বাংলাদেশের
মুক্তিযুদ্ধে গনহত্যায় পর্দার আড়াল থেকে কলকাঠি যিনি নেড়েছেন তিনি জুলফিকর
আলী ভুট্টো। ২৫শে মার্চের গনহত্যার পুরো ছক ছিল ভুট্টোর নিজের করা যা
পরবর্তীতে জেনারেল নিয়াজীর ‘The Betrayal of East Pakistan’ বইয়ে
স্বীকারোক্তি আকারে উঠে আসে। সেখানে নিয়াজী স্বীকার করেন যে পুরো গনহত্যার
তত্ত্বাবধান করেন মিস্টার ভুট্টো।
জেনারেল নিয়াজী লিখেন, যা
নির্দেশিত হয়েছিল (ম্যাসিভ ক্র্যাকডাউন) তা কেমনভাবে সম্পন্ন হচ্ছে সেটা
দেখার জন্য ভুট্টো আরও কয়েক ঘণ্টা (ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগের পর) অপেক্ষা করেন
এবং নিজের কানেই শুনতে পান সাধারণ মানুষের আকাশবিদারী করুণ ক্রন্দনরোল,
দাহ্য দ্রব্যের আওয়াজ, গতিশীল ট্যাঙ্কের কর্কশ গোঙানি, মেশিনগানের মর্মভেদী
ভীতিকর আওয়াজ। পরদিন (২৬ শে মার্চ) ভোরে ভুট্টো ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে
টিক্কা, রাও ফরমান আলী এবং আরবাবকে তাদের পিঠ চাপড়ে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন,
‘‘যা দরকার ছিল তাই করা হয়েছে।’’
পাকিস্তান দ্বিখন্ডিত হওয়ায়
পশ্চিম পাকিস্তানের যে ব্যক্তিটি সবচেয়ে বেশী লাভবান হন তিনি হলেন ভুট্টো।
পরবর্তীতে তিনি প্রেসিডেন্টও নির্বাচিত হয়েছিলেন। কোন এক অজ্ঞাত কারনে
মরহুম রাষ্ট্রপতি শেমু রহমানের সাথে ছিল তাঁর নিদারুন সখ্য। মুক্তিযুদ্ধের
ইতিহাস অধ্যয়ন করতে গিয়ে এই বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশী কষ্ট দেয় যে গনহত্যার
প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধায়কের সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির অতি উষ্ণ
সম্পর্ক। তাঁদের দুজনার গলাগলি, হাত ধরাধরির ছবি খুঁজে পেতে খুব বেগও পেতে
হয় না, ইন্টারনেটের সৌজন্যে তা এখন হাতের নাগালেই। উল্লেখ্য যে মরহুম শেমু
রহমানের সাথে ভুট্টো সাহেবের সৌহার্দ্যপূর্ন সম্পর্কের সৌজন্যেই পাকিস্তান
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে।
একাত্তরের গনহত্যার
মূল পরিকল্পনাকারী ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধায়ক ভুট্টো সাহেব ১৯৬৭ সালে
পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) গঠন করেন। বর্তমানে সংসদে পিপির ৪৪ জন
(মোট ৩৪২) প্রতিনিধি রয়েছেন। বিগত ১৬ ডিসেম্বর, পাকিস্তানের সংসদে
পাকিস্তান তেহরিক ই ইনসাফের নেতা ও জনপ্রিয় সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খান
আব্দুল কাদের মোল্লা সাহেবের হত্যাকান্ডের নিন্দা ও শোক প্রস্তাবকে সমর্থন
করেন যা পাকিস্তান জামায়াতের এক সাংসদ কর্তৃক উত্থাপিত হয়েছিল। ভুট্টো
সাহেবের পিপিপি পুরো বিষয়টিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন বিষয় বলে এড়ানোর পক্ষে
এ প্রস্তাবটির বিরোধিতা করে।
ইমরান খান পাকিস্তানের সেই হাতে
গোনা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে একজন যিনি একাত্তরে পাকিস্তানের ঘৃণ্য
কর্মকান্ডকে স্বীকার করেন গনহত্যার জন্য পাকিস্তান সরকারকে ক্ষমা চেতে
আহ্বান জানিয়েছেন। একদিকে গনহত্যাকারী ভুট্টোর দল, অন্যদিকে অপরাধ না করেও
ক্ষমাপ্রার্থী ইমরান খান। অথচ মজার বিষয় হল, ইমরান খান, যিনি কিনা
বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং সজ্জন হিসেবে পরিচিত তিনিই আব্দুল কাদের
মোল্লা প্রসঙ্গে আব্দুল কাদেরের পক্ষালম্বন করলেন। অথচ গনহত্যাকারী
ভুট্টোর দল আজ বাংলাদেশ সরকারের সাথে সুর মিলিয়ে ‘রাজাকার’ এর ফাঁসির পক্ষে
শ্লোগান দিয়ে গেলেন। অথচ হিসেব অনুযায়ী একাত্তরের গনহত্যা পরিচালক ভুট্টোর
প্রতিষ্ঠিত পিপিপি-ই বরং আব্দুল কাদেরের পাশে দাঁড়াবেন আর গনহত্যার
বিরোধিতাকারী ইমরান খান আব্দুল কাদেরের ফাঁসিতে উল্লাস প্রকাশ করবেন।
কিন্তু নাটকের চিত্র এরকম উল্টো কেন হল? উত্তর অনেকগুলো আছে। আপনি আপনার মত
বেছে নিতে পারেন।
(১) আব্দুল কাদের সত্যই রাজাকার ছিলেন না, একারনে পিপিপি-র তার জন্য মায়া নেই।
(২) ভুট্টো-শেমু রহমান ঐতিহাসিক বন্ধুত্বের ‘ডিজিটাল’ নিদর্শন।
(৩) নিজের পিঠ বাঁচানো
৩ নম্বর পয়েন্টটি একটু ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন বোধ করছি। ভুট্টো সাহেব এবং
তার দল ভাল করেই জানেন যে কারা যুদ্ধাপরাধী আর কারা নন। সুষ্ঠু বিচার হলে
কারা কিভাবে ফেঁসে যাবেন তাও তাঁদের অজানা নয়। আন্তর্জাতিক গনমাধ্যম কর্তৃক
প্রমানিত রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ‘বিচারে’ তাই তাঁদের আকুণ্ঠ সমর্থনে আমি
মোটেই বিস্মিত নই। নিজেদের নির্দোষ প্রমান করতে জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধী
বানানো ছাড়া কোন উপায়ন্তর যে তাঁদের সামনে নেই! আজ যদি সত্যিই বিচার করা হয়
তাহলে আব্দুল কাদের মোল্লার বিরোধিতাকারী পাকিস্তানের ভুট্টো ও তাঁর দল
এবং এদেশে তাঁর বন্ধুবর মরহুম শেমু রহমানের উত্তরাধিকারীদের প্রত্যেকের
গলায় ম্যানিলা রোপ থাকত যদিওবা দুই নাটের গুরু বহু আগেই পরপারে পারি
দিয়েছেন।
তবে একটি বিষয় আমাকে অত্যন্ত আনন্দ দিচ্ছে যে আদালতের
স্বাক্ষ্য-প্রমান কিংবা অন্যান্য আইনগত দিক দিয়ে আব্দুল কাদের মোল্লাকে
একাত্তরের কসাই কাদের বানানো সম্ভব হয় নাই। তাই তাঁর মৃত্যুর পরের একটি
ঘটনাকে পুঁজি করে তাঁকে রাজাকার সাব্যস্ত করা হচ্ছে। তাদের যুক্তি, যেহুতু
পাকিস্তান কাদের মোল্লার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছে সেহুতু কাদের মোল্লা
রাজাকার। এখানে আমি দু’টো বিষয় লক্ষ্য করতে পারছি। প্রথমত, তাদের যুক্তি
মোতাবেকই, যেহুতু গনহত্যাকারী ভুট্টোর দল পিপিপি কাদের মোল্লার হত্যাকান্ডে
সমর্থন জানিয়েছে সেহুতু কাদের মোল্লা রাজাকার ছিলেন না। দ্বিতীয় বিষয়টি
বলার আগে একটি ছোট্ট গল্প বলছি,
এক খুনী ডাকাত জীবনে একশো’টি
খুন-ডাকাতি করার পর ভাল হয়ে যাবার সংকল্প করল। সে প্রতিজ্ঞা করল যে সে আর
কখনো কোন মানুষ মারবে না, কাউকে হত্যা করবে না। কিন্তু কিছুদিন পরই সে তার
প্রতিজ্ঞা ভাঙতে বাধ্য হল। এক লোক কবর হতে মৃত মহিলার লাশের সাথে সঙ্গম
করতে থাকলে সে ঘৃণায় ঐ লোকটিকে হত্যা করে। এরপর বলে, হে আল্লাহ! আমি জীবনে
অনেক খারাপ কাজ করেছি কিন্তু এতটা খারাপ কাজ আমার মত বদ মানুষের পক্ষেও
বরদাশত করা সম্ভব না।
হাসিনা ওয়াজেদ বিচার বিভাগের ওপর বন্দুক
রেখে আব্দুল কাদেরকে হত্যা করে কতটা খারাপ কাজ করেছেন তা পাকিস্তানের শোক
প্রস্তাবের মাধ্যমে হয়তবা আমাদের বোধগম্য হচ্ছে। পাকিস্তানের মত দেশ, যারা
একাত্তরে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম ঘৃণ্য গনহত্যার পরিচালনাকারী তারাও এধরনের
হত্যাকান্ডে মুখ খুলেছে! আশরাফ আজিজ ইশরাক ফাহিম
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন