এই প্রত্যাশা
আমাদের।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন