র্যাব-পুলিশের বেপরোয়া গুলি : রেহাই পাচ্ছে না স্কুলছাত্রী, দোকান কর্মচারী, সাধারণ পথচারীআব্দুল লতিফ রানা, ঢাকা: সরকারের নির্দেশ মানতে গিয়ে বেপরোয়াভাবে গুলি ছুঁড়ছে এক শ্রেণীর পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা। সাম্প্রতিক সময়ে বিরোধী দলের কর্মীদের গ্রেফতারের নামে নির্বিচারে গুলি করা হয়েছে অনেককেই। এদের মধ্যে রয়েছে স্কুলছাত্রী, দোকান কর্মচারী, সাধারণ পথচারীও। সরকারি নির্দেশ তো আছেই, তার উপর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্য বাহবা নেওয়ার জন্য অতি উৎসাহী হয়ে এসব করছে। অবশ্য, এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে তাদের গ্রেফতার বাণিজ্যও।
দেখা যাচ্ছে, কোথাও বোমা বা ককটেল ফুটলে এর পরপরই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কোনো দিকে না তাকিয়েই বেপরোয়া গুলি ছুঁড়ছে। কার গায়ে গুলি পড়ছে সেটাও তারা তাকিয়ে দেখছে না। এতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণ নিরীহ পথচারী অথবা ফুটপাতের দোকানী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলির শিকার হচ্ছে।
আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, প্রথমে গ্রেফতার তারপরেই পুলিশ সদস্যরা ঠা-া মাথায় গুলি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেফতার করতে না পেরে সাধারণ মানুষকে গ্রেফতার ও পরে গুলি করে দেওয়া হচ্ছে রাজনৈতিক পরিচয়। গুলিবিদ্ধরা অধিকাংশই বলছেন, তারা কোন রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত নন।
অপরদিকে এভাবে গুলি করাকে কৃতিত্ব হিসেবে দেখছে পুলিশ বিভাগ। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ২৫ পুলিশ সদস্যকে নগদ সাড়ে ৫ লাখ টাকা পুরস্কার প্রদান করেছেন গুলি করে মানুষদের আহত করার জন্য। গুলিবিদ্ধদের পরিচয় তুলে ধরা হচ্ছে হামলাকারী, নাশকতাকারী, পরিকল্পনাকারী ও জড়িত সন্দেহকারী হিসেবে। তবে গুলিবিদ্ধরা বলছেন, তারা নিরপরাধ। তারা কোন রাজনৈতিক দলের কর্মী নন।
এ অভিযোগের বিষয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আশ্বাস দিয়ে বলছেন, গ্রেফতার বাণিজ্য ও গুলি ছোঁড়ার অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা হবে। পুলিশের নিজস্ব গোয়েন্দা বিভাগ এসব বিষয় খোঁজ নিচ্ছেন। বাস্তবে এসব আশ্বাস বাস্তবায়নের কোনো নজির তো নেইই, বরং নিরীহ মানুষ গুলির শিকার হওয়ার মাত্রা আরো বাড়ছেই বলা যায়।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় সিলেট নগরীতে বিরোধীদলের মিছিলকে লক্ষ্য করে পুলিশ গুলি ছোঁড়ে। এসময় পুলিশের গুলিতে শর্মী দেব নামে এক এসএসসি পরীক্ষার্থী আহত হয়। পুলিশের ছোঁড়া গুলি তার ডান চোখের নিচে বিদ্ধ হয়। সন্ধ্যা ৬টার দিকে সিলেটের মীরাবাজারে এ ঘটনা ঘটে। সে কিশোরী মোহন বালিকা বিদ্যালয় হতে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে।
এ ঘটনার পর সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার(গণমাধ্যম) মো: রহমত উল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, মীরাবাজারে পিকেটারদের লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া হয়েছে। তখন কোন শিক্ষার্থীকে গুলি করা হয়নি।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাত সোয়া ৮টার দিকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর ধোলাইপাড় এলাকায় পুলিশ গুলি করেছে আতাউর রহমান (২৭) নামে এক যুবককে। পুলিশ দাবি করছে, বিআরটিসি’র একটি বাসে পেট্রলবোমা নিক্ষেপের চেষ্টার সময় গুলিতে সে আহত হয়েছে। হাসপাতালে আহত আতাউর ও তার পরিবার অভিযোগ করেছেন, পুলিশ কোন কারণ ছাড়াই তার ডান পায়ের হাঁটুতে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করেছে। আতাউরের বাবার নাম জসিম উদ্দিন। নেত্রকোনার খালিয়াজুড়ির কৃষ্ণপুর গ্রামে তাদের বাড়ি।
তিনি অ্যামব্রয়ডারির ব্যবসা করেন। যাত্রাবাড়ীর দীন মোহাম্মদ মার্কেটের পাঁচতলায় ‘সাদিয়া অ্যামব্রয়ডারি হাউজ’ নামে তার একটি দোকান রয়েছে। তিনি নারায়ণগঞ্জে স্যাম ডিজাইন গার্মেন্টস থেকে পাওনা টাকা নিয়ে ধোলাইপাড়ে নেমে রাস্তার পাশে প্রস্রাব করতে বসেছিলেন।
এসময় কিছু যুবক তার টাকা ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে তাকে ধরে মারধর করে। একপর্যায়ে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। এসময় পুলিশ কোন কিছু না বলেই তার হাটুতে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। পরে তাকে পুলিশের গাড়িতেও হাসপাতালে নেয়া হয়। কোন রাজনীতির সাথে জড়িত নন বলে জানান তিনি ।
এছাড়া, রাজধানীর শেরে বাংলানগর জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন পুলিশের গুলিতে আহত আমেনার দু’টি চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। ঢাকার রামপুরা এলাকায় পুলিশের সাথে হরতালকারীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও গোলাগুলি হয়।
এসময় গৃহবধু আমেনার চোখে পুলিশের ছোড়া শর্টগানের গুলি বিদ্ধ হয়। তার চোখসহ শরীরের ৮৬টি জায়গায় গুলির স্প্রিন্টার বিদ্ধ হয়। গুলির স্প্রিন্টারে তার দুই চোখের রেটিনা ছিঁড়ে গেছে।
তার চোখ ফিরে পেতে লক্ষাধিক টাকা লাগবে বলে চিকিৎসকগণ জানিয়েছেন। কিন্তু তার রিকসা চালক স্বামীর পক্ষে এ টাকা যোগানো সম্ভব হবে না বলে তিনি জানিয়েছেন।
গত শনিবার বিকেলে ৯০ নম্বর ওয়ার্ড যুবদল নেতা শুভকে গ্রেফতার করতে শ্যামপুর থানার পোস্তগোলা এলাকায় অভিযান চালায় পুলিশ। এ সময় শুভকে না পেয়ে তার ছোট ভাই জিদানকে পুলিশ মোটর সাইকেলসহ আটক করে। পরে বন্দুকের বাট দিয়ে রাস্তায় শুইয়ে তার মাথা থেতলে দেয়। এসময় মাথা ফেটে যায় বলে জানান তার চাচা। জিদান শ্যামপুর এলাকার একটি স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র।
জিদানের পরিবার জানায়, পুলিশ জিদানকে আটকের পর তাকে লক্ষ্য করে প্রথমে গুলি করে। কিন্তু গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে পুলিশ তাকে ধরে রাস্তার ওপর ফেলে বেদম প্রহার করে। পরে তাকে শ্যামপুর থানায় নিয়ে আটকে রাখা হয়। একপর্যায়ে উত্তেজিত লোকজন থানা ঘেরাও করতে গেলে পুলিশ তাদের ওপর কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এরপর আহত জিদানকে পুলিশ ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করে।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি কাওছার (৩০) নামে এক কাঁচামাল ব্যবসায়ী চাঁদপুর ফরিদগঞ্জের গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় ফেরেন। তিনি টেম্পোযোগে তার বাসাবোর বাসায় যাচ্ছিলেন। শাহজাহানপুর আমতলায় রাস্তার ওপর লোকজনের জটলা দেখে টেম্পুর অন্য যাত্রীদের সাথে তিনিও নামেন।
একপর্যায়ে পুলিশ তাদেরকে ধাওয়া করলে লোকজন দৌঁড় দেয়। এ সময় পুলিশ কাওছারকে ধরেই তার পায়ে গুলি করে। এতে তিনি গুরুতর আহত হয়। পরে তাকে পেট্রলবোমা নিক্ষেপকারী উল্লেখ করে হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করে পুলিশ। আহত কাউসার জানান, তিনি মাদারটেক চৌরাস্তায় কাঁচামালের ব্যবসা করে সংসার চালান। কোন রাজনীতিও করেন না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন