বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক কিছুর হিসাব মেলানো কঠিন। আমরা কেউ ধারণা করতে পারিনি যে, বাংলাদেশের এক কালের দুই কার্ল মার্কস ভক্ত নেতা, জাসদের হাসানুল হক ইনু আর ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন, তাদের পুরনো ধ্যান-ধারণা একেবারে পরিত্যাগ করে আওয়ামী লীগের সাথে হাত মেলাবেন। হবেন মন্ত্রী। কেউই ভাবতে পারেননি যে, এই দুই নেতা হজ করতে যাবেন এবং হবেন আলহাজ। আলহাজ হওয়া দোষণীয় নয়। কিন্তু মার্কসবাদ বলে ধর্ম হচ্ছে আফিমের নেশার মতো, ধর্ম মানুষকে পরকালবাদী করে তোলে। আর ইহজাগতিক সমস্যা সম্পর্কে করে তুলতে চায় উদাসীন। জানি না, এই দুই নেতা এখন কী ভাবছেন, মার্কসবাদের এই মৌল দর্শন নিয়ে। ধর্ম সম্পর্কে এদের মনোভাব, অনুমান করা চলে, নিশ্চয় আর আগের মতো নেই। হাসানুল হক ইনু এক সময় বিশ্বাস করতেন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে হাসানুল হক ইনুর দল জাসদ অনেক আগেই আস্থাহীন হয়ে পড়েছিল। রাশেদ খান মেনন কিছু দিন আগেও বলেছেন, দুনিয়ার মজদুর এক হও। কিন্তু এখন তিনি আওয়ামী লীগের সাথে হাত মিলিয়েছেন। তার বক্তব্য, তিনি বাংলাদেশকে একটি মুসলিম মৌলবাদী দেশ হিসেবে দেখতে চান না। তিনি হজ করে ফিরেছেন নিজেকে একজন খাঁটি মুসলমান প্রমাণ করার জন্য। তিনি খাঁটি মুসলমান হলেও ইসলামি মৌলবাদে আস্থাবান নন। সমস্ত আওয়ামী লীগ এখন পরিচালিত হতে চাচ্ছে এক কালের দণিপন্থী (মস্কোপন্থী) কম্যুনিস্টদের চিন্তাচেতনার দ্বারা। এ রকমই এখন সাধারণ জনরব। সাবেক আওয়ামী লীগ নেতারা আর আওয়ামী লীগে আগের মতো আদ্রিত নন। আওয়ামী লীগে চলেছে গুরুতর মতবাদিক দ্বন্দ্ব; যা আওয়ামী লীগকে ভেঙে দিতেই পারে।
আওয়ামী লীগ এখন পরিচালিত হচ্ছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। শেখ হাসিনাকে বাদ দিলে আওয়ামী লীগে এমন আর কোনো নেতা নেই, যাকে বলা যেতে পারে প্রকৃত আওয়ামী লীগপন্থী। কিন্তু শেখ হাসিনা একজন মানুষ। যেকোনো মানুষ যেকোনো সময় মৃত্যুবরণ করতে পারেন। শেখ হাসিনার অবর্তমানে আওয়ামী লীগ হয়ে পড়বে নেতাহীন। নেতাহীন আওয়ামী লীগ ভেঙে পড়তেই পারে। এটাও একটা বিশেষ সম্ভাবনা। আওয়ামী লীগে কোনো বিকল্প নেতৃত্ব গড়ে উঠছে না। এর ফলে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ হয়ে পড়ছে দুর্বল। তোফায়েল ও আমির হোসেন আমু দু’জন খুবই প্রাচীন আওয়ামী লীগ নেতা। কিন্তু এদের প্রভাব আওয়ামী লীগের মধ্যে খুব প্রবল বলে মনে হচ্ছে না। এদের পে সম্ভব হবে না আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব প্রদান করা। কারণ এদের দু’জনের কারোরই নেই শেখ হাসিনার তুল্য ভাবমূর্তি। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় আছেন। কিন্তু জয় কি আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিতে পারবেন? অনেকে ভেবেছিলেন কংগ্রেসে নেহরু পরিবার চিরদিন নেতৃত্ব দিয়ে যাবে। কিন্তু রাহুল গান্ধী এখন পড়েছেন চরম রাজনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে। আমরা দেখতে পেলাম রাজধানী দিল্লিতে কংগ্রেসের কোনো পদপ্রার্থী নির্বাচনে জয়ী হতে পারলেন না। নেহরু পরিবারের ঐতিহ্য আর এখন আগের মতো জনপ্রিয় নেই। জয় হলেন দ্বি-নাগরিক। তিনি যেমন বাংলাদেশের নাগরিক, তেমনি আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইন বলে যে, তার দেশের নাগরিক অন্য কোনো দেশে গিয়ে রাজনৈতিক পদ দখল করতে পারবে না। জয়কে বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে ছাড়তে হবে মার্কিন নাগরিকত্ব। কেননা, মার্কিন আইন এমনটাই বলে।
তোফায়েল আহমেদ একসময় ছিলেন সারা বাংলাদেশের একজন খুবই জনপ্রিয় নেতা। তিনি শেখ মুজিবকে সভা ডেকে প্রদান করেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের অনুকরণে, ‘বঙ্গবন্ধু’ শিরোপা। যেটা এখন আওয়ামী লীগ ব্যবহার করে চলেছে। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট তোফায়েল আহমেদ সম্পর্কে আওয়ামী লীগের এক অংশ তুলেছিলেন গুরুতর অভিযোগ। তারা বলেছিলেন, তোফায়েল আহমেদ যদি নিষ্ক্রিয় না থেকে যথা সময়ে রীবাহিনীকে ডাকতেন, তবে শেখ মুজিবের মৃত্যু হতো না। রীবাহিনীর অলিখিত ভার ছিল তোফায়েল আহমেদেরই ওপর। এখনো আওয়ামী লীগে অনেকে আছেন যারা মনে করেন, তোফায়েল আহমেদকে বিশ্বাস করা যায় না। তাই শেখ হাসিনার স্থান তোফায়েল আহমেদ নিতে পারবেন, এমন অনুমান করা যথেষ্ট সঙ্গত নয়। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের অভাবে ও আদর্শিক দ্বন্দ্বের কারণে ভেঙে যেতেই পারে। শেখ হাসিনার উচিত আওয়ামী লীগে তার অনুপস্থিতিতে নেতৃত্ব দিতে পারেন এমন নেতা তৈরি করে যাওয়া। কিন্তু তিনি তা করছেন বলে মনে হচ্ছে না। অবশ্য আমরা এ কথা বলছি, বাইরে থেকে দেখে। আওয়ামী লীগের ভেতরের কথা আমরা ঠিক সেভাবে যে জানি, তা নয়। তবে বিশ্বের নানা দেশের ইতিহাসে দেখা যায়, উপযুক্ত নেতার অভাবে একটি রাজনৈতিক দলের বিলুপ্তি ঘটতে পারে। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও সেটা ঘটা অসম্ভব নয়।
দেশে এখন বিতর্ক উঠেছে, আওয়ামী লীগ উদার গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে কি করে না, এই প্রশ্ন নিয়ে। কেননা, আওয়ামী লীগ বলছে আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র। যা এক সময় দেশে দেশে কম্যুনিস্টরা বলতেন। রাশিয়ার কম্যুনিস্ট পার্টি এই যুক্তি তুলে ক্ষমতায় ছিল প্রায় ৭৪ বছর। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়েছে। এখন খোদ রাশিয়ার মানুষ চাচ্ছেন তাদের দেশে বহুদলীয় উদার গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। শেখ মুজিব কেন বাকশাল গড়েছিলেন, আমরা তা জানি না। কারণ তিনি এক সময় দেশে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছিলেন। আর সেই কারণে পেতে পেরেছিলেন বিপুল জনপ্রিয়তা। শেখ মুজিব তার গণতান্ত্রিক দর্শন পরিত্যাগ করে যদি বাকশাল গঠন না করতেন, তবে তার রাজনৈতিক জীবনের ও রকম করুণ বিয়োগাত্মক পরিণতি ঘটতে পারত বলে ভাবা যায় না। হয়তো তিনি নির্বাচনে মতা হারাতেন, কিন্তু আবার নির্বাচনের মাধ্যমেই আসতে পারতেন মতায়। নির্বাচনের মাধ্যমেই কেবল হতে পারে এক দলের হাত থেকে আর এক দলের হাতে রক্তপাতহীনভাবে মতার হস্তান্তর। যতগুলো কারণে দেশে দেশে মানুষ গণতন্ত্র চেয়েছে এবং চাচ্ছে, তার একটা বড় কারণ হলো এটাই। বিলাতের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ চার্চিল নির্বাচনের মাধ্যমে মতা হারিয়েছিলেন। আবার মতায় আসতে পেরেছিলেন নির্বাচনের মাধ্যমে। তিনি বলেছিলেন গণতন্ত্রে গলদ আছে অনেক, কিন্তু মানুষ এর চেয়ে ভালো রাজনৈতিক পদ্ধতি এখনো আবিষ্কার করে উঠতে পারেনি। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে চার্চিলের এই বক্তব্য আমার মনে পড়ছে।
বাংলাদেশে আমার মনে হয় একটা অন্তর্বর্তী নির্বাচন হওয়া হবে যুক্তিযুক্ত। তাতে আসবে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের একটা সমাধান। তা না হলে দেশের রাজনৈতিক সমস্যা আরো জটিল হয়েই উঠবে। এমনকি আওয়ামী লীগের মধ্যেও সঙ্কট দেখা দিতে পারে। ভেঙে পড়তে পারে আওয়ামী লীগ।
বিএনপি জোট বেঁধেছে আরো ১৯টি দলের সাথে। কিন্তু এই মোট ২০টি দলের মধ্যে আছে মূল্যবোধের একটি সাধারণ ঐক্য। যাকে বলা হচ্ছে, ইসলামি মূল্যবোধ। কিন্তু ১৪ দলের মধ্যে এ রকম মূল্যবোধের ঐক্য আছে বলে মনে হচ্ছে না। হাসানুল হক ইনু আর রাশেদ খান মেনন হাসিনার সাথে অনেক বিষয়েই পারছেন না ঐকমত্য গড়তে। এ রকমই মনে হচ্ছে আমাদের বাইরে থেকে দেখে। ২০ দলে যে পরিমাণ তাত্ত্বিক আছেন, ১৪ দলের ঐক্যজোটে আছেন তার চেয়ে অনেক বেশি। নিকট ভবিষ্যতে ১৪ দলের জোটে তাই মতবাদিক দ্বন্দ্ব দেখা দেয়ার সম্ভাবনা বেশি। অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাচন দিলে আওয়ামী লীগ তাই উপকৃত হতে পারবে। এ রকমই আমাদের বিশ্বাস।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
সূত্র : নয়া দিগন্ত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন