পৃথিবীতে যে কয়টি কষ্টের এবং বেদনার শব্দ আছে, মৃত্যু শব্দটি এর মধ্যে অন্যতম এবং ভয়ংকর। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে জীবন কিংবা প্রানের সমাপ্তি। মৃত্যু প্রানিকে এমন এক জগতে নিয়ে যায় যেখান থেকে আর ফেরা যায়না। আবহমান কাল থেকেই আমাদের পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবন ব্যাবস্হায় এই মৃত্যু নিত্য সঙ্গী একটি শব্দ। প্রতিদিন সংবাদ পত্রের পাতায় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এত মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় যে এত ভয়ংকর কষ্টের শব্দটিও গা সহা স্বাভাবিক শব্দে পরিণত হয়ে যায়। কিন্তু কিছু কিছু মৃত্যু এবং মৃত্যুর খবর যেন এই স্বাভাবিক জীবন যাত্রা কে থামিয়ে দেয়, মুহূর্তের জন্য হলেও স্তব্ধ করে দেয় রক্ত চঞ্চালন ক্রিয়া।হৃদয়ের স্পন্দন যেন থমকে থমকে দাঁড়াই। কষ্ট এবং বেদনার তীব্রতায় মুষড়ে যেতে থাকে চেতনা। হৃদপিণ্ডে সৃষ্টি হয় বিশাল ক্ষতের। ভাষা কিংবা এর ভাব ধারায় হয়তো একটি মৃত্যু এবং মৃত্যুর খবরের কষ্ট এবং যন্ত্রণার বর্ণনা হয়তো আরও হৃদয় বিদারক কিংবা মর্মস্পর্শী করে উপস্হাপন করা যাবে। পৃথিবীতে এখনো এমন কোন ভাষা কিংবা বর্ণমালার সৃষ্টি হয়নি যার মাধ্যমে স্বজন কিংবা প্রিয় জনের মৃত্যুর কষ্ট, বেদনা এবং হৃদয়য়ের যন্ত্রণার উপলব্ধি বর্ণমালায় প্রকাশ করা যায়। এটা শুধুই উপলব্ধি করতে পারেন মৃতের স্বজন।
প্রিয় পাঠক, গত শনিবার ২৪ জানুয়ারী বাংলাদেশ সহ বিশ্বের আনাছে কানাছে বসবাসকারী প্রতিটি বাংলাদেশী নাগরিককে যে মৃত্যু সংবাদটি হৃদয় ছুঁয়েছে তা হল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক এবং প্রথম প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান এবং বাংলাদেশের তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠ ছেলে জনাব আরাফাত রহমান কোকোর অসময়ে এবং অকাল মৃত্যু। বি এন পি পরিবারের প্রতিটি নেতা, কর্মী এবং সমর্থকদের জন্য এ সংবাদটি ছিল একটি শেলের মত যা হৃদয়ে বিধেছে আর যন্ত্রণায় চটপট করেছে শোকের ছায়া নেমে এসেছে সর্বত্র। যে মহীয়সী রমণীর গর্ভে তিনি জন্ম গ্রহন করেছেন, যে বড় ভায়ের হাত ধরে শৈশব, কৈশোর এবং জীবনের স্মৃতি ময় দিন গুলি কাটিয়েছেন, যে ভালবাসার সন্তানের তিনি পিতা, যে প্রিয়তমা নারীর তিনি স্বামী, সেই মা, সেই বড় ভাই, সেই স্ত্রী সন্তান এবং আপনজনদের হৃদয়য়ের রক্ত ক্ষরণ, মানসিক যন্ত্রণার ভারসাম্যতা, ব্যাথা এবং কষ্টের অনুভূতি গুলির উপলব্ধি শুধু তারাই জানেন। এ উপলব্ধি শুধু তারাই অনুভব করেন যারা প্রিয়জনকে হারিয়েছেন।
জনাব আরাফাত রহমান ইন্তেকাল করেন মালাশিয়াতে। তাঁর মৃত্যুটি ছিল খুবই আকস্মিক। তাঁর মৃত্যু সংবাদটি যখন বাংলাদেশে পৌছে তখন তাঁর প্রিয় বাংলাদেশ একটি অগ্নিগর্ভ। গত ৫ জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশে যে আন্দোলন, অবরোধ চলছে তার একটি চূড়ান্ত সময়ের দিকে যখন আন্দোলন গতি পাচ্ছে, যখন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তাঁর অফিসে অবরুদ্ধ, যখন প্রতিদিন বন্দুকের গুলীতে প্রান হারাচ্ছে দলের নেতা কর্মীরা,শত শত নেতা কর্মী যখন জেলে বন্দী, হাজার হাজার মানুষ গ্রেফতার আর গুম আতঙ্কে ঘর বাড়ী ছাড়া, যখন সরকারী বাহিনী এবং তাদের এজেন্টরা আগুনে পুড়িয়ে মারছে দেশের মানুষ তখন দখলদার হাসিনা চক্র ভেবে ছিল এই বুঝি আন্দোলন শেষ। কিন্তু দেশনেত্রী আবারো প্রমাণ করলেন তিনি শুধু একা আরাফাত রহমান কোকোর মাতা নন, তিনি শত সহস্র নেতা কর্মী যারা জীবন দেয়ার জন্য প্রতিদিন রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে তাদেরও তিনি জননী। যে জনি, জিশানদের মৃত্যুতে যেমন আন্দোলন থেমে থাকে নি তেমনি দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার গর্ভের আদরের ছোট সন্তানের মৃত্যুতেও আন্দোলন থেমে থাকবে না। বেগম খালেদা জিয়া তাঁর অসুস্হ্য শরীর, শোকাছন্ন মন এবং হৃদয়য়ের রক্ত ক্ষরণ নিয়েও ইস্পাত কঠিন মনোবল, অবিচল আস্হা, দৃঢ় বিশ্বাস এবং একটি মাত্র লক্ষ্য দেশ, দেশের মানুষ, দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য হাসিনার পতন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন।
বাংলাদেশের অবৈধ প্রধান মন্ত্রী দখলদার হাসিনা সমবেদনা জানাতে গিয়েছিলেন পুত্রশোকে কাতর বেগম খালেদা জিয়াকে তাঁর গুলশান অফিসে যেখানে ২১ দিন যাবত তাঁকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। দিনের যে সময়টাতে বেগম খালেদা জিয়া তাঁর পুত্রের মৃত্যু সংবাদে চোখে বইছে কান্নার অশ্রু ধারা, হৃদয়ে হচ্ছে রক্ত ক্ষরণ সে সময় দখলদার হাসিনার নির্দেশেই প্রতিহিংসামূলকভাবে যাত্রাবাড়ীতে বাস পোড়ানোর ঘটনার হুকুমের আসামি করে মামলা দেওয়া হয় তাঁর বিরুদ্ধে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে নিষ্ঠুরতা এবং অমানবিকতার জঘন্যতম উদাহরণ সৃষ্টি করে মনুষত্বের সর্বনিন্ম রুচির পরিচয় দিয়ে অবরুদ্ধ খালেদা জিয়াকে তাঁর অফিসে গিয়ে সমবেদনা জানানোর ঘটনা পুত্রশোকে কাতর এক মায়ের সাথে মশকরা ছাড়া কিছুই না। শেখ হাসিনাকে পূর্বেই জানানো হয়েছিল যে খালেদা জিয়া ইঞ্জেকশানের প্রভাবে ঘুমিয়ে আছেন, তা জেনেই তিনি গাড়ী বহর নিয়ে দ্রুত গুলশান অফিসে পৌছেন নোংরা রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার জন্য নাটক করার। নাটকের স্ক্রিপ্ট পূর্বেই রচিত ছিল মঞ্চায়নের জায়গা খালেদা জিয়ার গুলশান অফিসে পৌছা মাত্র শুরু হয় এ্যাকশন। শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারি শাকিল যখন খালেদা জিয়ার ব্যাক্তিগত সহকারী শিমুল বিশ্বাসের সাথে কথা বলে শেখ হাসিনাকে ইশারায় নিশ্চিত করলেন খালেদা জিয়া ইঞ্জেকশানের প্রভাবে ঘুমিয়ে আছেন, দেখা হচ্ছে না তখনই নাটকের যবনিকা পর্ব মঞ্চায়নের জন্য শেখ হাসিনা তাঁর পারিষদ নিয়ে গাড়ী থেকে নামলেন। মৃদু হেঁটে ফটকের দিকে অগ্রসর হলেন, ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ার সামনে ফটো সেশন হল, মুখে নাটকের সফল পরিসমাপ্তির তির্যক মুচকি হাসি নিয়ে তিনি ফিরে গেলেন ব্যার্থতা নিয়ে নয় কুটিল রাজনীতির পূর্ণ সফলতা নিয়ে।
অনাদিকাল থেকেই আমাদের জীবন সংসার এবং সমাজ ব্যাবস্হায় শোকাতুর মানুষকে সমবেদনা, সহমর্মিতা জানানোর রীতি প্রচলিত আছে। যদি শেখ হাসিনা সত্যিকার অর্থে সহমর্মি হয়ে পুত্রশোকে আচ্ছন্ন খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে গুলশান অফিসে যেতেন তাহলে সে দিন এক শোকে কাতর মায়ের নামে জঘন্য মিথ্যা এবং বানোয়াট মামলা দিতেন না। অবরুদ্ধ খালেদা জিয়ার অফিসে না গিয়ে মুক্ত খালেদা জিয়ার বাস ভবনে যেতেন। শেখ হাসিনা সংবেদনশীল কিংবা সহমর্মি হয়ে সমবেদনা প্রকাশ করার চেয়ে রাজনীতি করতে বেশী পছন্দ করেন। তাই দেখা যায় শেখ হাসিনা সমবেদনার নামে গুম হওয়া ইলিয়াস আলীর শিশু কন্যার সাথে আদরের বাবাকে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেও তা রাখেননি। সহমর্মিতায় উত্তাল হয়ে সাগর-রুনির এক মাত্র সন্তান মেঘের দায়িত্ব নিয়ে শেখ হাসিনা বেমালুম ভুলে গেলেন সাগর-রুনির হত্যাকারীদের বিচারের কথা। তাই মানুষের প্রতি সংবেদনশীলতা, সহমর্মিতা কিংবা সমবেদনা প্রকাশ শেখ হাসিনার জন্য কুমীরের কান্না।
শোকাচ্ছন্ন খালেদা জিয়ার গুলশানের অফিসের ফটক থেকে শেখ হাসিনার ফিরে আসাতে কে কত লাভবান হয়েছেন তার হিসাব নিকাশ শুরু করেছে সরকারের পালিত কিছু সংবাদ মাধ্যমের চেতনা ও বুদ্ধিব্যাসায়ীরা। রাজনীতির কুটিল চাল এবং মার প্যাঁচের হিসাবে শেখ হাসিনায় হয়তো সফল হয়েছেন। কিন্তু এতে সম্মানিত হয়েছে মৃত আরাফাত রহমানের বিদেহী আত্মা। যার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ হস্তক্ষেপে আরাফাত রহমানকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হয়েছে বিদেশের মাটিতে।যার কারণে গত আট বছর যাবত মা এবং ভায়ের স্নেহ থেকে তিনি বঞ্চিত, যার মুখের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ বিদেশে থেকেও শুনতে হয়েছে প্রতিনিয়ত, সে মুখ থেকে সমবেদনার বাণী অসম্মানিত করবে তাঁর রেখে যাওয়া স্বজনদের, আন্দোলনরত দেশের মানুষদের।
শেখ হাসিনার ফিরে যাওয়াতে সম্মানিত হয়েছে জনির ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী সহ হাজার হাজার মা বোন যারা শেখ হাসিনার নিষ্ঠুরতায় হারিয়েছেন তাদের প্রিয়জন। সম্মানিত হয়েছেন এক শোকাতুর মা। কারণ শেখ হাসিনা সমাবেদনা নয় নিয়ে এসেছিলেন মিথ্যা মামলার হুলিয়া। তাঁর হাত ছিল জনি, জিসান, সোহরাবদের খুনের রক্তে রাঙ্গানো। হাজার হাজার নেতা কর্মীর বিরুদ্ধে হামলা মামলার নির্দেশনা।
শেখ হাসিনার নির্মম, নিষ্ঠুরতার হাত থেকে রক্ষা পায় নি খালেদা জিয়ার দীর্ঘ ৪০ বছরের স্মৃতি বিজড়িত বাড়ী, অমানবিক ভাবে উৎখাত করা হয়েছে তাঁকে বাড়ী থেকে। সত্তরোর্ধ্ব বয়সে পুত্র, পুত্রবধূ ও নাতনিদের ছাড়া তিনি কাটাচ্ছেন নিঃসঙ্গ জীবন। শেখ হাসিনার নির্দেশেই খালেদা জিয়ার দুই সন্তানকে মিথ্যা মামলা দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছে দেশে ফিরার পথ।শেখ হাসিনার নগ্ন জিহ্বার কুৎসিত গালিগালাজে আক্রান্ত হয়েছে জিয়া পরিবার। মাত্র সপ্তাহ দুই আগে যে নগ্ন ও কুৎসিত ভাষা প্রয়োগ করা হয়েছে বেগম খালেদা জিয়া এবং তাঁর দুই সন্তানকে (একজন এখন মৃত) তা শুধু শিষ্টাচার বহির্ভূতই নয় অমানবিকও বটে।
সরকারের প্যান্ডোরাম বক্সের পালিত বুদ্ধিজীবীদের বৃহৎ মস্তিষ্কের কুটিল এবং জটিল সমীকরণের হিসাবে হয়তো পুত্রহারা জননী বেগম খালেদা জিয়ার খাতায় দেশবাসীর সমবেদনা শূন্যের কোটায়, কিন্ত পুত্র না হারিয়েও শুধু সমবেদনা প্রকাশের এক ছলনাময় নাটক উপহার দিয়েই শেখ হাসিনা পেলেন পূর্ণ নম্বর। এ হিসাবের রসিকতা যে একজন সন্তান হারানো মায়ের হৃদয়ে কতটা ক্ষতের সৃষ্টি করে তা ওদের অনুভূতিতে আঘাত করে না। কারন ওদের বিবেক, মানবিক মূল্যবোধ প্রতিস্হাপিত হয়েছে নিষ্ঠুরতায় এবং নির্মম রুঢ়তায়।
বিদেশ বিভুঁয়ে যে সন্তান নির্বাসিত জীবন যাপন করছে তাঁর মৃত্যু সংবাদে শোকাচ্ছন্ন মা অসুস্হ হয়ে ইনজেকশনের প্রভাবে যখন ঘুমে অচেতন, সে সময়ের সুযোগ নিয়ে সস্তা এবং নোংরা রাজনীতির এ অসুস্হ খেলা দেশবাসীর কাছে পরিষ্কার। যে শোকাতুর মা তাঁর আদরের সন্তানের প্রিয় মুখটি তখনো শেষ বারের মত দেখতে পারেননি, চোখের কান্নার জল তখনো শুকায়নি, তখনো শেষ হয়নি হৃদয়ে কষ্ট এবং যন্ত্রণার তীব্রতা কিন্তু শোকাচ্ছন্ন সেই মাকে হারানোর নির্মম নৃশংস খেলা শুরু হয়ে যায় তখনি। কিন্তু তিনি হারেননি, তিনি প্রমাণ করলেন তিনি শুধু আরাফাতের মা নন, হাজারো, লক্ষ, কোটি শোকার্ত মানুষের তিনি প্রতিনিধি, হাজারো, লক্ষ, কোটি নেতা কর্মীর তিনি মা, তিনি বাংলাদেশের মা।
শোকাচ্ছন্ন মায়ের চোখের এ অশ্রু ধারা, হৃদয়ের ক্রন্দন, ভাইয়ের ভাল বাসার রক্তের অবিচ্ছেদ বন্দন, হৃদয়ের রক্ত ক্ষরণ, বাবার জন্য সন্তানের আত্মচিৎকার, স্বামীর জন্য স্ত্রীর বুক ফাটা আর্তনাত হয়তো একদিন শেষ হবে। থেমে থাকা জীবন আবারো গতি পাবে, মিশে যাবে স্বাভাবিক জীবন যাত্রায়। আরাফাত রহমানের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনায় এবং শোক শন্ত্বপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা রইল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন