কামাল উদ্দিন সুমন : আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে কমে যাওয়ায় সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কপোরেশনের (বিপিসি) অধিক মুনাফা আর গ্যাস বিক্রি করে সরকার বিশাল অংকের টাকা লাভ করলেও এর সুফল পাচ্ছেন না দেশের ভোক্তারা। বরং তেল ও গ্যাসের দাম নিয়ে উপেক্ষিত হচ্ছে জনস্বার্থ। আওয়ামী লীগ নিজেদের জনগণের সরকার দাবি করলেও জ্বালানির অতিরিক্ত দাম চাপিয়ে জনদুর্ভোগ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জ্বালানির দাম নিয়ে ছলচাতুরি করে সরকার এ খাত থেকে শত শত কোটি টাকা লোপাট করছে। এছাড়া স্থানীয় বাজারে এখনো তেলের দাম বেশি হওয়ায় পণ্যের উৎপাদন ব্যয় কমানো সম্ভব হচ্ছে না। বরং অনেক ক্ষেত্রে এসব ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি বাড়ছে বিদ্যুৎ, পানিসহ সেবা খাতের বিলও। এছাড়া ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ তো রয়েছেই। এতে ভোক্তাদের যেমন দুর্ভোগ কমছে না, তেমনিভাবে আন্তর্জাতিক বাজারেও বাংলাদেশ দেশীয় পণ্য মূল্যের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে।
সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম এখন সর্বনিম্ম পর্যায়ে। গত জুন থেকে জ্বালানি তেলের দাম প্রায় ৪৮ শতাংশ কমেছে। অথচ দেশে তেলের দাম সরকার কমাচ্ছে না।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সম্প্রতি জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমলেও বাংলাদেশে দাম কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। তিনি বলেন, বাংলাদেশে কখনো আন্তর্জাতিক দামের সঙ্গে তুলনা করে তেলের দাম নির্ধারণ করা হয় না। আমরা সবসময় কম দামে তেল বিক্রি করি। তবে আমাদের ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে মাঝে মধ্যে দাম বাড়াতে হয়। মন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম এ পর্যায়ে বেশি দিন থাকবে না। তেলের দাম না কমানো দেশের জন্য ভালো, এতে রাজস্ব বাড়বে। বরং বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে আওয়ামী লীগ (মহাজোট) সরকার এ পর্যন্ত ৬ দফা জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছিল।
সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ছিল ব্যারেল প্রতি ৪২ দশমিক ৯৪ টাকা। ২০১১ এবং ২০১২ সালে তা দাঁড়ায় ১২৮ দশমিক ১৪ টাকা এবং ২০১৩ এবং ২০১৪ সালে তেলের দাম ব্যারল প্রতি দাঁড়ায় ৫৯ দশমিক ৬৫ টাকা। অথচ ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত সরকার ছয়বার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছিল। সর্বশেষ পেট্রোল ও অকটেন লিটারে ৫ টাকা, ডিজেল ও কেরোসিন লিটারে ৭ টাকা বাড়ানো হয়। ওই সময় দাম বাড়ানোর সুবাদে প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিন তেলের মূল্য হয় ৬৮ টাকা, অকটেন ৯৯ টাকা ও পেট্রোল কিনতে হচ্ছে ৯৬ টাকায়।
ওই সময় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল। আর আইএমএফের শর্তের নেপথ্যে ছিল জ্বালানি তেলের ভর্তুকি কমানো।
জানা গেছে, সরকারের বিনা টেন্ডারে বেসরকারি খাতের অনুমোদন দেয়া গুটিকয়েক বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীর কারণে জ্বালানি তেলের চাহিদা বেড়ে যায় প্রায় ২০ লাখ মেট্রিক টন। এতে জ্বালানি তেলের ভর্তুকি বেড়ে যায়। আর এ ভর্তুকি কমাতে বাড়ানো হয় জ্বালানি তেলের দাম। সেই সাথে সমান তালে বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম।
বিপিসির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দেশে জ্বালানি তেলের মোট চাহিদার ৭০ শতাংশ ডিজেল, ১০ শতাংশ ফার্নেস অয়েল ও ২০ শতাংশ কেরোসিন, পেট্রোল, অকটেন ও জেট ফুয়েল রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে যাওয়ার ফলে বিপিসির এখন লোকসানের পরিবর্তে মুনাফা হচ্ছে। ফার্নেস অয়েলে লিটারে ৪ থেকে ৫ টাকা, কেরোসিন ও ডিজেলে লিটারে এক টাকা ৭০ পয়সা, অকটেনে লিটার প্রতি ১২ টাকা। এর ফলে গত অক্টোবরের পর থেকে বিপিসির মুনাফা হচ্ছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। কারণ গত অক্টোবরের আগে এক লাখ মেট্রিক টন তেল আমদানির ব্যয় হতো আট কোটি থেকে সাড়ে ৮ কোটি ডলার। সেখানে বর্তমানে ৬ কোটি থেকে সাড়ে ৬ কোটি ডলারের নেমে এসেছে।
বিপিসি বলছে, ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে জ্বালানি তেল কেনাবেচায় ২ হাজার ৪৭ কোটি টাকা মুনাফা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। একই সময়ে সরকারকে ৪ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা রাজস্ব দিয়েছে। এদিকে লোকসান নেই, সরকারের ভুর্তকিও দিতে হয় না গ্যাস খাতে বরং প্রতি বছরে গ্যাস কেনা বেচা করে লাভ করছে পেট্রোবাংলা। তারপরও অস্বাভাবিক হারে গ্যাসের দাম বাড়ানোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে। গ্যাসের দাম কেন বাড়ানো হচ্ছে, তারও কোনো সঠিক কারণ জানে না ভোক্তারা। তবে ৫টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির দাম বৃদ্ধির জন্য বিইআরসিতে দেয়া প্রস্তাবনাতে যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয় করার জন্য গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন।
পেট্রোবাংলার পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছর বিদেশী ও দেশী কোম্পানির কাছ থেকে পেট্রোবাংলা সাত হাজার ৮২৯ কোটি টাকার গ্যাস কিনেছে। ঐ একই বছর গ্যাস বিক্রি করেছে ১১ হাজার ৫৮ কোটি টাকার। এতে লাভ হয়েছে তিন হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সদস্য ড. সেলিম মাহমুদ জানান, গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে। জানুয়ারি মাসে দাম বাড়ানোর জন্য আবেদন তাদের। বিইআরসির আইনকানুন মেনে দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এদিকে চলতি মাসে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির শুনানি করছে সংস্থাটি। তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম যে হারে কমেছে তাতে সরকারের এই মুহূর্তে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৪ টাকা কমানো উচিত। কিন্তু তেলের দাম না কমিয়ে সরকার ইতিমধ্যে তার প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে।
তিনি বলেন, মূলত তেল চুরি, দুর্নীতি আর লুটপাটের জন্যই সরকার ইচ্ছা করেই তেলের দাম কমাচ্ছে না। গত জুন মাস থেকে জ্বালানি তেলের দাম কমতে শুরু করলেও বিপিসি বলছে তারা অক্টোবর থেকে কম দামের তেল পেতে শুরু করেছে। তার মতে, গত ৫ মাসের তেল ক্রয় নিয়ে শত শত কোটি টাকা লোপাট হয়েছে।
জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার ধারা বন্ধ হয়েছে বেশ আগেই। ইতিমধ্যে সরকার তেলের জন্য ভুর্তকি দেয়াও বন্ধ করে দিয়েছে। শুধু ৬ মাসে তেলের দাম কমেছে ৪৮ শতাংশের উপরে। আন্তর্জাতিক বাজারে এখন জ্বালানি তেলের দাম পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন রয়েছে। তারপরও সরকার তেলের দাম না কমানোর রহস্যজনক।
কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম বলেন, পেট্রোবাংলা ২০০৮ সালে লাভজনক ছিল। এই লাভ আরও বেড়েছে। গ্যাস খাত চালাতে সরকারের কোনো ভর্তুকি দেয়া লাগে না। এই অবস্থায় তাদের কেন দাম বাড়াতে হবে? তাছাড়া পেট্রোবাংলার হিসাবে স্বচ্ছতা নেই। গ্যাসের উৎপাদন খরচও বাড়েনি। তিনি বলেন, এখনই গ্যাস খাত উন্নয়ন তহবিলে টাকা জমা হচ্ছে। সেখান থেকে টাকা নিয়ে উন্নয়ন কাজ করা সম্ভব। এই অবস্থায় পেট্রোবাংলার আরও কেন টাকা প্রয়োজন? কোন খাতে তারা এই বাড়তি অর্থ খরচ করতে চায় তা পরিষ্কার নয়। এই অবস্থায় গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া যুক্তিসম্মত নয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন