কিন্তু ইতিহাসে আমরা এমন অনেক ব্যক্তির সাক্ষাৎ পাই, যারা নিজেদের বা অন্যদের সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন। কিন্তু কালচক্রের নির্দয় চাকায় পিষ্ট হয়ে তাদের কোনো ভবিষ্যদ্বাণীই সত্য প্রমাণিত হয়নি। অনুকূল অবস্থা, বিস্ময়কর যোগ্যতা, সঙ্গী-সাথীদের সংখ্যাধিক্য এবং প্রাথমিক সাফল্য বেশির ভাগ লোককে এই ধোঁকায় ফেলেছে। নেপোলিয়ান বোনাপার্ট মনে করেছিল তিনি বীরত্বে ও বিজয়ে সিজার ও আলেকজান্ডারকেও ছাড়িয়ে যাবে। তিনি বলতে শুরু করেন, ‘পরিপূর্ণ বিজয় ছাড়া আমার অন্য কোনো পরিণাম হতেই পারে না।’ ১২ জুন, ১৮১৫ সন নেপোলিয়ন তার সর্ববৃহৎ সেনাবাহিনী নিয়ে প্যারিস থেকে এই উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন যে, শত্রুকে পথের মধ্যেই খতম করে দেবেন। কিন্তু এর ঠিক ছয় দিন পর ওয়াটারলু (বেলজিয়াম)-এর রণক্ষেত্রে ডিউক অব ওয়েলিংটন (Duke of Wellinton) যিনি তখন বৃটেন, হল্যান্ড এবং জার্মানীর সম্মিলিত বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন--নেপোলিয়নকে এমনভাবে পরাজিত ও বিপর্যস্ত করেন যে, তার ভবিষ্যতের সব আশা শূন্যে মিলিয়ে যায়। তিনি তার সিংহাসন ছেড়ে আমেরিকার উদ্দেশ্যে পালাতে শুরু করেন ; কিন্তু সমুদ্র উপকূলে পৌঁছতে না পৌঁছতেই শত্রুবাহিনী তাকে ধরে ফেলে এবং তাকে বাধ্য করে একটি বৃটিশ জাহাজে আরোহণ করতে। অতপর তাকে দেশান্তরী জীবন যাপনের জন্য আটলান্টিকের সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তিনি স্বজনহীন, বান্ধবহীন অবস্থায় অত্যন্ত দুঃখ-কষ্টের মধ্যে ৫ মে, ১৮২১ সনে মৃত্যুমুখে পতিত হন। এডলফ হিটলার ১৪ মার্চ, ১৯৩৬ সনে তার মিউনিখের বিখ্যাত বক্তৃতায় বলেছিলেন, “আমি আমার পথে এগিয়ে চলেছি এই অবস্থা নিয়ে যে, বিজয় আমার ভাগ্যে নির্ধারিত হয়ে আছে।” এ রকম অনেক বীরই ইতিহাস থেকে মুছে গেছে। আজও জালিম শাসক গোষ্ঠী তাদের ক্ষমতার মোহ, দাম্ভিকতার কারণে নমরুদ, ফেরাউন, হিটলারের মতো আস্ফালন করছে। ইতিহাস সাক্ষী এরাও আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে ইনশাল্লাহ। এটা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
বিজয় সূচিত হলো : সত্যি সত্যি কিছুকালের মধ্যেই সমগ্র আরব ভূখণ্ড আল্লাহর রাসূলের অধীনে এসে গেল। সামান্য কয়েকজন নিঃস্ব গরিব লোক, ঐ সমস্ত লোককে অত্যন্ত শোচনীয়ভারে পরাজিত করল যারা সংখ্যায় ছিল অধিক, সময় ও পরিবেশ ছিল যাদের অনুকূলে এবং যাদের কাছে ছিল উন্নত সমরাস্ত্র ও ধন-সম্পদের প্রাচুর্য। আল্লাহ বলেন- “যখন তোমাদের দু’টি দলের সাহস হারাবার উপক্রম হলো, অথচ আল্লাহ্ তাদের সাহায্যকারী ছিলেন, আর আল্লাহর ওপরই ভরসা করা মুমিনদের উচিত। বস্তুত আল্লাহ্ বদরের যুদ্ধে তোমাদের সাহায্য করেছেন, অথচ তোমরা ছিলে দুর্বল। কাজেই আল্লাহ্কে ভয় করতে থাক, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পারো।” ( ৩:১২২-১২৩) আল্লাহ বলেন “বরং আল্লাহ তোমাদের সাহায্যকারী, আর তাঁর সাহায্যই হচ্ছে উত্তম সাহায্য”(৩:৫০)
জে.ডব্লিউ. এইচ. স্টোবার্ট এর ভাষায়, “তার কাছে, উপাদান-সামগ্রীর যে স্বল্পতা ছিল এবং তিনি যে বিরাট ও বিস্ময়কর কাজ সম্পাদন করেছেন সে অনুপাতে বিচার-বিবেচনা করা হলে, সমগ্র মানব ইতিহাসে এমন একটি উজ্জল নাম দৃষ্টিগোচর হবে না যেমনটি ছিল আরবী নবীর।” এটা তাঁর, আল্লাহর প্রতিনিধি হওয়ার এমন একটি বিস্ময়কর প্রমাণ যে, স্যার উইলিয়াম মুইর এর মতো ব্যক্তিকেও পরোক্ষভাবে স্বীকার করতে হয়েছেÑ “মুহাম্মদ তাঁর শত্রুদের যাবতীয় পরিকল্পনাকে বানচাল করে দেন; হাতেগোনা সামান্য কয়েকজন লোক নিয়ে তাঁরা রাতদিন সাফল্যের প্রতীক্ষায় থাকা ঠিক তেমন, যেমন বাঘের মুখে বীরত্ব প্রদর্শন। এর তুলনা যদি কোথাও থাকে তাহলে বাইবেলের এই জায়গায়, যেখানে একজন নবী সম্পর্কে লেখা হয়েছে যে, তিনি একবার আল্লাহকে বলেছিলেন---‘শুধুমাত্র আমিই বাকি রয়ে গেছি’
আল-কুরআনের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হলো : ৬১৫ খ্রিস্টাব্দে বিপুল সংখ্যক মুসলমানকে স্বদেশ ত্যাগ করে হাবশার খ্রিস্টান রাজ্যে (রোম সাম্রাজ্যের মিত্র দেশ) আশ্রয় নিচ্ছে। এ সময় রোম সা¤্রাজ্যে ইরানের বিজয় অভিযানের কথা ছিল সবার মুখেমুখে, মক্কার মুশরিকরা এসব কথায় আহলাদে আটখানা হয়ে উঠেছিল। তারা মুসলমানদের বলতো, দেখো, ইরানের অগ্নি উপাসকরা বিজয় লাভ করেছে এবং অহী ও নবুওয়াত অনুসারী খ্রিস্টানরা একের পর এক পরাজিত হয়ে চলছে। অনুরূপভাবে আমরা আরবের মূর্তিপূজারীরাও তোমাদেরকে এবং তোমাদের দ্বীনকে ধ্বংস করে ছাড়বো। এ অবস্থায় সূরা রুম নাজিল হয় এবং এখানে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়ঃ -“নিকটবর্তী দেশে রোমানরা পরাজিত হয়েছে কিন্তু এ পরাজয়ের পর কয়েক বছরের মধ্যেই আবার তারা বিজয়ী হবে।” এর মধ্যে একটির পরিবর্তে দুটি ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। একটি হচ্ছে, রোমানরা জয়লাভ করবে এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে, মুসলমানরাও একই সময় বিজয় লাভ করবে। আপাতদৃষ্টিতে এ দুটি ভবিষ্যদ্বাণীর কোনো একটিরও কয়েক বছরের মধ্যে সত্যে পরিণত হবার কোনো দূরতম সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছিল না। বরং মক্কার কাফেররা এ নিয়ে খুবই ঠাট্টা বিদ্রুপ করতে থাকে। উবাই ইবনে খালফ হজরত আবু বকরের (রা.) সাথে বাজী রাখে। সে বলে, যদি তিন বছরের মধ্যে রোমানরা জয়লাভ করে তাহলে আমি তোমাকে দশটা উট দেবো অন্যথায় তুমি আমাকে দশটা উট দেবে। নবী (সা.)-এর বাজির কথা জানতে পেরে বলেন, কুরআনে বলা হয়েছে ‘ফী বিদ্বঈসিনিন’ আর আরবী ভাষায় ‘বিদঈ’ শব্দ বললে দশের কম বুঝায়। কাজেই দশ বছরের শর্ত রাখো এবং উটের সংখ্যা দশ থেকে বাড়িয়ে একশো করে দাও। তাই হজরত আবু বকর (রা.) উবাইর সাথে আবার কথা বলেন এবং নতুনভাবে শর্ত লাগানো হয় যে, দশ বছরের মধ্যে উভয় পক্ষের যার কথা মিথ্যা প্রমাণিত হবে সে অন্যপক্ষকে একশোটি উট দেবে।
কুরআনের ঘোষণা সত্য হলো : ৬২২ সালে একদিকে নবী (সা.) হিজরাত করে মদীনা তাইয়্যেবায় চলে যান। অন্যদিকে কায়সার হিরাক্লিয়াস নীরবে কনস্ট্যান্টিনোপল থেকে বের হয়ে কৃষ্ণসাগরের পথে ত্রাবিজুনের দিকে রওয়ানা দেন। হিরাক্লিয়াস ৬২৩ সালে আর্মেনিয়া থেকে নিজের আক্রমণ শুরু করেন। দ্বিতীয় বছর ৬২৪ সালে তিনি আজারবাইজানে প্রবেশ করে জরথুষ্ট্রের জন্মস্থান আরমিয়াহ ধ্বংস করেন এবং ইরানীদের সর্ববৃহৎ অগ্নিকুণ্ড বিধ্বস্ত করেন। এই বছরেই মুসলমানরা বদর নামক স্থানে মুশরিকদের মোকাবেলায় প্রথম চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে। এভাবে সূরা রূমে উল্লিখিত দু’টি ভবিষ্যদ্বাণীর দশ বছরের সময়সীমা শেষ হবার আগেই একই সঙ্গে সত্য প্রমাণিত হয়। ৬২৯ সালে নবী (সা.) কাজা উমরাহ আদায় করার জন্য হিজরাতের পর প্রথম বার মক্কা মু’আজযমায় প্রবেশ করেন। এরপর কুরআনের ভবিষ্যদ্বাণী যে, পুরোপুরি সত্য ছিল এ ব্যাপারে কারো সামান্যতম সন্দেহের অবকাশই ছিল না। আরবের বিপুল সংখ্যক মুশরিক এর প্রতি ঈমান আনে।
এ আন্দোলনের জন্য দরকার দৃঢ়সঙ্কল্প, সাহস, অপরিসীম সহনশীলতা এবং চরম আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা সম্পন্ন কর্মীবাহিনী। যাদেরকে বিরোধীদের কোনো অপকর্ম ও নোংরামি তার উচ্চাসন থেকে নিচে নামিয়ে আনতে পারবে না। আল্লাহ বলেন- “(আল্লাহর) আরো অনেক নবীই (এখানে এসে) ছিলো, সে নবী (আল্লাহর পথে) যুদ্ধ করেছে, তার সাথে (আরো যুদ্ধ করেছে) অনেক সাধক (ও জ্ঞানবান) ব্যক্তি, আল্লাহর পথে তাদের ওপর যত বিপদ-মুসিবতই এসেছে তাতে (কোনোদিনই) তারা হতাশ হয়ে পড়েনি, তারা দুর্বলও হয়নি, (বাতিলের সামনে তারা) মাথাও নত করেনি, (এ ধরনের) ধৈর্যশীল ব্যক্তিদেরই আল্লাহ তায়ালা ভালোবাসেন।” (৩:১৪৬)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন