’শহীদুল ইসলাম : বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে জাতির কাছে হরতাল না করার অঙ্গীকার করেছিলেন। ১৯৯৮ সালের ১৫ নবেম্বর তিনি ঘোষণা করেন, ‘বিরোধী দলে গেলেও আমরা কখনও হরতাল করব না।’ কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনে হেরে যাবার পর বিরোধী দলে এসে এই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এসে আওয়ামী লীগ হরতাল কর্মসূচি পালন করে। গত ৪ টার্মের গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে হরতাল, অবরোধ ও অসহযোগ আন্দোলনের মতো কর্মসূচি আহ্বানের দিক থেকে আওয়ামী লীগই অনেক বেশি এগিয়ে আছে। ১৯৯১-৯৬ সাল পর্যন্ত সময়ে আ’লীগ ১৭৩ দিন হরতাল আহ্বান করেছিল। আর আ’লীগ সরকারের ৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত সময়ে বিএনপি তথা বিরোধী দল হরতাল আহ্বান করেছিল মাত্র ৫৯ দিন। ২০০১-২০০৬ পর্যন্ত সময়ে ৪ দলীয় জোট সরকারের আমলে ১৩০ দিন হরতাল দিয়েছিল আ’লীগ।
২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ১০ অক্টোবর সরকার গঠন করেছিল। বিএনপি সরকারের এক মাস ২২ দিনের মাথায় ২০০১ সালের ২ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ রাজধানী ঢাকায় প্রথম হরতাল পালন করে।
গত ৪ টার্মের গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে হরতাল, অবরোধ ও অসহযোগ আন্দোলনের মতো কর্মসূচি আহ্বানের দিক থেকে আওয়ামী লীগের বেকর্ড সর্বকালের সেরা। ১৯৯১ সালের গণতান্ত্রিকব্যবস্থার পর থেকে বর্তমান ২০১০ পর্যন্ত ২০ বছরের মধ্যে ১৯৯৫-৯৬ ও ২০০৬-০৭ সালেই সবচেয়ে বেশি ‘ধ্বংসাত্মক’ রাজনৈতিক কর্মসূচি পালিত হয়েছে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে ১৯৯৬ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ২১টি হরতাল করেছে আওয়ামী লীগ। ৯৬’র মধ্য ফেব্রুয়ারি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এ সময় টানা ৩৯ দিন দেশে অসহযোগ আন্দোলনও চলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর পরই শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন, বিএনপিকে একদিনের জন্যও শান্তিতে থাকতে দেয়া হবে না। আর বিএনপির দ্বিতীয় মেয়াদে জোট সরকারের সময় ২০০৬ সালের অক্টোবর থেকে চলে টানা অবরোধ-হরতালের কর্মসূচি। আওয়ামী লীগই এই দু’ মেয়াদের এসব কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দিয়েছে।
১৯৯১ পরবর্তী সরকারব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের হরতালের বিষয়টি অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত বিএনপি সরকারে থাকাকালে আওয়ামী লীগ ১৭৩ দিন হরতাল পালন করে। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে বিরোধী দল বিএনপি জাতীয় পর্যায়ে ৫৯ দিন হরতাল পালন করেছে (সূত্র : আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা বিভাগ থেকে ২০০৫ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত)। এই ৫ বছরের মেয়াদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও স্থানীয় পর্যায়ে ৮ দিন হরতাল পালন করে। গত চারদলীয় জোট সরকারের সময় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল ২০০১ সাল থেকে ২০০৭ পর্যন্ত সারা দেশে ১৩০টি হরতাল পালন করেছে।
বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ হরতালকে ‘ধ্বংসাত্মক’ কর্মসূচি বলে আখ্যায়িত করলেও দেখা গেছে হরতাল ডাকার দিক থেকে বরাবরই প্রথম স্থানে রয়েছে তারা। এমনকি জাতির সামনে হরতাল না করার অঙ্গীকার করেও বিরোধী দলে গিয়ে তারা ঠিকই হরতাল ডেকেছে।
১৯৯৪ সাল ঃ ২৬ এপ্রিল হরতাল, ১০ সেপ্টেম্বর অবরোধ, ১১, ১২ ও ১৩ সেপ্টেম্বর হরতাল, ২৭ সেপ্টেম্বর অবরোধ, ৩০ নভেম্বর অবরোধ, ৭ ও ৮ ডিসেম্বর হরতাল, ২৪ ডিসেম্বর অবরোধ, ২৯ ডিসেম্বর অবরোধ।
১৯৯৫ সাল ঃ ২, ৩ ও ৪ জানুয়ারি হরতাল, ১৯ জানুয়ারি অবরোধ, ২৪ ও ২৫ জানুয়ারি হরতাল, ১২ ও ১৩ মার্চ লাগাতার ৪৮ ঘণ্টা হরতাল, ২৮ মার্চ ঢাকা অবরোধ, ৯ এপ্রিল ৫ বিভাগে হরতাল, ২ ও ৩ সেপ্টেম্বর লাগাতার ৩২ ঘণ্টা হরতাল, ৬ সেপ্টেম্বর সকাল-সন্ধ্যা হরতাল, ১৬, ১৭, ১৮ সেপ্টেম্বর লাগাতার ৭২ ঘণ্টা হরতাল, ৭ এবং ৮ অক্টোবর পাঁচ বিভাগে লাগাতার ৩২ ঘণ্টা হরতাল, ১৬, ১৭, ১৮ এবং ১৯ অক্টোবর লাগাতার ৯৬ ঘণ্টা হরতাল, ৬ নভেম্বর ঢাকা অবরোধ, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫ এবং ১৬ নবেম্বর প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা হরতাল, ৯, ১০ এবং ১১ ডিসেম্বর লাগাতার ৭২ ঘণ্টা হরতাল, ১৭ ডিসেম্বর সকাল-সন্ধ্যা হরতাল, ৩০ ডিসেম্বর দেশব্যাপী অবরোধ।
১৯৯৬ সাল : ৩ ও ৪ জানুয়ারি লাগাতার ৪৮ ঘণ্টা হরতাল, ৮ ও ৯ জানুয়ারি লাগাতার ৪৮ ঘণ্টা হরতাল, ১৭ জানুয়ারি সকাল-সন্ধ্যা হরতাল, ২৪ জানুয়ারি সিলেটে ১১ ঘণ্টা হরতাল, ২৭ জানুয়ারি খুলনায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল, ২৮ জানুয়ারি খুলনায় অর্ধদিবস হরতাল, ২৯ জানুয়ারি ঢাকায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল, ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল, ১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় হরতাল, ৩ ফেব্রুয়ারি অর্ধদিবস হরতাল, ৭ ফেব্রুয়ারি ফেনীতে সকাল ৬টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত হরতাল, ৮ ফেব্রুয়ারি ফেনীতে হরতাল, ১০ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে হরতাল, ১১ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জে হরতাল, ১৩ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী অবরোধ, ১৪ এবং ১৫ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী ৪৮ ঘণ্টা লাগাতার হরতাল, ২৪, ২৫, ২৬ ও ২৭ ফেব্রুয়ারি লাগাতার অসহযোগ, ৯ মার্চ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত লাগাতার ২২ দিন অসহযোগ।
১৯৯৫-৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ে হরতাল-অবরোধ অসহযোগসহ বিভিন্ন কঠোর আন্দোলন করেছিল বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ১৯৯৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে ৭২ ঘণ্টার লাগাতার হরতাল করেছিল তৎকালীন বিরোধী দলে থাকা আওয়ামী লীগ। তাদের দাবি আদায়ে আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে ’৯৬ সালের ৯ মার্চ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত টানা ২২ দিন অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয় আওয়ামী লীগ। এরপর পর্যায়ক্রমে শুরু হয় আরো কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি। তত্ত্বাবধায়কের দাবিতে তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে ১৭৩ দিন হরতাল পালন করেছিল আওয়ামী লীগ। দাবি আদায়ে বিরোধী দলে থাকা আওয়ামী লীগের আন্দোলনে অচল হয়ে পড়ে পুরো দেশ। জনজীবনে নেমে আসে বিপর্যয়। কঠোর আন্দোলনের এক পর্যায়ে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে সংযোজন করা হয়। জানা যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ে লাগাতার হরতাল, অবরোধ ও অসহযোগ আন্দোলনের মতো কঠোর কর্মসূচি পালন করেছিল আওয়ামী লীগ। তাদের আন্দোলন সংগ্রামের ফলে নেমে আসে অস্থিরতা। কার্যত অচল হয়ে পড়ে পুরো দেশ। সে সময় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছিল দেশের মানুষকে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৯৫ সালের ১৬ থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর তিন দিনে বাহাত্তর ঘণ্টার লাগাতার হরতাল আহ্বান করে আওয়ামী লীগ। এরপর ৭ ও ৮ অক্টোবর পাঁচ বিভাগে লাগাতার ৩২ এবং ১৬ থেকে ১৯ অক্টোবর ৯৬ ঘণ্টার হরতাল করেছিল দলটি। এরপর ৬ নবেম্বর ঢাকা অবরোধ করেছিল তারা। পরে ১১ থেকে ১৬ নবেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল- সন্ধ্যা হরতাল করে। দাবি পূরণ না হওয়ায় ৯ থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭২ ঘণ্টার হরতাল এবং ১৭ ডিসেম্বর সকাল-সন্ধ্যা হরতাল করে তারা। এরপর ৩০ ডিসেম্বর দেশব্যাপী অবরোধ করে আওয়ামী লীগ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দাবি আদায় না হওয়ায় পরের বছর ১৯৯৬ সালে আরো কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে আওয়ামী লীগ। এতে সারা দেশে কঠিন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল। দাবি আদায়ে সব আন্দোলন সংগ্রামে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, ’৯৬ সালের ৩ থেকে ৪ এবং ৮ ও ৯ জানুয়ারি লাগাতার ৪৮ ঘণ্টার হরতাল পালন করে আওয়ামী লীগ। আর ১৭ জানুয়ারি দেশজুড়ে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল করে দলটি। পরে ২৪ জানুয়ারি সিলেটে, ২৭-২৮ জানুয়ারি খুলনায় এবং ২৯ জানুয়ারি ঢাকায় হরতাল করে আওয়ামী লীগ। অতঃপর ১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় হরতাল। ৩ ফেব্রুয়ারি অর্ধদিবস হরতাল, ৭-৮ ফেব্রুয়ারি ফেনীতে, ১০ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে, ১১ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জে হরতাল করে ওই সময়ের বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। জানা যায়, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত সে সময় কঠোর আন্দোলনের দিকে অগ্রসর হয় বর্তমান সরকারি দল। দাবি আদায়ে ১৩ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী অবরোধ করে তারা। পরে ১৪-১৫ ফেব্রুয়ারি দেশজুড়ে ৪৮ ঘণ্টা লাগাতার হরতাল পালন করে আওয়ামী লীগ। আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে ২৪-২৭ ফেব্রুয়ারি লাগাতার অসহযোগ এবং সবশেষে ৯৬ সালের ৯ মার্চ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত টানা ২২ দিন অসহযোগ কর্মসূচি পালন করে আওয়ামী লীগ। এভাবেই কঠোর আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করেছিল বর্তমান সরকারি দল। ফলে সে সময় সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংযোজন করতে বাধ্য হয় বর্তমান বিরোধী দল বিএনপি।
উৎসঃ দৈনিক সংগ্রাম
্
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন