শিক্ষা জীবনে পরীক্ষা চলাকালীন সময়টুকু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন শিক্ষার্থীর সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়া এবং স্বপ্ন বাস্তবায়ন যেমন পরীক্ষায় ভাল রেজাল্টের মাধ্যমে হয়, তেমনি তার জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে একটি পরীক্ষা বা পরীক্ষা চলাকালীন ছোট্ট কোন দুর্ঘটনা।
শিশুদের মন অতিশয় কোমল। তাই পরীক্ষা চলাকালীন সময় তারা নানাবিধ মানসিক চাপে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। একজন পরিণত বয়সের মানুষ যেমন বাড়তি মানসিক চাপ নিয়ে তার কাজ-কর্ম স্বাভাবিক নিয়মে চালিয়ে যেতে পারে না, শিশুদের বেলায় কথাটা আরো বেশি প্রযোজ্য। তাই পরীক্ষা চলাকালীন পরীক্ষার্থীদের উপর অতিরিক্ত মানসিক চাপ সৃষ্টি হয় এমন আচরণ করা উচিৎ হবে না। পরীক্ষার্থীদের উপর লেখাপড়া ও পরীক্ষার প্রস্তুতি ছাড়া প্রাসঙ্গিক এবং অপ্রাসঙ্গিক অতিরিক্ত চাপ যেন না পড়ে সেজন্য অভিভাবকদের সতর্ক থাকতে হবে।
অনেক সময় দেখা যায় পরীক্ষার প্রস্তুতি কেমন হয়েছে তা নিয়ে পরীক্ষার্থীর তুলনায় অভিভাবক বেশি টেনশন করেন। টেনশন থাকতে পারে তবে তা পরীক্ষার্থীর সামনে বারবার প্রকাশ করা ঠিক নয়। এতে তার উপর মানসিক চাপ বেড়ে যায় এবং এই বাড়তি মানসিক চাপ তার মাঝে পরীক্ষাভীতির জন্ম দেয়।
সারাক্ষণ পরীক্ষা বিষয়ক আলাপ পরিহার করতে হবে। অনেক অভিভাবক পরীক্ষা চলাকালীন ঘরে/বাসায় এমন এক পরিবেশ তৈরি করে রাখেন যেন পরিবারের একমাত্র কাজ সন্তানের পরীক্ষা। পরীক্ষা শুরু হওয়া থেকে শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাসায় মেহমান আসাটা তাদের অপছন্দ। এমনকি প্রয়োজনীয় কাজে নিকটাত্বীয়-স্বজন আসাটাও তাদের কাম্য নয়। সারাক্ষণ শুধু পরীক্ষা, পরীক্ষা আর পরীক্ষা। পরীক্ষা চলাকালীন বাসার পরিবেশ এতটা এক ঘেঁয়ে করা ঠিক নয়। এতে পরীক্ষার্থীদের মনে নেগেটিভ প্রভাব পড়ে এবং পরীক্ষাভীতি তৈরি হয়ে যায়।
সারাক্ষণ লেখাপড়ায় ব্যস্ত রাখা ঠিক নয়। অনেক অভিভাবক মনে করেন, পরীক্ষা চলাকালীন সন্তান যত বেশি পড়বে, যত বেশি সময় পড়ার টেবিলে বসে থাকবে, রেজাল্ট তত ভাল হবে। আসলে এ ধারণা ঠিক নয়। জানার জন্য পড়া আর পরীক্ষা পাশের জন্য পড়া এক নয়। পরীক্ষা কেন্দ্রে নির্ধারিত সিলেবাসে প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর লেখাই পরীক্ষার্থীর কাজ। এর জন্য দরকার সারা বছরের নিয়মিত ও নিয়ন্ত্রিত তদারকি।
কোন কোন অভিভাবককে দেখা যায় গাড়িতে করে পরীক্ষা কেন্দ্রে নিয়ে যাবার সময়ও সন্তানকে পড়তে বাধ্য করেন। এমনকি পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশের সময়েও অনেককে বই হাতে পড়তে দেখা যায়। এটা বাড়াবাড়ি এবং পরীক্ষার্থীর উপর একপ্রকার মানসিক টর্চার। পরীক্ষার্থীদেরকে পরীক্ষার পড়া নিয়ে অতটা চাপের মধ্যে রাখা ঠিক নয়।
মনে রাখতে হবে, পরীক্ষায় ভাল ফল করতে হলে পরীক্ষা চলাকালীন লেখাপড়ার পাশাপাশি একজন পরীক্ষার্থীর জন্য প্রয়োজনীয় শারীরিক এবং মানসিক বিশ্রাম অপরিহার্য।
বর্তমানে ভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে পরীক্ষা দিতে হয়। নকল প্রতিরোধে এটা একটা কার্যকর ব্যবস্থা। অপরিচিত পরিবেশে এসে অনেকে নার্ভাস হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ছাত্রীরা লজ্জা ও সংকোচবশত নিজেদের খারাপ লাগা বা তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় বিষয়টি পরীক্ষা কেন্দ্রে দায়িত্বরত অপরিচিত শিক্ষকের কাছে সহজে বলতে চায় না। শিক্ষক যিনি তিনি সবার শিক্ষক। শিক্ষক মানে শিক্ষার্থীর অভিভাবক, প্রকৃত বন্ধু এবং হিতাকাংঙক্ষী। তাই তাঁকে ভয় পাওয়া বা সংকোচ করার কোন কারণ নেই। পরীক্ষার্থীদেরকে এই শিক্ষা দিতে হবে যে, পরীক্ষা কেন্দ্রে কোন অসুবিধা হলে সাথে সাথে কক্ষে দায়িত্বরত শিক্ষককে জানাতে হবে এবং তিনি সর্বাত্মক সহযোগিতা করবেন।
এক্ষেত্রে শিক্ষকের দায়িত্ব সব চেয়ে বেশি। ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সাথে কিংবা সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ভেদাভেদ করা উচিৎ নয়। এতে পরীক্ষার্থীরা মানসিক চাপে পড়ে যায়। পরীক্ষা কক্ষে দায়িত্বরত শিক্ষককেই এমন পরিবেশ তৈরি করে নিতে হবে যাতে পরীক্ষার্থীরা নকল করবে না, দেখাদেখি করবে না, অসদাচরণ করবে না কিন্তু নির্ভয়ে উত্তর লিখবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। কোন কোন শিক্ষক পরীক্ষা কেন্দ্র ও কক্ষে এমন আচরণ করেন যা দেখে শিক্ষার্থীরা ভয় পেয়ে যায়, নার্ভাস হয়ে পড়ে। আগেই উল্লেখ করেছি যিনি শিক্ষক তিনি নির্দিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হাতেগোনা কিছু শিক্ষার্থীর শিক্ষক নন, তিনি সবার শিক্ষক। দীর্ঘ তিন ঘণ্টা যাবত একটি কক্ষে একজন দায়িত্ববান শিক্ষক দায়িত্ব পালন করলেন অথচ তাঁকে দেখে কিংবা তাঁর কাছ থেকে ভিন্ন পরিবেশ ও ভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে আসা শিক্ষার্থীরা জীবন গড়ায় কাজে আসে এরকম একটি শিক্ষাও যদি না পায়, তা হবে দুঃখজনক। একজন শিক্ষক শুধু শ্রেণি কক্ষেই শিক্ষক নন, বরং তিনি পরীক্ষা কক্ষেও শিক্ষক। তাঁকে দেখে পরীক্ষার্থীরা যদি শুধু ‘ভয় পাওয়া’ শেখে তাহলে তিনি এবং অপরাধ দমনে অস্ত্র হাতে দ্রুতবেগে ছুটে চলা পুলিশের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
আমাদের দেশে পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে বের হলেই ‘তোমার পরীক্ষা কেমন হয়েছে? কত নম্বরের উত্তর লিখেছ?’ পরীক্ষার্থীকে অভিভাবকরা এজাতীয় কিছু কমন প্রশ্ন বারবার করতে থাকেন। কোন কোন অভিভাবকতো বাসায় ফিরে রীতিমত প্রশ্নপত্র হাতে কাগজ-কলম নিয়ে বসে যান। এতে পরীক্ষার্থীর উপর বাড়তি মানসিক চাপ বৃদ্ধি ছাড়া লাভ কিছু হয় বলে আামর জানা নেই।
পরীক্ষা শিক্ষা ব্যবস্থার একটি নিয়মিত স্বাভাবিক কার্যক্রম। পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীর মনে পরীক্ষাভীতি চলে আসে এজাতীয় কিছু না করে তাকে বরং এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যাতে সে স্বাভাবিক থাকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন