৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৫: ২০ দলীয় জোটের কর্মসূচিকে ঘিরে দেশজুড়ে চলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান। আর সেই অভিযানকে কেন্দ্র করে কোনো কোনো এলাকায় ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের পর গুলি-নির্যাতন এবং তাদের বাড়িঘর ভাঙচুরের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। কোনো কোনো এলাকায় জোটের নেতাকর্মীরা নিজ বাড়িতে অবস্থান করতে পারছেন না বলেও জানা গেছে। বাড়ির নারী-শিশুরাও পুলিশি হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয় ও দলীয় সূত্র জানায়, যশোর সদর ও ঝিকরগাছা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের বাড়িতে হামলা অব্যাহত রয়েছে। প্রতি রাতে পুলিশের পোশাক পরিহিত বাহিনী এই হামলা চালাচ্ছে বলে ভূক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন।
স্থানীয় সূত্র জানায়, গত রোববার রাতে সন্ত্রাসীরা হামলা চালায় ঝিকরগাছা-চৌগাছা এলাকার সাবেক দুই সংসদ সদস্য মকবুল হুসাইন ও মুহাদ্দিস আবু সাঈদের বাড়িতে। মুহাদ্দিস আবু সাঈদ জানান, ৫০-৬০ জন সন্ত্রাসী তার ঝিকরগাছা পৌর এলাকার পুরন্দপুর গ্রামের বাসায় হামলা করে। তারা ঘরের সব আসবাবপত্র ভাঙচুর ও তছনছ করে।
মকবুল হুসাইন জানান, সন্ত্রাসীরা ঝিকরগাছা উপজেলার নওয়াপাড়ার তার দুই ছেলে মাহমুদ হাসান ও মওদুদ হাসানের বাসায় হামলা চালিয়ে ঘরের আসবাবপত্রে আগুন ধরিয়ে দেয়। টিভি ও খাট কুড়াল দিয়ে কেটে ফেলে। এ ছাড়াও ঝিকরগাছা ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার নওয়াপাড়া গ্রামের আশরাফুল ইসলামের বাড়িতেও হামলা হয়। উপজেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু মুসা মিন্টুর জয়কৃষ্ণপুর গ্রামের বাড়িতে ও যুবদল নেতা ইউপি মেম্বার আইয়ুব হোসেনের পদ্মপুকুর গ্রামের বাড়ি এবং উপজেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি আরাফাত কল্লোলের কীর্তিপুর গ্রামের বাড়িতে হামলা চালিয়ে তাদের আসবাবপত্র ও লেপ-তোষকে আগুন ধরিয়ে দেয়। অন্যান্য জিনিসপত্রও তারা ভাঙচুর ও তছনছ করে। এ ছাড়া উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোর্তজা এলাহী টিপুর বাড়িতে তল্লাশির নামে বাড়ির আসবাবপত্র ভাঙচুর ও তছনছ করে। ঝিকরগাছার শহীদ নাজমুল ইসলাম ফাউন্ডেশনের সব আসবাবপত্র, মোটরসাইকেল, টিবি ও ফ্রিজ ভাঙচুর করে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে প্রতিটি বাড়িতে হামলার সময় সন্ত্রাসীরা টাকা, সোনার গয়না প্রভৃতি লুট করেছে। এ দিকে ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেন, যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও ঝিকরগাছা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলমের পায়ে গুলি করার পরও এলাকায় তাণ্ডব থামেনি। তিন দিন ধরে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি হামলা চলছে। সোমবার রাতে তৃতীয় দফা হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের ঘটনা ঘটেছে। এ বিষয়ে পুলিশ সুপারের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পুলিশের দেয়া আগুনে ভস্মীভূত চাতালের সামনে থেকে ১ ফেব্রুয়ারি শত শত মানুষের উপস্থিতিতে খোরশেদ আলমকে কোতোয়ালি থানার এসআই বিপ্লব ও এসআই জীবন আটক করে। আটকের কথা এসআই জীবন স্বীকার করলেও ওসি ইনামুল হক তা অস্বীকার করেন। পরে ওসি সাংবাদিকদের বলেন, খোরশেদ আলমের এমন অবস্থায়ও ওসি জানান, বেনাপোল সড়কে গাড়িতে আগুন দেয়ার সময় বিক্ষুব্ধ জনতা তাকে তাড়িয়ে ধরে পিটিয়ে পা ভেঙে দিয়েছে।
খোরশেদ আলমের পরিবারের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করা হয়েছে, ১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টায় পুলিশ খোরশেদ আলমকে তার চাতাল থেকে শত শত মানুষের উপস্থিতিতে আটক করে। পরে তার বাম পায়ে দু’টি গুলি করা হয়।
খোরশেদ আলমের ছেলে তৌহিদুল ইসলাম রাজু ও ভাই শেফায়েত হোসেন মোহন জানান, তাকে গুলি করার আগের রাত ১টার দিকে একদল পুলিশ এসে চাতালে পেট্রল ঢেলে আগুন লাগায়। এতে চাতালে রক্ষিত ১৬ লাখ টাকার চালসহ অফিস রুমের টিভি, ফ্রিজ, আসবাবপত্র ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সবই পুড়ে যায়। চাতালের কিছুই বাঁচানো যায়নি। ক্ষতির পরিমাণ ৫০ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে তারা জানান।
এ দিকে পুলিশ খোরশেদ আলমের চাতাল পুড়িয়ে ও তাকে গুলি করার পরও যশোর-বেনাপোল সড়কে ট্রাক ও প্রাইভেটকার পোড়ানোর ঘটনায় ও ঝিকরগাছা উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও ঝিকরগাছা ইউপি চেয়ারম্যান খোরশেদ আলমের বিরুদ্ধে মামলা করে।
মনিরামপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বাড়িতে বোমা হামলা ও আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটেছে। দুর্বৃত্তরা সোমবার রাতে বিএনপি সভাপতি ও মনিরামপুর পৌরমেয়র শহীদ ইকবাল হোসেনের বাড়িতে পেট্রলবোমা ছোড়ে। এ ছাড়া সাধারণ সম্পাদক ও শ্যামপুকুর ইউপি চেয়ারম্যান মশিউর রহমানের বাড়ির বিচালি গাদায় আগুন ধরিয়ে দেয়।
শহীদ ইকবাল জানান, রাত ৩টার দিকে তার বাসায় বোমা ছোড়ার ঘটনা ঘটে। তার বাসা মনিরামপুর থানার কাছেই।
সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান জানান, আমিনপুর গ্রামে তার বাড়িতে দুর্বৃত্তরা হামলা চালায় রাত ১২টার দিকে। আগুন লাগার খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
মাগুরা শহরের ভায়নামোড়, চোপদারপাড়া ও পারনান্দুয়ালী এলাকায় বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের প্রায় ২০টি বাড়িতে পুলিশ গ্রেফতারের নামে ভাঙচুর চালিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে আসামি ধরতে গিয়ে কোনো ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেনি বলে পুলিশ সুপার জিহাদুল কবির দাবি করেন।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, রোববার রাতে পারনান্দুয়ালী গ্রামের ইব্রাহীম, রাজীব, রাসেল, আজমীর হোসেন, মিজানুর রহমান, কুতুব উদ্দিন, আমিরুল ইসলাম, শাখের, তিতাস, শফিকুল, ইকলাসসহ ছাত্রদল ও যুবদলের প্রায় ২০টি বাড়িতে গ্রেফতার অভিযানের নামে ভাঙচুর করে বলে পরিবারের প থেকে দাবি করা হয়।
সাবেক যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক আশরাফুজ্জামান শামীমের স্ত্রী পাপিয়া শারমিন জানান, শনিবার ও রোববার রাতে বাড়িঘর তল্লাশির নামে জানালার গ্লাস ও ঘরের আসবাবপত্র ভাঙচুর করে পুলিশ। ১০ জানুয়ারি পুলিশ একইভাবে বাড়িঘর তল্লাশি করে ভাঙচুর চালিয়েছিল। টিনের চালের ওপর বৃষ্টির মতো ইট নিপে করে আতঙ্ক সৃষ্টি করে চলে যাওয়ার সময় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান স্বামীকে হাজির করে দিতে বলে, অন্যথায় পুলিশ ধরতে পারলে গুলি করে ক্রস ফায়ার বলে চালিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে চলে যায়। এক সপ্তাহে ১৪ বার পুলিশ আমাদের বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে বলেও শামীমের স্ত্রী জানান।
পারনান্দুয়ালী গ্রামের ফরিদ হোসেন জানান, তার ছোট ভাই জাহিদ ও শাকের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর ঢাকায় গিয়ে চাকরি করছে। এক বছর তারা মাগুরা ছেড়ে গেলেও রোববার রাতে পুলিশ তাদের বাড়িঘর ভাঙচুর করেছে। মাগুরা জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি কুতুব উদ্দিনের বাড়িতেও একইভাবে ভাঙচুর করেছে পুলিশ।
পারনান্দুয়ালী গ্রামের রাজমীর হোসেনের বৃদ্ধ মা জানান, আমার ছেলে ঠিকাদারি কাজ করে বলে জানতাম। কোনো দিন অন্যায় কাজ করেছে এমনটি শুনিনি। কিন্তু পুলিশ বাড়িতে এসে যেভাবে রান্নার চুলা, ঘরের দরজা-জানালা, আসবাবপত্র ভাঙচুর করেছে তাতে মনে হয় আমার ছেলে বড় কোনো সন্ত্রাসী। পুলিশের কাছে কেন ভাঙচুর করছেন জানতে চাইলে পুলিশের এসআই মানিক বলেছেন, ছেলেকে হাজির করে দে নইলে বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেবো।
ছাত্রদল কর্মী শফিকুলের বাবা মোকলেছ বিশ্বাস জানান, কোথায় বাস করছি বুঝতে পারছি না। এ দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই কর্মকাণ্ডে বাধা দিতে গিয়ে আহত যুবলীগ নেতা রাজু আহম্মেদ সাংবাদিকদের জানান, রাতে কয়েক গাড়ি পুলিশ পারনান্দুয়ালী গ্রামে আসামি ধরতে অভিযান চালায়। এ সময় তারা আসামিদের না পেয়ে বাড়িতে ভাঙচুর করলে আমি তার প্রতিবাদ করায় পুলিশ আটক করে হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে আহত করে। পরে রাজনৈতিক পরিচয় জানতে পেরে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দিয়ে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে পুলিশ।
অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া মাগুরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেছেন, ওয়ারেন্টের আসামি ধরতে পুলিশ শহরের বিভিন্ন এলাকায় শান্তিপূর্ণ অভিযান পরিচালনা করেছে তবে ভাঙচুরের কোনো ঘটনা তার জানা নেই।
উৎসঃ নয়া দিগন্ত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন