চোখ বাঁধা অবস্থায় কয়েকবার গাড়ি বদল করে শিলং নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে। শিলংয়ের পলোগ্রাউন্ডে তাকে চোখ বাঁধা অবস্থাতেই গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়া হয়। চোখের বাঁধন খোলার পরও তিনি বুঝতে পারছিলেন না কোথায় আছেন। স্থানীয়দের জিজ্ঞাসা করে তিনি জানতে পারেন, তিনি শিলংয়ে আছেন। এরপর সালাহউদ্দিন আহমেদ নিজেই শিলং পুলিশের কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দেন। শিলংয়ের হাসপাতালে সালাহউদ্দিন আহমদের সঙ্গে দেখা করে তার দুই আত্মীয় বিবিসি বাংলাকে এসব তথ্য জানিয়েছেন। বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। এর আগে বৃহস্পতিবার বিকালে সালাহউদ্দিন আহমেদের এই দুজন আত্মীয় প্রথমবারের মতো তার সঙ্গে শিলংয়ের সিভিল হাসপাতালে দেখা করতে সক্ষম হন। সাক্ষাৎ শেষে বেরিয়ে এসে তারা বিবিসি বাংলার অমিতাভ ভট্টশালীকে এসব তথ্য জানান। এদিকে সালাহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে মেঘালয়ে যাওয়ার জন্য তার স্ত্রী হাসিনা আহমেদ বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত ভারতের ভিসা পাননি। তারা ভিসার অপেক্ষায় সময় পার করছেন। তবে সালাহউদ্দিন আহমেদকে দেখতে শিলং পৌঁছেছেন দলটির সহ-দপ্তর সম্পাদক আবদুল লতিফ জনিসহ দুই রাজনৈতিক সহকর্মী। বুধবার এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে তারা ভারতে যান। সালাহউদ্দিনকে নিয়ে নিষ্ঠুর মন্তব্য না করে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সহযোগিতা করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি। ওদিকে, শিলংয়ের সিভিল হাসপাতালে সালাহউদ্দিন আহমেদকে গতকাল দুপুরে দুই ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেন মেঘালয় পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের দুই কর্মকর্তা।
সালাহউদ্দিনের কাছে পাওয়া গেছে বাংলাদেশের ওষুধ
বিবিসি বাংলার অমিতাভ ভট্টশালীকে সালাহউদ্দিন আহমেদের দুই আত্মীয়ের একজন আইয়ুব আলী নিজেকে কলকাতার বাসিন্দা ও সালাহউদ্দিনের দূর-সম্পর্কের ভাই বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেছেন, সালাহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তিনিই তাদের জানিয়েছেন- কয়েকবার গাড়ি বদলের পর মুখ বাঁধা অবস্থায় তাকে ফেলে রেখে যায়। তিনি চোখ খুলে লোকজনের কাছে জায়গার নাম জেনে পরে পুলিশের কাছে যান। অবশ্যই গত দুদিন ধরে শিলংয়ের পুলিশের তরফ থেকে দাবি করা হচ্ছিল, স্থানীয় লোকজন সালাহউদ্দিন আহমেদকে উদভ্রান্তের মতো ঘুরতে দেখে থানায় খবর দেয়। এরপর পুলিশ তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যায়। বিবিসি বাংলার রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশে দু’মাসের বেশি সময় ধরে নিখোঁজ সালাহউদ্দিন আহমেদকে শিলংয়ে খুঁজে পাওয়ার পর এই প্রথম তার নিজস্ব বয়ানে কোন তথ্য জানা গেল। বিবিসি বাংলা মেঘালয় পুলিশের ক্যামেরায় তোলা শিলং হাসপাতালে সশ্রুমণ্ডিত সালাহউদ্দীন আহমেদের একটি ছবিও প্রকাশ করে। এদিকে শিলং পুলিশ গত কদিন ধরে তাকে কঠোর পাহারার মধ্যে রেখেছে। এমনকি যেসব চিকিৎসক ও নার্স সালাউদ্দিন আহমেদকে দেখেছেন, তারাও তার স্বাস্থ্য ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে কোন তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। তারা বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলছেন, সেটা হাসপাতালের সুপার বলবেন। পরে পুলিশ সুপারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সালাহউদ্দিনের শারীরিক অবস্থান খোঁজ জানতে চাইলে তিনি অমিতাভ ভট্টশালীকে জানান, ‘স্টেবল’ (স্থিতিশীল)। সাক্ষাৎকার চাইলে সিভিল হাসপাতালের সুপার নিজে না বলে একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের ফোন নাম্বার দিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। সে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডি জে গোস্বামী জানান, বুধবার বেশ কিছু পরীক্ষা করিয়েছি। সব রিপোর্ট আসেনি। তবে ইসিজি প্রায় স্বাভাবিক। সালাহউদ্দিন আহমেদ পুরনো হৃদরোগের কথা বলেছেন। তাই সেদিকেই নজর বেশি দিচ্ছি। কিডনিরও সমস্যা রয়েছে। কিন্তু কথাবার্তায় অসংলগ্ন কিছু লক্ষ্য করিনি। সেরকম হলে তো আমিই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাকতাম। ডা. ডি জে গোস্বামী জানান, সালাহউদ্দিন আহমেদের কাছে কিছু ওষুধ পাওয়া গিয়েছিল। যেগুলো বাংলাদেশের কোন ওষুধ কোম্পানির তৈরি বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ এসব ওষুধের স্ট্রিপে বাংলা লেখা ছিল। ভারতে তৈরি ওষুধের স্ট্রিপে বাংলা লেখা থাকে না। ডি জে গোস্বামী বিবিসিকে আরও জানান, সালাহউদ্দিন আহমেদ হৃদরোগ এবং প্রোস্টেটের জটিলতায় ভুগছেন। তার সঙ্গে পাওয়া ওষুধগুলো মূলত এসব রোগের। এদিকে হাসপাতালে বন্দি বাংলাদেশের বিএনপি নেতা ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমেদকে পুলিশ কর্মকর্তারা জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছেন। মেঘালয় পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের দুজন কর্মকর্তা বৃহস্পতিবার দুপুুরে হাসপাতালের প্রিজন ওয়ার্ডে সালাহউদ্দীন আহমেদকে প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদে তারা কি জানতে পেরেছেন তা প্রকাশ করেননি। ওদিকে হুমায়ুুন রশিদ নামে একজন জানিয়েছেন, তিনি সালাহউদ্দিন আহমেদের কাজিন। সালাউদ্দীন আহমেদের সঙ্গে তাদেরকে দেখা করার অনুমতি দিয়েছিলেন শিলং পুলিশের এসপি। কিন্তু পরে সেই অনুমতি প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। দেখা করতে না পেরে তারা ফিরে যান। এছাড়া বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক আবদুল লতিফ জনি ও স্বপন নামে দুইজন সালাহউদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে শিলংয়ে পৌঁছেছেন।
ইন্টারপোলের রেড নোটিশের খবর ভারতের গণমাধ্যমের
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে গ্রেপ্তারের অনুরোধ জানিয়ে ভারতের কাছে রেড নোটিশ পাঠিয়েছে ইন্টারপোলের ঢাকা শাখা। মেঘালয় পুলিশের ডিজি (ডিরেক্টর জেনারেল) রাজীব মেহতা বুধবার গণমাধ্যমকে একথা জানিয়েছেন। রাজীব মেহতা বলেন, সালাহউদ্দিনকে গ্রেপ্তারের জন্য মঙ্গলবার ইন্টারপোলের ঢাকা ইউনিট থেকে আমরা একটি রেড নোটিশ পেয়েছি। আমরা সেই আবেদন দিল্লিতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইকে জানিয়ে দিয়েছি। রাজীব মেহতার এ উদ্ধৃতি দিয়ে কলকাতার ইংরেজি দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তিনি জানিয়েছেন, সালাহউদ্দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকায় আমরা এখন পর্যন্ত তাকে ভাল করে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারিনি। হাসপাতাল থেকে ছাড়া না হওয়া পর্যন্ত এ ব্যাপারে নতুন করে কিছু বলা যাবে না। ওদিকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকায় বুধবার বিএনপির এই নেতাকে আদালতে উঠানো হয়নি। পূর্ব খাসি হিলস জেলার পুলিশ সুপার মারিয়াহোম খারক্রাং জানিয়েছেন, ‘শিলং সিভিল হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলার কারণে আমরা আজ (বুধবার) তাকে আদালতে উপস্থিত করতে পারিনি।
রেড নোটিশের বিষয়টি পুরোটাই গুজব: আইজিপিএদিকে গতকাল সকালে গুলশানের লেকশোর হোটেলে এক অনুষ্ঠান শেষে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, নিখোঁজ বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমদকে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভারত থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। তিনি যেহেতু ওই দেশের পুলিশের হাতে আটক আছেন, সেহেতু ওই দেশের কিছু আইনি প্রক্রিয়া আছে, আমাদেরও কিছু আইনি প্রক্রিয়া আছে। সেগুলো শেষ করে যথাসময়ে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। অপরদিকে গতকাল বিকালে পুলিশ হেডকোয়ার্টাস-এ আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, সালাহউদ্দিনের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিশের যে কথা বলা হচ্ছে, তা পুরোটাই গুজব। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ইন্টারপোল কখনো রেড এলার্ট জারি করে না। তবে সালাহউদ্দিন আহমেদ যে ভারতের মেঘালয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন ইন্টারপোলের মাধ্যমে পুলিশ তা নিশ্চিত হয়েছে। এখন আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাকে ফেরত আনার চেষ্টা করা হবে।
ভিসার অপেক্ষায় সালাহউদ্দিনের স্ত্রী
এদিকে সালাহউদ্দিন আহমেদের স্ত্রী হাসিনা আহমেদ মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলন করে গণমাধ্যমকে জানান, সালাহউদ্দিন আহমেদ তাকে শিলং থেকে ফোন করেছেন। তিনি জানিয়েছিলেন, ভিসা পেলেই তিনি স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। ওইদিনই তিনি ভিসার আবেদন করেন। বিএনপির তরফেও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান হাইকমিশনে গিয়ে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কূটনীতিকদের সঙ্গে আলাপ করেন। তবে বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত তিনি ভারতের ভিসা পাননি।
নিষ্ঠুর মন্তব্য নয়, ফেরাতে সহযোগিতা করুন: বিএনপি
এদিকে দুই মাস ‘নিখোঁজ’ থাকার পর ভারতের মেঘালয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমেদের সন্ধান পাওয়ার পর তার নিখোঁজ ও সন্ধান নিয়ে নিষ্ঠুর মন্তব্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন দলটির আরেক যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ শাহজাহান। গতকাল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিএনপির যৌথসভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ অভিযোগ করেন। সালাহউদ্দিনকে নিয়ে নিষ্ঠুর মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান ও তাকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে সরকারের সহযোগিতা কামনা করেছেন মোহাম্মদ শাহজাহান। তিনি বলেন, সরকারের কিছু মন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমেদকে নিয়ে নির্মম ও নিষ্ঠুর কথা বলছেন। তা অত্যন্ত মর্মান্তিক ও দুঃখজনক। নির্মম কথায় সালাহউদ্দিন ছোট হবে না বরং যারা এ ধরনের নিষ্ঠুর কথা বলছেন তারাই ছোট হবেন। সবারই উচিত- সালাহউদ্দিনের বিষয়ে মানবিক আচরণ করা। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা অবশ্যই সরকারের সহযোগিতা চাই। সালাহ উদ্দিনকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার আহ্বান জানাই। সালাহ উদ্দিনকে ফিরিয়ে আনার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আরেকটি দেশের আইনিপ্রক্রিয়া নিয়ে মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তারা তাদের আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই তাকে ফিরিয়ে দেবে। ইন্টারপোলে রেড অ্যালার্ট সম্পর্কে বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও মুখপাত্র ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, ইন্টারপোলের রেড অ্যালার্ট জারি তেমন কোন বিষয় নয়। এই রেড অ্যালার্টে বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন হয়েছে। ইন্টারপোলের মাধ্যমে সালাহউদ্দিনকে আনার কোন বিষয় না। বাংলাদেশ ইন্টারপোলের সদস্য দেশ হিসেবে সরকারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শুধু তথ্য প্রকাশ করেছে। তিনি জানান, সালাহউদ্দিনের পরিবারের সদস্যরা ভারতের ভিসার জন্য আবেদন করেছেন। ভিসা পেলেই সালাহউদ্দিনকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ভারতের উদ্দেশে রওনা দেবেন তার পরিবারের সদস্যরা।
উৎসঃ মানব জমিন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন