চলতি সপ্তাহেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চায় সরকার। বিএনপি জোটের টানা অবরোধে সহিংসতা ও নাশকতা দমনে সাত দিনের চূড়ান্ত ছক নিয়ে মাঠে তৎপর হয়েছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ইতিমধ্যে দেশের কোথাও কোথাও এ অভিযান শুরুও হয়েছে। ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি সারাদেশের তালিকাভুক্ত অন্তত এক হাজার বিএনপি নেতাকে গ্রেফতার করা হতে পারে।
একটি সূত্র জানায়, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে প্রয়োজনে বিএনপির সব কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেফতার করা হবে। এর পাশাপাশি প্রয়োজনে সারাদেশে বিজিবি মোতায়েন করে বিশেষ অভিযান পরিচালনার প্রস্তুতিও সরকারের আছে। এক সপ্তাহের (মিশন সেভেন ডে’জ) মধ্যে যে কোনো মূল্যে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে যা যা করণীয় তার সব কিছুই করবে সরকার। এটা সরকারের কঠোরতার প্রাথমিক ধাপ। নাশকতা না থামালে পর্যায়ক্রমের কঠোরতার মাত্রা আরো বাড়বে। একাধিক গোয়েন্দা ও সরকারের মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বেশ কিছু সূত্র মানবকণ্ঠকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যায়ে গ্রেফতার করা নেতাকর্মীদের কমপক্ষে তিন মাস জামিন না পাওয়ার মতো পদ্ধতি অনুসরণ করে মামলা দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ওই সূত্রটি আরো জানায়, সরকারের একটি অনুসন্ধানে উঠে এসেছে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার করা হলেও মামলা দুর্বল থাকার কারণে সপ্তাহ খানেকের ব্যবধানে জামিন মিলছে। ফলে অভিযুক্তরা জেল থেকে বেরিয়েই আবার নাশকতায় জড়িয়ে পড়ে। এজন্যই গত বৃহস্পতিবার ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদকসহ তিনজনকে গাড়ি পোড়ানোর মামলায় তিন মাসের কারাদণ্ড দিয়েছে সরকার। সূত্র জানায়, অবরোধে নাশকতা চলছে এমন জেলাগুলোতে বিজিবির সংখ্যা আরো বাড়ানো পরিকল্পনা রয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। প্রতি রাতেই তল্লাশি করার নির্দেশনার পাশাপাশি পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির যৌথ অপারেশন চলবে জেলাগুলোতে। এর পাশাপাশি ১৪ দলের নেতারাও শান্তির সমাবেশ নিয়ে মাঠে থাকবেন। সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিকেও মাঠে নামানোর চিন্তা রয়েছে সরকারের।
সরকারের কঠোরতার প্রমাণ মেলে বিজিবি প্রধান মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদের হরতাল ও অবরোধে নাশকতাকারীদের প্রতিরোধে, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তায় এবং আত্মরক্ষার প্রয়োজনে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) প্রয়োজেনে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করবে- এমন ঘোষণার মধ্য দিয়ে। গতকাল রংপুরে পুলিশের মহাপরিচালক একেএম শহীদুল হক ও র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদও কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন অবরোধকারীদের। শহীদুল হক চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেন, সংবিধানের কোথাও হরতাল অবরোধের কথা নেই। আর বেনজীর আহমেদ বলেছেন, নাশকতাকারীদের কোনো ছাড় দেয়া হবে না। নাশকতাকারীদের উদ্দেশে র্যাব প্রধান বলেছেন, জীবনটাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসো আমরা কাউকে ছাড় দেব না।
সরকারের এক সপ্তাহের সিদ্ধান্তের কথার প্রতিফলন ঘটেছে সুরঞ্জিত সেনের বক্তব্যেও। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার আন্দোলনকে ভুয়া আখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে আপনা-আপনি এ আন্দোলন বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি নিজেই (খালেদা জিয়া) বাসায় চলে যাবেন।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আন্দোলনকে ছাড় দেয়া যায়, নাশকতাকে ছাড় দেয়া যায় না। তাই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে সরকার খুব শিগগিরই সফল হবে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, আগামী ২৬ জানুয়ারি ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে। প্রতিবেশী ভারত ও মার্কিন প্রেসিডেন্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এ সময়ে বিএনপি জোট বড় রকমের নাশকতা করতে পারে। দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর আস্থাহীন হয়ে দলের তৃণমূল পর্যায়ের বিএনপি নেতাকর্মীদের কাছে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে এ সময়ে নাশকতার কঠিন বার্তা দিয়েছেন বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে। তাই চলতি সপ্তাহকেই সরকার টার্গেট করেছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে।
এছাড়া এমপিদের মূল নেতৃত্বে রেখে স্থানীয় পর্যায়ে সন্ত্রাস প্রতিরোধ ও শান্তিরক্ষায় কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে ১৪ দলের পক্ষ থেকে। বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় ১৪ দলের কমিটি গঠন হচ্ছে। এ ছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আগের যেসব কমিটি রয়েছে সেগুলোতে ১৪ দলের নেতাকর্মীদের যুক্ত করারও সিদ্ধান্ত হয়েছে। কমিটি পুনর্গঠন করে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী অপরাধীদের ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ১৪ দলের নেতারা। গত বৃহস্পতিবার জোটের এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
সরকারের একাধিক সূত্র জানায়, কূটনীতিকদেরও এবার দৌঁড়ঝাপের সুযোগ দেবে না সরকার। বিএনপির গত দুই সপ্তাহের আন্দোলনকে নাশকতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় সরকার। কূটনীতিকরাও এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন। একে তারা নাশকতা হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। তাই নাশকতা দমন সরকারের দায়িত্ব। এছাড়া নাশকতার দায়ভারও বিএনপি-জোট সরকারের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছে। বোমাবাজদের গুলি করার সিদ্ধান্তের বিপরীতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বিবৃতির বিষয়টি সামনে এনে সরকার এটা প্রমাণ করতে চায় যে আসলে এসব নাশকতা বিএনপিরই।
সরকারের সূত্র জানায়, সরকার শুরু থেকে কঠোরতার নানা হুমকি দিলেও এতদিন কঠোরতার কিছুই করা হয়নি। এখন সরকারকে কঠোর হওয়ার ক্ষেত্র বিএনপি নিজেরাই তৈরি করে দিয়েছে। সরকারের বিভিন্ন মহল মনে করছে, বিএনপির আন্দোলন ইতিমধ্যে সর্বত্র নাশকতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রংপুরে পাঁচজন জীবন্ত দগ্ধ হওয়াসহ সারাদেশে নাশকতার কারণেই ২০ জনের বেশি নিহত হয়েছে। এ সংক্রান্ত নাশকতার বিভিন্ন ফুটেজও সরকার কূটনীতিকদের কাছে পাঠিয়েছে। তুলে ধরেছে বিএনপির মার্কিন ছয় কংগ্রেসম্যানের স্বাক্ষর জালের মতো মিথ্যাচারের বিষয়টিও। তাই এবার সাত দিনের মধ্যে সরকারের কঠোরতার একটি পর্যায় দেখতে পারে বিরোধী জোট। আওয়ামী লীগের এক সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মানবকণ্ঠকে বলেন, বিএনপি হয়তো ভাবতেও পারবে না সরকার কতটা কঠোর হতে পারে।
সূত্র জানায়, এতদিন বিএনপির নেতাদের গ্রেফতার করা হলেও নতুনভাবে ২০ দলীয় জোটের নেতাদের ওপরও কড়া নজরদারি চলছে। ২০ দলীয় জোটের কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রেফতারের একটি তালিকা করা হয়েছে। তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। কর্মী না থাকার পরও লেবার পার্টির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান ইরানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কানসাটে র্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে এক ছাত্রদল নেতা।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আরেকটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, কঠোর অবস্থানের পাশাপাশি সর্বোচ্চ ছাড় দেয়ারও পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এ পরিকল্পনা অংশ হিসেবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সমাবেশের অনুমতি চাইলে তা তাদের দেয়া হবে।
উৎসঃ manabzamin
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন