চট্টগ্রামের রাঙ্গুনীয়া উপজেলার শিলক ইউনিয়নে ১৩ বছর বয়সী দরিদ্র পিতার এক শিশুর ধর্ষণকারীকে বাঁচাতে ধর্ষিতার ১৫ বছর বয়সী আপন ভাইকেই ধর্ষক সাজিয়ে জেলে পাঠানোর অভিযোগ উঠেছে। একাজে রাঙ্গুনীয়া থানা পুলিশের তিন কর্মকর্তা ও সরকার সমর্থিত প্রভাবশালী একজন জনপ্রতিনিধির প্রত্যক্ষ মদদ দেয়া ও ভিকটিমের পরিবারসহ প্রশাসনকে বিপুল অংকের টাকা ঘুষ দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ভিকটিমের মার অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযুক্ত ধর্ষক সমাজপতি ৬২ বছর বয়সী শাহ আলমকে পুলিশ প্রথমে আটক করলেও পরে ছেড়ে দেয়। শুধু তা-ই নয়, উল্টো ধর্ষিতার ১৫ বছর বয়সী বড় ভাইকেই ধর্ষক বানিয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মামলার নথিপত্র পরিবর্তন করে নিজ ছেলের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা করতে বাধ্য করা হয় তাদের মাকে। সেই মামলায় পুলিশ বাদীর ছেলে ও ধর্ষিতার বড় ভাইকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়েছে। ঘটনার পর বিষয়টি পরিবারের পক্ষ থেকে গোপন রাখা হলেও পুলিশের দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সাত দিন পরেও ছেলে জেল থেকে ছাড়া না পাওয়ায় প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেন ভিকটিমের মা নুর নাহার। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় রাঙ্গুনীয়সহ পুরো চট্টগ্রামজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাঙ্গুনিয়া উপজেলার শিলক ইউনিয়নের দরিদ্র রিকশাচালক বাবার ১৩ বছর ৩ মাস বয়সী শিশু কন্যাকে ‘নাতনি’ সম্বোধন করে সব সময় কাছে রাখতেন স্থানীয় ‘সমাজপতি’ শাহ আলম। শিশুটিও কিছু না বুঝেই কথিত দাদার ঘরে গিয়ে একসাথে টিভি দেখাসহ সব সময় কাছাকাছি থাকতো। শাহ আলম তিন মাস ধরে এই শিশুকে ফুসলিয়ে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। একাধিকবার শারীরিক সম্পর্কের জের ধরে শিশুটি এক পর্যায়ে ৪ মাসের অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে।
শিশুটি তখন মাকে ঘটনাটি জানালে মা বিষয়টি শাহ আলমকে জানান। তিনি তখন ঘটনাটি গোপন রাখার হুমকি দিয়ে গর্ভপাত করাতে বলেন। শাহ আলম স্থানীয় মরিয়ম নগর ইউনিয়নের একটি ক্লিনিকে নিয়ে শিশুটির গর্ভপাত করাতে ধর্ষিতার মায়ের হাতে কিছু টাকাও গুঁজে দেন।
শাহ আলমের ভয়ে ও চাপে ধর্ষিতার মা ওই ক্লিনিকেই শিশুটির গর্ভপাত করান। কিন্তু এরই মধ্যে পুরো ঘটনাটি এলাকায় জানাজানি হয়ে গেলে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। স্থানীয় জনসাধারণ অভিযুক্ত বৃদ্ধ শাহ আলমকে ‘লম্পট’ আখ্যায়িত করে রাস্তায় নেমে তার শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন ও মানবন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করতে থাকেন।
অভিযুক্ত শাহ আলম
স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় ধর্ষিতার মা গত ৭ মে রাতে রাঙ্গুনীয়া থানায় শাহ আলমের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন। এরপর স্থানীয় সাধারণ মানুষের বিক্ষোভের মুখে ৮ মে রাতে রাঙ্গুনিয়া থানা পুলিশ অভিযুক্তকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়।
কিন্তু মধ্যরাতেই পাল্টে যায় সবকিছু। পুলিশ মূল অভিযুক্ত শাহ আলমকে গভীর রাতে ছেড়ে দেয়া হয়। পরদিন ৯ মে ধর্ষিত শিশুটির বড় ভাই (১৫) এবং শিশুটিকে আটক করে নিয়ে যায় শিলক তদন্ত কেন্দ্রের পুলিশ।
স্থানীয় এলাকাবাসী অভিযোগ করেন, শিলক তদন্ত কেন্দ্রে নিয়ে কিশোর সফুরকে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে তার ছোটবোনকে নিজেই ধর্ষণ করেছে এবং গর্ভপাতে জন্য সে-ই দায়ী এই মর্মে লিখিত স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়। একই রকম স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হয় ধর্ষিত শিশুটিকেও।
পরদিন ১০ মে পুলিশ তাকে বোনের ধর্ষণকারী সাজিয়ে রাঙ্গুনীয়া থানায় দায়ের করা ১২ নম্বর মামলায় চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতের হাজির করলে আদালত তাকে জেলহাজতে পাঠানোর আদেশ দেন। বর্তমানে সে জেলেহাজতে রয়েছে।
অভিযোগ পাল্টিয়ে মূল ধর্ষককে ছেড়ে দিয়ে ভিকটিমের আপন ভাইকে ধর্ষক সাজাতে পুলিশ তার বয়সও পাল্টে দিয়েছে। স্থানীয় শিলক ইউনিয়ন পরিষদের দেয়া জন্মনিবন্ধনে ওই কিশোরের জন্মসন ২০০১ সাল অনুযায়ী ১৫ বছর হলেও মামলায় ১৮ বছর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যেটিতে স্বাক্ষর করেছেন খোদ থানার ওসি হুমায়ূন কবির ও পরিদর্শক (তদন্ত) চন্দন কুমার চক্রবর্তী।
এছাড়া ঘটনাস্থলকে ভিকটিমের ঘর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ভিকটিম ও তার মায়ের দাবি, ঘটনাস্থল অভিযুক্ত ওই শাহ আলমের পাকাবাড়িই, আর ধর্ষক সেই শাহ আলমই।
এলাকায় ভিত্তশালী হওয়ায় এবং সরকার দলীয় উপজেলা পর্যায়ের এক জনপ্রতিনিধির আত্মীয় হওয়ায় অভিযুক্ত শাহ আলমকে পুলিশ আটক করলেও পরবর্তীতে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। মূলত মামলার এজাহারে নাম পাল্টে নিজ ছেলের বিরুদ্ধে করা মামলায় স্বাক্ষর নিতে মাকে প্রত্যক্ষভাবে চাপ দেয়ার অভিযোগ আছে রাঙ্গুনীয় থানার তিন পুলিশ সদস্য মুজিব, বাপ্পী ও তামিমার বিরুদ্ধে। থানার কর্তাব্যক্তিরাতো আছেনই।
ধর্ষিত ওই শিশুটি বলে, ‘আমি দাদার (শাহ আলম) বাড়িতে প্রতিদিন টিভি দেখতে যেতাম। যখন যেতাম তখন ওর রুমে কেউ না থাকলে আমার সাথে ‘দুষ্টুমি’ করতো। বলতো আমার সাথে এগুলো করো। কিছু হবে না। আমি তোমাকে বিয়ে দেবো।’
সে আরো বলে, ‘এঘটনাটি আমার মাকে জানালে দাদা মাকে কিছু টাকা দিয়ে আমার বাচ্চা নষ্ট করে নেয়। বলেছে, কাউকে এগুলো জানালে জানে মেরে ফেলবে। এরপর পুলিশ আমার ভাইকে আর আমাকে ধরে নিয়ে দুই দিন রেখে বলেছে আমার ভাই আমাকে ধর্ষণ করে গর্ভবতী করেছে। আমার ভাইকে পুলিশ নির্যাতন করেছে।’
ধর্ষিতার মা ও মামলার বাদী বলেন, ‘আমার মেয়ে যখন শাহ আলমের বিরুদ্ধে তাকে ধর্ষণের কথা আমাকে জানায়। আমি এলাকাবাসীকে সাথে নিয়ে থানায় ৭ মে মামলা করতে যাই। শাহ আলমকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেলেও তার সাথে আমার বৈঠক করায় পুলিশ। তখন শাহ আলম ও মুজিব স্যার, বাপ্পী স্যার ও তাহমিনা ম্যাডাম আমাকে মামলা তুলে নিতে বলেন। এরপরও যখন আমি মামলা তুলে না নিলে শাহ আলমকে ছেড়ে দিয়ে তারা আমার ছেলে ও মেয়েকে শিলক পুলিশ অফিসে নিয়ে আসে।’
নিজের ছেলের বিরুদ্ধে মেয়েকে ধর্ষণের মামলার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, ‘আমাকে পুলিশ ও শাহ আলম বলেছে, তুমি যদি সুখে থাকতে চাও, আমাদেরও সুখে রাখো। তোমার টাকা পয়সা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। যা দরকার তা আমি দিবো। এখন তোমার ছেলের নামে একটি অভিযোগ দাও। তোমার ছেলে সাতদিনের মধ্যে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে গেলে মামলাটা এমনিতেই চলে যাবে। আর তোমার মেয়ের বিয়ের জন্য খরচাপাতিতো পাবেই। তোমরা নতুন জীবন পাবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি এরপরও রাজি হয়নি তাদের কথায়। ৯ মে সকালে আমি তাদের (পুলিশ) সাথে যেতে না চাইলে স্থানীয় মেম্বার মোকারম হোসেন বলেন, তুমি ওদের সাথে গিয়ে যা বলে তা করে এসো। কিছু হবে না, তোমার আর তোমার ছেলের ভালো হবে। সেতো সাত দিনের মধ্যে ছাড়া পেয়ে বাড়ি চলে আসবে। এরপর তারা আমাকে একটি সিএনজি ট্যাক্সিতে করে শহরে নিয়ে কাগজে জোর করে সাইন নিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। এরপর ১১ মে আমার ছেলে মেয়ে দু’জনকে চাইলেও মেয়ে ফেরত দিলেও ছেলে ফেরত দেয়নি। বলেছে তাকে জেলখানায় নিয়ে গেছে।’ এই অন্যায়ের সুষ্ঠু বিচার চেয়ে নিজের ছেলের মুক্তি দাবি করেন এই মা।
001এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাঙ্গুনিয়া থানার ওসি হুমায়ুন কবীর বলেছেন, ‘শিশু ধর্ষণের অভিযোগ পেয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বৃদ্ধ শাহ আলমকে থানায় আনা হয়েছিল। কিন্তু ঘটনার সাথে তার সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ওই কিশোর তার বোনকে ধর্ষণের স্বীকারোক্তি প্রদান করেছে আদালতে। আর ধর্ষিত শিশুটিও তার ভাইকে দায়ী করেছে। তাই এই কিশোরকে ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে।’ এখানে পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ওঠার সুযোগ নেই বলে দাবি করেন ওসি।
পুলিশের ভূমিকা নিয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার এম হাফিজ আক্তার বাংলামেইলকে বলেন, ‘মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তাই বিষয়টি ভালো জানতে পারবেন। তবে বাদী যদি এই ধরনের অভিযোগ নিয়ে আমার কাছে আসেন তাহলে বিষয়টি আমি গুরুত্বের সাথে দেখবো। তাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেন।’
তবে ঘটনার কয়েক দিন পর থেকে এলাকাবাসীর বিক্ষোভের মুখে গা ঢাকা দিয়ে থাকায় অভিযুক্ত শাহ আলমের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে শাহ আলমের ভাই শামসুল আলম বলেন, ‘ওই কিশোর নিজের বোনকে ধর্ষণ করেছে বলে নিজেই আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। এখন এলাকার কিছু লোকজন মিলে আমাদের থেকে টাকা খাওয়ার জন্য এসব অপবাদ রটাচ্ছে। তাদের বড় বোনও এসব খারাপ কাজ করে জেলে গেছে। তাদের পুরো পরিবারই খারাপ। আপনারা (সাংবাদিক) এলাকার মানুষের সাথে কথা বলে দেখেন।’
শিলক ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি মোহাম্মদ রাশেদ ও শিলক ইউনিয়ন ছাত্রলীগের ছাত্রলীগের সভাপতি মোহাম্মদ বাদশা অভিযোগ করে বলেন, ‘বৃদ্ধ শাহ আলমই এই শিশুর ধর্ষণকারী। কিন্তু প্রশাসন প্রকৃত দোষী ব্যক্তিকে আড়াল করতে ন্যক্কারজনকভাবে ধর্ষিত শিশুর কিশোর ভাইকে গ্রেপ্তার করেছে। এলাকাবাসীর পক্ষে এই ঘটনার প্রতিবাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। যতদিন না পর্যন্ত মূল অভিযুক্ত শাহ আলমকে গ্রেপ্তার করা না হবে।’
এদিকে ঘটনার প্রতিবাদে অভিযুক্ত বৃদ্ধ শাহ আলমের শাস্তির দাবিতে মানবন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছে শিলক ইউনিয়নের সাধারণ মানুষ। এলাকাবাসী অভিযুক্ত শাহ আলমের শাস্তি চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
বাংলা মেইল ২৪ডট কম এর সৌজন্যে
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন