ঢাকা: বাংলাদেশ নিয়ে এক বছর কার্যত নীরব থাকার পর হঠাৎ করেই নড়েচড়ে বসেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের জন্য একযোগে আওয়াজ তোলা হচ্ছে পশ্চিমা দেশ আর তাদের নিয়ন্ত্রিত ক্ষমতাধর সংস্থা থেকে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দিশাহীন রাজনীতি আবার নির্দিষ্ট গন্তব্যে ফিরছে বলে মনে করছেন অনেকে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট কার্যত নতুন নির্বাচনের এক দফা দাবিতে দেড় মাস ধরে যে আন্দোলন করছে তাতে দৃশ্যত সবচেয়ে বড় সফলতা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়। দেড় মাসের একটানা নজিরবিহীন অবরোধ ও হরতালের মধ্যে রাজনীতি যখন সন্দেহের চরম দোলাচলে তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তৎপরতা রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দুটো সংস্থা এবং একটি দেশ বিরোধী দলের সাথে সংলাপে বসার জন্য সরকারের ওপর ‘চাপ’ সৃষ্টি করেছে, যদিও কূটনীতির রীতি অনুসারে তারা আহ্বান জানানোর পথকেই বেছে নিয়েছে। এ আহ্বান যে সরকারে মনসতাত্ত্বিক চাপের কারণ হবে তা স্পষ্ট। কূটনৈতিক মহলকে অবাক করে দিয়ে প্রথমে দৃশ্যপটে হাজির হন সফররত ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদলের প্রধান ক্রিশ্চিয়ান দান প্রিদা । বাংলাদেশ সফরে প্রথম দুদিন অনেকটা মুখ বুঝে থাকলেও বৃহস্পতিবার আকস্মিকভাবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের একটি বক্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান তিনি। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমের সামনে মন্ত্রীর নাম বলেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। কূটনীতিতে এ ধরণের ঘটনা সচরাচর ঘটে না। এ ঘটনার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কার্যত পিছু হটতে বাধ্য হয়। সংশোধিত বিবৃতি দিয়ে স্বীকার করা হয় যে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে ইপি প্রতিনিধি দল মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর জোর দিয়েছেন যদিও তার আগের বৈঠক শেষে প্রতিমন্ত্রী বিপরীত কথাই বলেছিলেন। এরপর রাতে আরো কড়া বিবৃতিতে প্রতিনিধিদল জানায় যে বাংলাদেশের সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্কের ‘অত্যাবশ্যকীয় উপাদান মানবাধিকার ও গণতন্ত্র’। সংলাপের প্রতিও দ্ব্যর্থহীন সমর্থন জানায় ইপি প্রতিনিধি দলটি। এর কয়েক ঘণ্টা পরই ওয়াশিংটন থেকে বিরোধী দলের সাথে সংলাপের জন্য সুষ্পষ্ট আহ্বান আসে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির কাছ থেকে। বাংলাদেশে শীর্ষ কূটনীতিক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী সাক্ষাৎ করতে গেলে তারা প্রায় অভিন্ন ভাষায় সংলাপের আহ্বান জানান। আরো একধাপ এগিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন দুজারিক জানান যে বাংলাদেশের ব্যাপারে জাতিসংঘ প্রয়োজনীয় ‘যথাযথ পদক্ষেপ’ নেবে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করে সংলাপের অনুরোধ জানিয়েছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরো মায়াদু। এ অবস্থায় এসব সংস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব বুঝতে আর কারো বাকি নেই। সংলাপে বসার আহ্বানের পাশাপাশি তারা অবশ্য রাজনৈতিক সহিসংতা বন্ধেরও আহ্বান জানাচ্ছেন। তবে রাজনীতির পণ্ডিতদের বুঝতে বাকি থাকে না যে চাপটা আসলে সংলাপে বসার জন্যই। আর বিএনপি গত এক বছর ধরেই সংলাপের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে আসছে। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশে রাজনীতিতে শুধু, বিশ্ব রাজনীতিতেই এ দুটো সংস্থা এবং দেশ নিয়ন্ত্রকের আসনে। এ অবস্থায় সংলাপে বসার জন্য সরকারের ওপর চাপ বাড়বেই। সংলাপের বসার ‘আহ্বান’ জানিয়ে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় সংসদ এবং যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারের কাছে আরো একটি বার্তা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে সরকারের মন্ত্রীরা অব্যাহতভাবে জামায়াতে ইসলামীর পাশাপাশি বিএনপিকেও ‘সন্ত্রাসী’ বলে প্রচারণা চালালে তারা তা আমলে নেয়নি। বরং তাদের সাথেই সংলাপে বসার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে। বাংলাদেশে গত বছরের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচন নিয়ে ইউরোপ, আমেরিকা ও জাতিসংঘের অবস্থান কারো অজানা নেই। নির্বাচনকে স্বীকৃতি দেয়া তো দূরের কথা, নির্বাচিত সরকারকে অভিনন্দন জানানোর স্বাভাবিক সৌজন্যও দেখায়নি ইউরোপ আমেরিকার প্রায় সব দেশই। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগেও পশ্চিমা দুনিয়া নির্বাচনের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু সংবিধান রক্ষার কথা বলে একটা নির্বাচন করে ফেলেছে আওয়ামী লীগ সরকার। তখন প্রেক্ষাপটও অনেকাংশে ভিন্ন ছিল। ভারত প্রকাশ্যে ওই নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নেয়। বিরোধীতা করেনি চীনও। ফলে নানা হিসেব-নিকেশে আওয়ামী লীগের জন্য সম্ভব হয়েছিল একটি নির্বাচন আয়োজনের। তবে দিল্লির মসনদে নরেন্দ্র মোদি বসার পর দৃশ্যপট বদলেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে প্রকাশ্য অবস্থান নেয়া থেকে বিরত থাকছে দিল্লি। চীনও সংলাপের আহ্বান জানাচ্ছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের আরো একটি বড় শক্তি ছিল জনসমর্থনের দাবি। তবে কার্যত ভোটারবিহীন নির্বাচন, ১৫৪ আসনে নির্বাচনে ছাড়াই বিজয় সেই দাবিকে অসার করে দিয়েছে। এরপর উপজেলা নির্বাচনে বাংলাদেশে জনমত বোঝার সুষ্পষ্ট মাপকাঠি পেয়ে যায় সারা দুনিয়া। সরকারের জন্য বাড়তি দুশ্চিন্তা হচ্ছে ক্রম অবনতিশীল অর্থনীতি। ইতোমধ্যে হরতাল অবরোধে সোয়া লাখ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি এফবিসিসিআইয়ের। চলমান হরতাল ও অবরোধ যদি আরো কিছুদিন অব্যাহত থাকে তাহলে সরকারের জন্য দেশ পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়বে। এ অবস্থায় সংলাপের দাবিকে অব্যাহতভাবে উপেক্ষা করা সরকারের জন্য শুধু কঠিনই নয়, ঝুকিপূর্ণও হয়ে দাঁড়াতে পারে।
আমার বাংলাদেশ অনলাইন ডটকম এর সৌজন্যে
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন