আফজাল বারী : চতুর্মুখী চাপে সরকার। এই চাপ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের, অভ্যন্তরীণ ও বহির্বিশ্বের। তিল তিল করে জমে ওঠা চাপা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে নিরাপত্তার চাদরে মোড়ানো সচিবালয়েও। রাষ্ট্র পরিচালনায় ও সুবিধার ভাগিদার শরিকরাও মৃদু ¯স্নায়ুচাপ দিচ্ছে সরকারকে। সরকার বিরোধী চলমান আন্দোলনে অর্থনীতির চাকাও ইস্পাতকঠিন খিল এঁটেছে; যার ফলে ব্যবসায়ীরাও চাপে রেখেছে ক্ষমতাসীনদেরই। দেশে চাহিদা মতো পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ক্রমাগত। হাতছাড়া হয়েছে ৫০ কোটি মার্কিন ডলারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ ফান্ডের (এমসিএফ) অর্থসহায়তা। ধসের মুখে পতিত দেশি বিনিয়োগকারীরা।
সংঘাত, খুনাখুনি, গুম, গুলি, মানুষ মারার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসংঘ কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, মানবাধিকার যেন লঙ্ঘিত না হয়। গত এক বছর আগেও প্রতিবেশী দেশ যেভাবে অবারিত সমর্থন দিয়েছে এখন তারা বদল করেছে ওই রেখা। এবার প্রতিবেশী দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানিয়েছেন, প্রতিবেশী বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাবে না ভারত।
এদিকে সরকারের অনড় অবস্থান, এমপি-মন্ত্রীদের বক্তব্য-মন্তব্য, সমালোচিত ও নেতিবাচক ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রতিদিনই আন্দোলনের সঙ্গী বাড়ছে বিএনপির। যারা এক সময় সরকারের বন্ধুর সারিতে ছিল তারা দাঁড়িয়েছে বিপরীত কাতারে। চলমান পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নূরুল আমিন বেপারী বলেন, রাষ্ট্রের ভালো কাজের বাহবার মতো নেতিবাচক কাজের দায়ভারও নিতে হবে। অবস্থাদৃষ্টে সরকারের দিন কাটছে অনেকটা চাপেরমুখে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক বদরুদ্দীন ওমর-এর মতে, দায়টা বেশি নিতে হয় যারা পরিচালকের আসনে থাকেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আন্দোলনকারী বিএনপির চেয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগই ঘরে-বাইরে সর্বত্রই বহুমাত্রিক চাপে আছে।
গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে আন্দোলন তুঙ্গে উঠে নির্বাচনের পরে নিভে যায়। একবছর পর গত ৫ জানুয়ারি তপ্ত হয়ে ওঠে দেশের রাজনীতি। ওই নির্বাচনকে একতরফা, অবৈধ আখ্যা দেয় বিএনপি ও তার মিত্রদলগুলো। তারা আরেকটি নির্বাচনের জন্য গত এক বছর ধরেই নানা আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেছে। তবে ঢাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। গুম, খুন, অপহরণ, মামলা-হামলাসহ গত ২৭ ডিসেম্বর গাজীপুরে সরকারপন্থী ও সরকার বিরোধীরা পাল্টাপাল্টি সভা- সমাবেশের কর্মসূচিতে অনড় থাকায় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সংঘাত-সংঘর্ষে রূপ নেয়। এদিকে গত ৫ জানুয়ারি সরকারের বর্ষপূর্তিতে ‘গণতন্ত্র রক্ষা ও হত্যা’ দিবস ঘিরে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দেশে জ্বলন্ত রাজনীতি আরো ভয়াবহতার দিকে যায়। ওইদিনের আগেই বিএনপি চেয়ারপারসনকে গুলশানে নিজ কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করা, যানবাহন মালিক কর্তৃপক্ষের অঘোষিত ধর্মঘট এবং অবরুদ্ধনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ঘোষিত অনির্দিষ্টকালের অবরোধ, আন্দোলনকারীদের পুলিশের গুলি, পাল্টা আঘাত, নিহত, আহত, গাড়ি ভাঙচুর, নেতাদের বাসা-গাড়ি-বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, সচিবালয়ে সরকার বিরোধী লিফলেট সর্বশেষ সাবেক প্রতিমন্ত্রীকে গুলির ঘটনা নাড়া পড়েছে সর্বত্রই।
চাপ দিচ্ছে ব্যবসায়ী ও শ্রমজীবী
রাজনৈতিক সঙ্কটে বিদেশি বিনিয়োগে যেমন ছেদ পড়েছে, তেমনি দেশের ব্যবসায়ীরাও টিকে থাকার লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছেন। ২০১৩ সালের পুরো সময়ই বস্ত্রশিল্পে ঝড় বয়ে গেছে। ঐক্যবদ্ধভাবে তা মোকাবিলা করতে পেরেছে কিন্তু পরিস্থিতি এখন যেদিকে যাচ্ছে তাতে এই শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট মালিক, শ্রমিক সবাই হতাশগ্রস্ত, ক্ষুব্ধ ও আতঙ্কিত। শীর্ষ ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই অবরোধের শুরুতেই এক বিবৃতিতে বলেছিল, রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রতিবাদে আমরা রাজপথে নামবো। পরে এক সংবাদ সম্মেলনে নেতারা বলেন, আমাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। আমাদের অবস্থা পানিতে পড়া মানুষের মতো। শেষ কিছু একটা ধরে বাঁচার চেষ্টা করছি। এই অবস্থায় আমাদের যা করার করবো। আমাদের জিম্মি করে রাজনীতিবিদদের রাজনীতি করার সুযোগ দেব না। দ্রুত এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, তারা হরতাল-অবরোধের বিষয়ে সরকারের সাথে যোগযোগ করেছে কোনো লাভ হয়নি। প্রয়োজনে ২০ দলীয় জোটনেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করবো। চলমান অবস্থায় আমাদের শ্রমিকদের বেতনসহ কারখানার নিয়মিত খরচের বোঝা আমরা বইতে পারবো না। এই দায় রাজনীতিবিদদের নিতে হবে। এ কথা আমরা সরকারকেও জানিয়েছি।
সমালোচনায় সুবিধাভোগী শরিকরাও বিরাজমান সঙ্কট নিরসনে করণীয় নিয়ে গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত ১৪ দলের বৈঠকে সরকারের প্রধান দল আওয়ামী লীগের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছে কয়েক শরিক। জেপি, ন্যাপ, বাসদ, কমিউনিস্ট কেন্দ্র এবং তরিকত ফেডারেশন নেতৃবৃন্দ সরকারকে বিএনপির সাথে আলোচনার জন্য তাগিদ দেন। দ্রুত সময়ের মধ্যে আলোচনার জন্য সরকারকেই উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান ১৪ দলীয় জোটের এই শরিকরা।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব (জেপি) শেখ শহিদুল ইসলাম সরকারদলীয়দের উদ্দেশ্যে বলেন, বিএনপিকে স্কেপ রুট দিতে হবে। রাজনৈতিক দল হিসেবে আলোচনার পথ রুদ্ধ করা ঠিক হবে না। ‘আলোচ্য বিষয়’ যাই হোক আলোচনার জন্য শরিকদের এই উদ্যোগের কারণে বেশ চাপে সরকারদলীয়রা।
এদিকে চোরাগোপ্তা হামলায় বিরোধীদলীয় নেতারা হতাহত হলেও ভবিষ্যতে যে সরকারদলীয় নেতৃবৃন্দ হবেন না তার গ্যারান্টি কী- এমন প্রশ্ন সরকারদলীয়দের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। সরকারের শরিক ও এমপি মাইনুদ্দিন খান বাদল নির্ধারণ করে দিয়েছেন আগে-পরে কোথায় গুলি করতে হবে। বিজিবির ডিজিও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের (গুলি) নির্দেশ দিয়েছেন। ওই এমপির দিকনির্দেশনার পরই সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমানের পায়ে এবং বুকের নিচে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। এই (গুলি) দুই নির্দেশকের ভূমিকা নিয়ে সাধারণ মানুষসহ দেশে সুশীল এবং বহির্বিশ্বের মোড়ল দেশের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মহল
গত ৫ জানুয়ারির আগে থেকেই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে নানামুখী চাপে ছিল মহাজোট সরকার। অবশ্য সাংবিধানিক বাধ্যবাদকতার কারণ দেখিয়ে নির্বাচন ও সরকার গঠন করেছে। কিন্তু সেই চাপ কমেনি বরং বহুমাত্রায় সরকারকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরেছে। বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলো গত নির্বাচনের বৈধতা দেয়নি। সরকারের চলমান নেতিবাচক কর্মকা-, বিরোধীদের আন্দোলন, মৌলিক ও মানবাধিকার, গুম, খুন, অপহরণ, খ্যাতনামা রাজনীতিককে হত্যা প্রচেষ্টা, ক্ষয়িষ্ণু গণতন্ত্র, আইনের শাসনসহ বিভিন্ন ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সর্বশেষ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার সরকার ও বিরোধী পক্ষের প্রতিনিধি ও দায়িত্বপ্রাপ্তদের সাথে বৈঠক করেছেন ইইউসহ পশ্চিমা বিশ্বের কূটনীতিকদের একটি দল। তারা বিরোধী পক্ষকে যেমন সংঘাতমুক্ত আন্দোলন করার পরামর্শ দিয়েছেন। তেমনি সরকারকেও জনগণের মৌলিক অধিকার এবং রাজনৈতিক দলের গণতান্ত্রিক অধিকার দেয়ার জন্য জোর দাবি জানান। চলমান ঘটনাসহ সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাকে গুলি, সারাদেশে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, নিহত-আহতের ঘটনায় স্তম্ভিত, মর্মাহত, ক্ষুব্ধ ও নিন্দা প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। সরকারকে এই সঙ্কটের পথ খুঁজে বের করতে সংলাপের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছে।
এদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারতের রাষ্ট্রদূতের সাথে বৃহস্পতিবার রাতে নৈশভোজে মিলিত হন সরকারের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা তারেক আহমেদ সিদ্দিকী ও সরকারের শরিক দল জাপা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। নৈশভোজ হলেও তাতে রাজনৈতিক আলাপ হতেই পারে এমনটি ধারণা করছেন বোদ্ধারা।
এদিকে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে ইতোমধ্যে ইইউর অর্থায়নে পরিচালিত ‘স্ট্রেংদেনিং পাবলিক ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম’ (এসপিএমপি)-টি আর অব্যাহত রাখতে চান না বলে জানিয়ে দিয়েছে ইইউ। এসপিএমপি প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছেন, বাজেট প্রণয়ন ও ব্যয়সংক্রান্ত এটি একটি সংস্কার কর্মসূচি। এ ধরনের সংস্কার কর্মসূচি দীর্ঘমেয়াদে অব্যাহত থাকা উচিত। এ সিদ্ধান্তটিকেও চাপ বলে ধারণা করছেন মন্ত্রীসহ অর্থনীতিবিদরা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন