বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। প্রতিদিন পত্রিকা খুলেই দেখি সমুদ্রে ভাসছে মানবসন্তান। উপার্জনের আশায় ঘরবাড়ি ও আপনজন ছেড়ে এভাবে মানুষ জীবনের ঝুঁকি নেয়, ভাবতেও অবাক লাগে। ভাসমান মানবসন্তানদের কোনো দেশে ঠাঁই দেবে না, তবু তারা মানবতার অহঙ্কার করে- কী আজব কাণ্ড! আমাদের সরকার সমুদ্রে ভাসমানদের রোহিঙ্গা বলে লজ্জাকরভাবে দায় এড়ানোর চেষ্টা করছে। তারা মানুষ। তাদের প্রতি মানুষ হিসেবেও তো আমাদের একটা দায় আছে। মানবতার এ রকম অবমাননা জগৎ আগে কখনো কেউ দেখেছে কি না, বলতে পারি না।
পরম প্রভুর কত দয়া, অবস্থান কর্মসূচি না হলে হয়তো এই ঋণমুক্ত হওয়ার কোনো দিন সুযোগ পেতাম না। ধীরে ধীরে এমন হতে চলেছি, এখন আর অতীত কারো মনে থাকে না। কৃতজ্ঞতা যেন এখন অপরাধের আরেক নাম। কেউ কারো প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখাতে চায় না, কেউ কাউকে সম্মান করে না, সমীহ করে না। এ এক ফ্রি স্টাইল। এ রকম অবক্ষয়ের মধ্যেও আল্লাহ আমায় সেলিম (সালাম) গাজীর কবর জিয়ারতের দুর্লভ সুযোগ দিয়েছেন। এ জন্য দয়াময়ের প্রতি শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। ১৯৭১-এর জুলাই-আগস্টের দিকে ঢাকার দুই যুবক সেলিম গাজী ও শাহালম মুক্তিযুদ্ধের প্রাণকেন্দ্র সখিপুরে গিয়েছিল। তারা লিফটের কাজ করত। এখন তো গণ্ডায় গণ্ডায় লিফটের লোক। পাকিস্তান আমলে ছিল মাত্র দুই-তিন জন, তার মধ্যে সেলিম অন্যতম। প্রথমে সেলিমকে বিশ্বাস হয়নি। আমাদের আস্থা কুড়াতে তাকে অনেক পরীক্ষা দিতে হয়েছে। সব পরীক্ষায় পাস করে সে আমাদের গভীর আস্থার মানুষ হয়। স্বাধীনতার এত বছর পর ঢাকার কত জায়গায় কতজনের অ্যাকশন-রিঅ্যাকশন, কত নতুন নতুন মুক্তিযুদ্ধের গল্প। যুদ্ধের পর ২-৪-১০ বছর ওসব শুনিনি। এখন অনেকেই নেই, তাই মুক্তিযুদ্ধের নতুন নতুন গল্প ফাঁদতে কোনো ভয় নেই। মুক্তিযুদ্ধ যে কোনো গল্প নয়, কড়কড়ে বাস্তব- সেটাই অনেককে এখন বোঝানো যায় না। যে যেমন পারে, তেমন গল্প ফাঁদে। ঢাকার ডিআইটি ভবনের লিফটে সেলিমই প্রথম ডিনামাইট বার্স্ট করে হানাদারদের শঙ্কিত এবং আমাদের দারুণ উৎসাহিত করেছিল।
১৬ আগস্ট ১৯৭১ ধলাপাড়ার মাকড়াইয়ের যুদ্ধে আমি দারুণভাবে আহত হলে সব কিছু তছনছ হয়ে যায়। পূর্বে ভালুকা, উত্তরে ফুলবাড়ি, মধুপুর, দক্ষিণে কালিয়াকৈর, শ্রীপুর, পশ্চিমে টাঙ্গাইলের দিক থেকে এক ডিভিশন সৈন্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চারণভূমি পাহাড়ি এলাকা চেপে ধরলে একপর্যায়ে আমি গুলিবিদ্ধ হয়ে যুদ্ধে অনুপযোগী হয়ে পড়ি। সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়। মা ও ছোট ভাইবোনদের ঢাকার নারিন্দায় খালার বাড়ি পাঠিয়ে বাবা ও ছোট দুই ভাইকে মানকারচরে রাখার ব্যবস্থা করি। ডা: শাহজাদা চৌধুরীর শ্বশুরবাড়ি নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় মা-ভাইবোনেরা বেশ কয়েক দিন কাটায়। নারিন্দা ও চাষাঢ়া মিলে তাদের সেখানে চার-পাঁচ মাস কেটে যায়। যুদ্ধের শেষদিকে স্বাধীনতার ঊষালগ্নে বিক্রমপুর লৌহজংয়ের যশলদিয়ার সেলিম মা-ভাইবোনদের নিয়ে লঞ্চে টাঙ্গাইলের পথে রওনা হয়। স্বাধীনতার চার দিন পর ২০ ডিসেম্বর নৌপথে তারা এলাসিন পৌঁছে। তখন এমন যোগাযোগ ছিল না। তারপরও আমার মা-ভাইবোনের এলাসিন ঘাটে পৌঁছার খবরে সেখানে অনেক লোক জড়ো হয়েছিল। তারা মাকে সিলিমপুরের আবুবকর হাজীর বাড়িতে তোলে। টাঙ্গাইল খবর গেলে পরদিন তাদের সেখানে নেয়া হয়। পাঁচ মাস পর মাকে দেখে আমার হৃদয় ময়ূরের মতো নেচে ওঠে। স্বাধীনতা পাওয়ার চেয়ে সেদিন মা-বাবা, ভাইবোনদের পাওয়া মোটেই কম ছিল না। সেই থেকে সেলিম আমাদের পরিবারের একজন হয়ে যায়। মানুষের কলিজা কত বড় হয়, তা সেলিমকে না দেখলে বোঝা যেত না। জীবনে মাত্র তিন-সাড়ে তিন বছর মোটামুটি আনন্দে কাটিয়েছি। বাকি সব সময় ঝঞ্ঝা-সঙ্ঘাত আর অস্থিরতার মধ্যে কাটাচ্ছি।
’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হলে আমার জীবনে নেমে আসে এক ভয়াবহ বিপর্যয়। এককাপড়ে বাড়ি ছেড়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। জীবনে বাড়ি ফিরব, তেমন কোনো সম্ভাবনা ছিল না। দুঃখে-কষ্টে দিন কাটতে থাকে। ’৮১ সালের মে মাসে জননেত্রী শেখ হাসিনা ভারত থেকে দেশে ফেরেন। আমাদের দেশে ফেরা হয় না। সংগ্রামের পর সংগ্রাম। অনেক কষ্টে ’৯০-এর ১৬ ডিসেম্বর দেশে ফিরি। সেই ফেরার ব্যাপারেও সেলিমের ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। বছরের পর বছর শত শত লোকের খাওয়া, থাকা, চলাফেরার জন্য টাকা-পয়সা যখন যা প্রয়োজন, সাধ্যের বাইরেও করার চেষ্টা করেছে। সেই সেলিম হঠাৎই মারা যায়। দেশের এমন চরম দুঃসময় না হলে নেতানেত্রীদের কানে পানি দিতে, দেশবাসীকে সচেতন করতে আমরা অবস্থান কর্মসূচি নিতাম না, হয়তো সেলিমের ছেলে শাওনকে নিয়ে তার কবর জিয়ারতও হতো না। তাই দয়াময় প্রভুর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই।
মাওয়া দক্ষিণ মেদিনীমণ্ডল আসার আগে সাবেক মন্ত্রী শামসুল ইসলামের বাবা আলহাজ ওসমান গনির কবরের পাশে সুখবাসপুর তিনসিঁড়ি ঈদগাহমাঠে রাত কাটিয়েছি। বড় ভালো লেগেছে সেখানকার লোকজনকে। জনাব শামসুল ইসলামের বাড়িতে একজন কাজের লোক ছাড়া কেউ থাকে না। সেই কাজের লোকও যে অসাধারণ খেদমত বা সেবা করেছে, তা বলার মতো নয়। বছিরননেছা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জনাব মো: মঞ্জুর মোর্শেদের আন্তরিকতা মনে রাখার মতো। আশপাশের লোকোজন যেভাবে খাবার দিয়েছে, ছোট শিশুরা যেভাবে আকুল হয়ে চকলেট নিয়েছে, সেসব ছিল মন কেড়ে নেয়ার মতো ব্যাপার। তারও আগে ছিলাম কাশীপুর হাটখোলা স্কুলমাঠে। ইদানীং কাশীপুরে যখনই যাই মনে হয় নিজের বাড়ি এসেছি। দলমতনির্বিশেষে সবাইকে আপন মনে হয়। এবার জোর করেই তারা তাদের কাশীপুর সমাজ উন্নয়ন সংসদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করিয়েছেন। আমার আগ্রহ বা ইচ্ছে কোনোটাই ছিল না, তারপরও দায়ে পড়ে ঢেঁকি গেলার মতো কাজটা করেছি। হাটখোলাতেই দেলোয়ারের ছেলে সাম্য আগের রাতে বলেছিল, ‘কাকু, পয়সা জমিয়েছি। তোমায় কিছু খাওয়াতে চাই। কী খাওয়াবো বলো তো?’ আসলে সকাল-দুপুর-রাত ভাত-রুটি, সবজি-মাছ ছাড়া কিছু খেতে শিখিনি। দোকানের খাবার আমার তেমন চেনা নয়। কিন্তু ছেলেটি বারবার বলছে, ‘তুমি কী খেতে চাও, আমি তোমাকে খাওয়াবো।’ শেষে বাধ্য হয়ে আমার বুকের ধন কলিজার টুকরা কুশিমণিকে ফোন করেছিলাম পরামর্শের জন্য, ‘মামণি, দেলোয়ারের ছেলে সাম্য কিছু খাওয়াতে চায়। কী খাবো বলো তো?’ সে স্কুল থেকে ফেরার পথে সব সময় এটা-ওটা কিনে আনে। মামণিও জানে আমি দোকানের খাবার খুব একটা পছন্দ করি না। ওর মাকেও বলেছিলাম। সেও তেমন পরামর্শ দিতে পারেনি। সাম্যই হঠাৎ বলে উঠেছিল, ‘কাকু, তোমাকে কোরাল মাছের ফ্রাই খাওয়াই?’ সে কোরাল মাছের ফ্রাই আনতে গিয়েছিল। যখন ফেরে তখন আমার রাতের খাবার হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তারপরও ছোট্ট মানুষ, মন রাখতে কিছু মাছ তাকে খাইয়েছিলাম, সামান্য আমিও খেয়েছিলাম। সাথে এক টুকরো নানরুটি দায়ে পড়ে খেয়েছি। কাশীপুরের আগে ছিলাম ব্রহ্মপুত্র ব্রিজের পাশে ত্রিবেনীতে। সে এক মহাকৌতূহলী জায়গা। পাঁচ-দশ গজের মধ্যে নানা ধরনের নাম। মিনার বাড়ি, তার উত্তরে চর ইসলামপুর, একটু সামনেই লম্বা দরদি, কাইকারটেক-এ রকম পায়ে পায়ে নাম। সেনপাড়া থেকে মিনার বাড়ি হয়ে হিন্দুদের পবিত্র স্নানের লাঙ্গলবন্দের দিক থেকে ফেরার পথে চর ইসলামপুর ব্রিজের ঘারিতে ছোট্ট একটি জায়গা পছন্দ করেছিলাম। সামনে ত্রিবেনীতে শামসুজ্জোহা এমবি ইউনিয়ন উচ্চবিদ্যালয়ে নতুন বিল্ডিং হয়েছে। কেন যে সেখানে গিয়েছিলাম। ইট-রড-বালু এদিক-ওদিক পড়ে ছিল। লাগাতার বৃষ্টি থাকায় সারা মাঠ বড় বড় ঘাসে ভরা। তাই আমার তেমন পছন্দ হচ্ছিল না। ঠিক সেই সময় বহু দিনের সহকর্মী ফরিদ বলেছিল, ‘দাদা, দুই পাশে বিল্ডিং, ঝড়তুফান এলে খুব একটা অসুবিধা হবে না। ওর কথাতেই স্কুলের মাঠে দুইটা কাঁঠালগাছের মাঝে তাঁবু ফেলতে বলেছিলাম। অন্যত্র যেমন হয়, সেখানেও অনেক লোক হয়েছিল। মাগরিবের সময় হয়ে এসেছিল। লোকজনের চাপে অজু করতেও সুযোগ পাচ্ছিলাম না। দেখতে-শুনতে খুবসুরত এক ভদ্রলোক নিজেই পরিচয় দিলেন- ‘আমি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা, প্রাক্তন চেয়ারম্যান।’ তার আগ্রহের শেষ ছিল না। পাগলের মতো করছিলেন। নামাজ পড়ব- পাটি, জায়নামাজ সবই ছিল। কিন্তু তিনি সাতরঙ্গী জায়নামাজ পেতে অফিসঘরের ফ্যান ছেড়ে হাত ধরে টানতে শুরু করেছিলেন। বলছিলাম, ‘ঘর থেকে বেরিয়েছি অনেক দিন। মসজিদে ২-৪-১০ বার অন্য ওয়াক্তের নামাজ পড়েছি। তাই বারান্দাতেই পড়ব। নামাজ পড়েছিলাম নিজের জায়নামাজে। নামাজের সময় কোনো কিছু আমাকে স্পর্শ করে না, গরম-ঠাণ্ডা কিছুই বুঝি না। কিন্তু কেন যেন মশা আমায় সেদিন বিরক্ত করছিল। নামাজ শেষে কেবলই বের হয়েছি। নাসিমের স্ত্রী পারভীনের ফোন ধরতেই তার কান্না। বারবার বলছিল, ‘ভাই, এখনো বিশ্বাস হয় না, আপনার নাসিম নেই। ভাবীকেসহ ছেলেমেয়ে নিয়ে আমার এখানে একবার আসবেন।’ পারভীনকে বলেছিলাম, ‘ত্রিবেনীতে তোমার শ্বশুরের নামে, স্কুলে থাকতে চাই। দোয়া করো।’ ছেলেমেয়ে সবার খবর নিয়েছিলাম। স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা জনাব মহিউদ্দিন চা খাওয়ানোর জন্য খুবই পীড়াপীড়ি করছিলেন। কিন্তু নামাজের পর দেখি তার মুখ থমথমে। হঠাৎ বললেন, ‘এমপি সাহেবকে ফোন করেছিলাম। ভেবেছিলাম তিনি খুশি হবেন। তিনি তা হননি।’ একটু পর কয়েকজন মাস্তান নিয়ে এলেন। যারা তাঁবু বাঁধছিল, তাদেরকে বললেন, ‘এখানে তাঁবু করা যাবে না।’ কথাটি আমার কানে আসতেই বিরক্ত হয়ে তাঁবু খুলে ফেলতে বললাম। মুহূর্তের মধ্যে সব কিছু গুটিয়ে ব্রহ্মপুত্র সেতুর ঘারিতে আব্দুল বাতেন সুপার মার্কেটের মেসার্স শরিফ ট্রেডার্স দোকানের সামনে তাঁবু ফেলেছিলাম। সে যে কী অসাধারণ মানুষ তারা। জমির মালিক ছুটে এসে বলছিলেন, ‘আমার জমিতে পা দিয়েছেন। এখানে রাত কাটাবেন, আমার জীবন ধন্য হলো।’ স্কুলের আঙিনায় যত মানুষ ছিল তার ১০ গুণ লোক সমাগম হয়ে গেল। সবার এক কথা- ‘আপনি এখানে এসে ভালো করেছেন।’ আমিও ভাবলাম ওখানে না গিয়ে এখানেই যদি আগে তাঁবু ফেলতাম, তাহলে জনাব মহিউদ্দিনের কদর্য চেহারা দেখতে পেতাম না। আল্লাহ যা করেন সবই ভালোর জন্যই করেন। মহিউদ্দিনের এই আচরণ আমাকে উৎসাহিতই করেছে সেই প্রবাদের মতো, ‘পাঁচসিকার মোরগ গেল গেল, কিন্তু শিয়ালের ঈমান তো জানা গেল।’ খান সাহেব ওসমান আলী কুমিল্লার মানুষ। সেখান থেকে এসেছিলেন নারায়ণগঞ্জে। চাষাঢ়ার হীরা মঞ্জিলে অত্যন্ত মর্যাদার সাথে বাস করেছেন। মুসলিম লীগের রাজনীতিতে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি দুই বিয়ে করেছিলেন। এক পক্ষের সন্তানরা নারায়ণগঞ্জে। জনাব শামসুজ্জোহা, মোস্তফা সরোয়ার, বাবু সরোয়ার, নীন সরোয়ার। আবার জনাব শামসুজ্জোহার ছেলে নাসিম, শামীম, সেলিম ওসমান।
পুরোনো মাওয়াঘাটে আলহাজ শাহ সুফি হজরত আব্দুল মালেক দরবেশ আল-কাদেরী রহ:-এর কবরের পাশে যখন ছিলাম, তখন ঘোর আওয়ামী লীগের বাড়িতে কর্মীরা খাবার চাইতে গেলে প্রথমে তাদের খাইয়ে তারপর আমার জন্য খাবার দিয়েছে। মায়াময়ী মহিলা হালিমা জামান সকালে নিজে বসে থেকে আমায় নাশতা খাইয়েছে। বিএনপির এক নেত্রী নার্গিস রাতের খাবার, সকালের নাশতা দিয়েছে। রাতে ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ মিলেমিশে খিচুড়ি পাঠিয়েছিল। তাহলে কেন ত্রিবেনীতে শামসুজ্জোহা এমবি ইউনিয়ন উচ্চবিদ্যালয় মাঠে তাঁবু খাটিয়ে আমার থাকাতে সেলিমের আপত্তি হবে?
নারায়ণগঞ্জের জোহা পরিবার ত্বকী হত্যার ঘটনায় যখন সবচেয়ে নিন্দিত, তখন নারায়ণগঞ্জের এক সভায় বলেছিলাম, ‘কোনো পরিবারের কোনো সদস্যের জন্য পুরো পরিবারকে অভিযুক্ত করা যায় না। জোহা পরিবারের যেমন পাকিস্তান আন্দোলনে ভূমিকা আছে, তেমনি স্বাধীনতাযুদ্ধে আছে। সর্বোপরি, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ-প্রতিরোধে বাসরঘরের বউ রেখে নাসিম আমার সাথে অংশ নিয়েছিল। আমি কখনো কোনো কিছু পাওয়ার আশায় কোনো কথা বলি না, বিবেকের নির্দেশে বলি।’ এক-দুই দিন পর নাসিম ওসমান আমার কাছে গিয়ে ঝরঝর করে কেঁদেছিল। বলেছিল, ‘আমার পরিবারের জন্য আপনি যা করলেন, আমরা সারা জীবন আপনার গোলামি করেও সে ঋণ শোধ করতে পারব না। হঠাৎ নাসিম না-ফেরার দেশে চলে যায়। তার শূন্য আসনে সেলিম ওসমান প্রার্থী হয়। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের পক্ষ থেকে আমরা শফিকুল ইসলাম দেলোয়ারকে প্রার্থী করেছিলাম। একসময় জাতীয় নেতাদের পক্ষ থেকে অনেক অনুরোধ এসেছিল নির্বাচন থেকে আমাদের সরে দাঁড়াতে। আমরা তেমনটা চাইনি। নাসিমের স্ত্রী পারভীন ফোন করে আকুল হয়ে বলেছিল, ‘ভাই, আমাদের ছায়া দেয়ার মাথার ওপর কেউ নেই। আপনি দেখবেন। আপনার প্রার্থী উঠিয়ে নিলে আমাদের জোর করে হারিয়ে দেবে। সেলিম রাজনীতি করত না, তাই তার জানার কথা না। ইলেকশনের চার-পাঁচ দিন আগে তিন হাজার র্যাব, আরো আড়াই-তিন হাজার বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছিল। র্যাব-বিজিবি সব ছিল শামীমের বিরুদ্ধে। ব্যাপক কারচুপির পরও ফলাফলে খুব একটা পার্থক্য দেখা যায়নি। গামছা সরে দাঁড়ালে তার কী প্রভাব পড়ত সেটা সেলিমের বোঝার কথা না। তা যা-ই হোক, আমি এমপি সেলিম ওসমানকে খুব একটা দেখিনি। তার আচার-আচরণ, চালচলন সম্পর্কে তেমন অবহিত নই। কিন্তু জোহা পরিবারের সবাইকে দীর্ঘ সময় ধরে জানি। তাই ত্রিবেনীতে শামসুজ্জোহা এমবি ইউনিয়ন উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে তাঁবু খাটিয়ে আমি থাকলে সেলিমের অসুবিধা কোথায়, তা আমার বোধগম্য নয়। লৌহজং আওয়ামী লীগের সভাপতি-সেক্রেটারি এসে দেখা করতে পারল, তারা খাবার পাঠাল, আলহাজ শাহ সুফি হজরত আব্দুল মালেক দরবেশ রহ:-এর কবরের পাশে মাঠে থাকলাম, সাধারণ মানুষসহ আওয়ামী লীগ-বিএনপি কতজন খাবার দিলো, কোথাও আসমান ভেঙে পড়ল না, ত্রিবেনীতে পড়ল- এ প্রশ্নের কোনো জবাব পাচ্ছি না। ঠিক আছে, অপেক্ষা করি। দেখা যাক, সুবিধাবাদীদের অতিভক্তির ফল, নাকি সেলিম নিজেই তার বাবার নামের স্কুলে আমাদের থাকতে দেয়নি- ভবিতব্যই বলে দেবে, আমাদের কিছু করতে হবে না। তবু কেন যেন মনে হয়- এমনটাই কি ঋণ শোধের নমুনা?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন