আফ্রিকার একেবারে পশ্চিমদিকে আটলান্টিক মহাসাগরের গা ঘেঁষে লক্ষাধিক বর্গকিলোমিটার এলাকার দেশ লাইবেরিয়া। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার চমৎকার। জাপান কিংবা সিঙ্গাপুরের মতো এদেশে শাসকদের মাইক নিয়ে রাস্তায় ‘মানুষ বাড়াও’ ‘মানুষ বাড়াও’ বলে হল্লাচিল্লা করতে হয় না। সন্তানের জন্ম দাও, ছুটি দেবে-পয়সা দেবো-সুবিধা দেবো। জনসংখ্যার দিক থেকে বড় উর্বর দেশ লাইবেরিয়া। এখানকার শাসকরা ভুদু সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী। কে কোথায় শাসক, তারা কোথায় ঘুমায়, কোন্ পথে চলে, এসবের খবর খুব কম লোকই রাখে। জনসংখ্যা বাড়তে বাড়তে চল্লিশ বছরে লাখ তিনেক থেকে তা ৪১ লাখে পৌঁছেছে। ব্যবসা বলতে জাহাজ। প্রাকৃতিক সম্পদ আছে। কিন্তু তা ব্যবহার করার কথা কেউ খুব একটা ভাবে না। হলে হলো। না হলে নাই।
লাইবেরিয়ান সাধারণ মানুষ নানা উপজাতীয় দলে বিভক্ত। কামড়া-কামড়ি, হানাহানি তাদের জীবনের অঙ্গ। আধুনিক জীবনের চাহিদা খুব বেশি আছে বলেও মনে হয় না। লাইবেরিয়ায় কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থাও নেই। যেটুকু আছে তা ব্যবহার করেন শাসক শ্রেণী। এরপরেও যদি কারো বিদ্যুতের প্রয়োজন হয় তাহলে তিনি নিজে জেনারেটর কিনে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু মানুষ বড় ভাল। তারা বিদ্যুতের জন্য আমাদের দেশের হাড়-হাভাতে লোকদের মতো সড়ক অবরোধ করে না। বিদ্যুৎকেন্দ্র জ্বালিয়ে দেয় না। রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে নর্তন-কুর্দনও করে না। সেখানে নির্বাচন-টির্বাচন মাঝে-মধ্যে হয়। ওগুলোও খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। জোর করে ক্ষমতা দখলের জন্য মিলিটারীরও প্রয়োজন হয় না। পুলিশের সার্জেন্টও নির্বাচিত সরকার হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে নিতে পারে। সেভাবেই সেখানে ১৯৮০ সালে ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিলেন সার্জেন্ট ডো।
বর্তমান সরকারের শাসনকালে বাংলাদেশের পরিস্থিতি মোটামুটি এমনই এক জায়গায় পৌঁছেছে। এখানে এখন আইন-শৃঙ্খলার বিভিন্ন প্রধানরাই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন। রাজনীতিবিদদের যা বলার কথা সেগুলো এসব বাহিনী প্রধানরা বলতে কসুর করছেন না। মনে হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনায় চালকের ভূমিকায় এরা। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে সরকার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সন্ত্রাসী বললেও এরা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলার ধার ধারছেন না। তারা একেবারেই নির্মূল করার ঘোষণা দিয়ে বসছেন এবং জানান দিচ্ছেন যে, ২০১৯ সালের আগে আর কোনো সাধারণ নির্বাচন হবে না। আর এ নিয়ে যদি কেউ আন্দোলন করে তবে তারা এক্কেবারে গুল্লি করে দেবে। কারণ তাদের কাছে যে অস্ত্র আছে তা খেলনা না।
যেখানে সরকারের মন্ত্রীরা কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে বক্তব্য রাখতে যান, সেখানে থাকেন কোন কোন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান। যে ভাষায় তারা কথা বলেন, মন্ত্রীদের যদি ন্যূনতম কোনো ব্যক্তিত্ব থাকতো, তাহলে ঘটনাস্থল থেকেই তাকে তারা এই বাহিনী থেকে চিরতরে বিদায় করে দিতো। কিন্তু আমরা দেখি ভিন্ন চিত্র। মন্ত্রীরা তাদের কথারই প্রতিধ্বনি করেন মাত্র। এদের মন্ত্রী হবার ন্যূনতম যোগ্যতা নেই। শিক্ষা নেই। পারিবারিক ভিত্তি ভূমি নেই। মাঠের খিস্তি-খেউরের এরাই বাদশা। এবারের অনেক অনির্বাচিত এমপি-ই পুলিশের ওসি, এএসআইকে ‘স্যার’ ‘স্যার’ করেন। এমন একটা সরকারের কাছে খুব বেশি কিছু আশা করাও বাতুলতা মাত্র।
আর তাই যা ঘটার সেটাই ঘটছে। সরকার বেজায় চালাক। সরকার অনেকক্ষেত্রে নিজেরা কোনো দায়ই নিতে চাইছে না। বরং বলছে এটা আদালতের আদেশ। ওটা পুলিশ নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা সে অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য হচ্ছি। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ভাতিজীর বাসা থেকে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে মধ্যরাতে তুলে নিয়ে যায় ডিবি পুলিশ। তাদের সঙ্গে ছিলো র্যাবের গাড়িও। কিন্তু প্রথম থেকেই র্যাব পুলিশের লোকেরা অস্বীকার করতে শুরু করলো যে, তাদের কেউ মান্নাকে গুম বা অপহরণ করেনি। সরকারের প্রতিমন্ত্রীরাও বলতে থাকলেন যে, না না, তারা কেউ মান্নাকে তুলে নিয়ে যায়নি। এ নিয়ে দেশজুড়ে ভয়াবহ আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়। তবে কি মান্নার মতো এক লোক রাতারাতি হাওয়া হয়ে গেলেন। সরকার তেমনি নির্বিকারই ছিলো। কিন্তু ২১ ঘণ্টা পর র্যাব স্বীকার করলো যে, তারা মান্নাকে আটক করেছে, তবে ঘটনাস্থল বনানী নয়, ধানমন্ডি ২ নম্বর রোডের স্টার কাবাবের সামনে থেকে। এইটুকু মিথ্যা না বললে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেতো না। কিন্তু মিথ্যা না বললে যে সরকারের চলেই না। কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত জানতে পারিনি যে, এই ২১ ঘণ্টা মান্না কোথায় ছিলেন।
এরপর ১০ মার্চ রাত ৯টা সাড়ে ৯টার দিকে উত্তরার একটি বাসা থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে চোখ বেঁধে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এর দায় স্বীকার করেনি। তার আগেও ২০১২ সালে এভাবেই রাস্তা থেকে টেনে-হিঁচড়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীকে। তারও আগে গুম হয়েছেন বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমসহ আরও অনেকে। সরকার এসব গুমের ঘটনা কেবলই অস্বীকার করে গেছে। সালাহউদ্দিন, ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলমসহ কারো সন্ধান মেলেনি। সালাহউদ্দিনের গুমের ঘটনা নিয়ে তোলপাড় চলছে। কিন্তু সরকার সেই মিথ্যার আশ্রয়েই আছে। মিথ্যা তো সরকার মান্নার ক্ষেত্রেও বলেছিলো। সেই সরকারি বাহিনীর কাছেই কীভাবে মান্নাকে পাওয়া গেল। এ থেকে সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো যে, এ সরকার মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত ও মিথ্যা আশ্রয়ী।
উপরন্তু জনগণের ওপর এ সরকারের বিন্দুমাত্র আস্থাও নেই। কেননা এরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার নয়। এ সরকার সম্পূর্ণরূপে জবরদখলকারী একটি সরকার। এরা ক্ষমতায় আসীন হয়েছে পুলিশী শক্তির জোরে। পুলিশ বাহিনীও জানে যে, তাদের শক্তি ছাড়া এই সরকারের পক্ষে সাতদিনও ক্ষমতায় আসীন থাকা সম্ভব নয়। ঠিক সে কারণেই এই বাহিনী নরহত্যার সকল দায়মুক্তি চাইতে সাহস করেছে। এবং সেজন্য আইন পরিবর্তনেরও দাবী তুলেছে। ধারণা করি, সরকার সে দাবিও শিগগির মেনে নিয়ে একচ্ছত্র পুলিশী শাসন প্রতিষ্ঠা করবে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশে যে নির্বাচনী প্রহসন অনুষ্ঠিত হয়েছে সে প্রহসন দেশে-বিদেশে কেউই মেনে নেয়নি। সবাই বলেছে, সকলের অংশগ্রহণমূলক আর একটি নির্বাচনের আয়োজন করা হোক। সরকার তার থোড়াই পরোয়া করেছে। যদিও ঐ নির্বাচনের প্রাক্কালে দেশী-বিদেশী চাপে সরকার ঘোষণা করেছে যে, শিগগিরই তারা সকলের অংশগ্রহণমূলক আর একটি নির্বাচন দিবে। কিন্তু এখন সে কথা অস্বীকার করছে সরকার। বলছে, ২০১৯ সালের আগে কোনো অবস্থাতেই আর কোনো নির্বাচন তারা করবে না।
ইতিমধ্যে বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে তারা কারাগারে পুরেছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন ও ২০ দলীয় জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া নিজ অফিস ভবনে গত আড়াই মাস ধরে অন্তরীণ আছেন। সেখানে প্রতিদিন নতুন নতুন নাটক মঞ্চস্থ করা হচ্ছে। বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের শীর্ষস্থানীয় প্রায় সকল নেতা কারাগারে বন্দী। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষস্থানীয় সকল নেতার নামে শত শত মামলা। খালেদা জিয়ার নামেও মামলার শেষ নেই। প্রতিদিন নতুন নতুন মামলা দায়ের করা হচ্ছে। খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে মরহুম আরাফাত রহমান কোকোর তথাকথিত ঋণখেলাপি মামলায় খালেদা জিয়া, কোকোর স্ত্রী ও তার দুই নাবালিকা কন্যার বিরুদ্ধেও মামলা দায়ের করা হয়েছে। নিষ্ঠুরতা ও প্রতিহিংসাপরায়ণতার এমন ইতর নজির আধুনিক বিশ্বে কমই আছে।
একটি নতুন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবিতে গত আড়াই মাস যাবত সারাদেশে অবরোধ পালন করা হচ্ছে। এর মধ্যে আছে সপ্তাহের পাঁচদিন হরতাল। এই আন্দোলন থেকেই জনগণের দৃষ্টি ফেরাতে এখন সরকার ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ডাক দিয়েছে। স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনগুলোকেও সরকার ইতিমধ্যেই একেবারে প্রহসনে পরিণত করেছে। এর আগে চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সরকার বিরোধীরা জয়লাভ করে। কয়েক দফায় অনুষ্ঠিত হয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। এই উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম দফা মোটামুটি তাতে দেখা গেছে, সরকারি দলের লোকেরা ব্যাপকভাবে পরাজিত হয়েছে। বাকি তিন দফা নির্বাচনে সরকার পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় সবকিছু একেবারে মেরে কেটে দখল করে নিয়েছে। এসব স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যারা জয়লাভ করেছিল তাদের অধিকাংশকে নানা ধরনের মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে ঢোকানো হয়েছে। এবং কৌশলে সরকারি দলের প্যানেল মেয়রদের সেখানে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের উপর আবার অনির্বাচিত এমপিদের খবরদারি তো আছেই। এই হলো স্থানীয় সরকার নির্বাচন পরিস্থিতি।
তার মধ্যে সরকার যখন এই তিন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত জানালো, তখন নির্বাচন কমিশন বলল, জুনের আগে এ নির্বাচন করা সম্ভব নয়। কিন্তু এর মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই পুলিশবাহিনী প্রধান যখন বললেন, না, এপ্রিলের মধ্যেই নির্বাচন করা সম্ভব। আশ্চর্য ঘটনা এই যে, যে পুলিশবাহিনীর নির্বাচনকালে সম্পূর্ণরূপে নির্বাচন কমিশনের হুকুমে চলবার কথা, সে পুলিশবাহিনীর প্রধানের হুকুমে নির্বাচন কমিশন এপ্রিলের ২৮ তারিখেই নির্বাচন ঘোষণা করে দিলো। ধিক্ নির্বাচন কমিশন। সেই সঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটাও জানান দিলেন যে, কোনো রাজনৈতিক দল না এলেও নির্বাচন করতে তিনি বদ্ধপরিকর। হাঃ!
যদি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট শুধু এই নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দেয়, তাহলে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমের ভাষায় সরকার কিছুতেই এ নির্বাচন করতে সাহস পাবে না। দেখা যাক, কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন