রাজধানী সুপার মার্কেটের কমিটি দখল করে চাঁদাবাজির নেতৃত্ব দিচ্ছেন আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের দুই নেতা। এ অভিযোগ ব্যবসায়ীদের। এঁদের একজন ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ময়নুল হক ওরফে মঞ্জু, তিনি মার্কেট কমিটির স্বঘোষিত সভাপতি এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য। তাঁকে র্যাব খুঁজছে বলে জানিয়েছে। অপরজন হলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম।
র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত গত বৃহস্পতিবার ওই মার্কেটে অভিযান চালিয়ে যুবলীগের নেতা রেজাউল করিমসহ ১১ জনকে আটক করলেও রাজনৈতিক চাপে রেজাউলকে ছেড়ে দেয়। তবে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ১০ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
টিকাটুলীতে অবস্থিত এই মার্কেটে চাঁদাবাজির ব্যাপারে জানতে চাইলে ওয়ার্ড কাউন্সিলর ময়নুল হক গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজধানী ও নিউ রাজধানী সুপার মার্কেট মালিক সমিতির ট্রেড ইউনিয়নের অনুমোদন নিয়ে আমি সভাপতি হয়েছি। আমার লোকজন বিএনপির আমলে এই মার্কেটের ১ হাজার ৬০০-এর বেশি দোকান থেকে যে চাঁদা তুলত, এখনো তাই তুলছে। এ টাকা মার্কেটের নিরাপত্তারক্ষী, সমিতির কর্মচারী ও জেনারেটরের জ্বালানি বাবদ খরচ করা হয়। যেসব ব্যবসায়ী র্যাবের কাছে চাঁদাবাজির অভিযোগ করেছেন, তাঁরা মার্কেট কমিটির সাবেক সভাপতি বাবুলের লোক। এই চাঁদাবাজির বিষয়ে র্যাব আমাকে ডেকে পাঠায়নি বা একটিবার জিজ্ঞাসাবাদও করেনি।’
জানতে চাইলে র্যাবের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক চাপের কারণে যুবলীগ নেতা রেজাউলের বিরুদ্ধে তাঁরা আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেননি। আটকের ২২ ঘণ্টা পর তাঁকে ছেড়ে দিতে হয়। এ ছাড়া ওয়ার্ড কাউন্সিলর ময়নুল হকের চাঁদাবাজিতে জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে র্যাব। কারাগারে পাঠানোর আগে সাজা পাওয়া ১০ জনও ভ্রাম্যমাণ আদালতের কাছে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। র্যাব-১০ এর পরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ওয়ার্ড কাউন্সিলর ময়নুল হককে র্যাব খুঁজছে।
গতকাল দুপুরে ওই মার্কেটে গিয়ে জানা যায়, টিকাটুলির টিনশেডের এই বিশাল মার্কেটে ১ হাজার ৬৮৮টি দোকান রয়েছে। তৈরি পোশাক, শাড়ি ও ক্রোকারিজসহ নানা ধরনের দোকান রয়েছে। মার্কেটের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, জোর করে মার্কেট কমিটির শীর্ষ নেতা বনে যাওয়া ওয়ার্ড কাউন্সিলর ময়নুল হক ও তাঁর ঘনিষ্ঠ যুবলীগের নেতা রেজাউল করিমের নেতৃত্বে এই মার্কেট থেকে মাসে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে। ঈদ সামনে রেখে বর্তমানে একেক দোকান থেকে চাঁদার পরিমাণ বাড়িয়ে ১ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা করা হয়েছে। ওয়ার্ড কাউন্সিলরের উপস্থিতিতে অন্তত ২৫ জন ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতা-কর্মী চাঁদার টাকা তোলেন। চাঁদা না দিলে মার্কেট কমিটির কার্যালয়ে নিয়ে ব্যবসায়ীদের পেটানো হয়।
ব্যবসায়ীরা জানান, চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে ব্যবসায়ীরা র্যাব-১০ এর কাছে কয়েকবার অভিযোগ দিয়েছেন। সপ্তাহখানেক আগে আবার লিখিত অভিযোগ করা হয়। এতে সাড়া না পেয়ে তাঁরা র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ফোন করে ব্যবসায়ীদের রক্ষার আকুতি জানান। এরপর মার্কেটে র্যাবের গোয়েন্দা নজরদারি শুরু হয়।
র্যাব-১০ এর পরিচালক জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর প্রথম আলোকে বলেন, তিন মাস ধরে কিছুদিন পর পর রাজধানী সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তিনি চাঁদাবাজির অভিযোগ পাচ্ছিলেন। এ নিয়ে ব্যবসায়ীরা পুলিশের কাছেও আবেদন করেন। সর্বশেষ তাঁদের অনুরোধে তিনি চাঁদাবাজদের উৎখাতের সিদ্ধান্ত নেন।
কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, ওয়ার্ড কাউন্সিলর ময়নুল ও যুবলীগের নেতা ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন থেকে কমিটির অনুমোদন নিয়েছেন। এর বিরুদ্ধে রিট করা হলে কমিটির কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দেন হাইকোর্ট। কিন্তু অবৈধ কমিটি হাইকোর্টের এ আদেশও মানছে না।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত নন। তিনি কোনো ব্যবসায়ীকে মারধরও করেননি। রাজধানী সুপার মার্কেটে তিনি একটি দোকানের মালিক। বৈধভাবে তিনি মার্কেট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করা হচ্ছে।
র্যাব কর্মকর্তারা বলেন, বুধবার মধ্যরাতে ময়নুল হক মঞ্জু ও রেজাউলের ১৫-১৬ জন চাঁদাবাজ ওই মার্কেটে গিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছে চাঁদা দাবি করে। সাদা পোশাকে র্যাব সদস্যরা মার্কেটে অবস্থান করছেন, এমন তথ্য ব্যবসায়ীদের জানা থাকায় তাঁরা চাঁদা দিতে অস্বীকার করেন। এতে কয়েকজন ব্যবসায়ীকে মারধর ও দোকান ভাঙচুর করা হয়। এ সময় ছদ্মবেশে থাকা র্যাব সদস্যরা সেখানে গেলে হামলা চালায় চাঁদাবাজেরা। তখন র্যাব ছয় চাঁদাবাজকে ধরে ফেলে। পরে মার্কেট মালিক সমিতির কার্যালয় থেকে রেজাউলসহ পাঁচজনকে আটক করা হয়। তাদের কাছ থেকে চাঁদার এক লাখ ৬০ হাজার ৬৯৫ টাকা উদ্ধার করা হয়।
পরে বৃহস্পতিবার র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত আটজনকে তিন মাস ও দুজনকে দেড় মাস করে কারাদণ্ড দেন। দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন: সরকারি কবি নজরুল কলেজের ছাত্রলীগের সহসভাপতি জহিরুল ইসলাম, ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও একই কলেজের ছাত্র সানাউল করিম। তিনি যুবলীগের নেতা রেজাউল করিমের ভাই। এ ছাড়া যুবলীগের তিন কর্মী আলী হোসেন ওরফে মন্টু, সাদাফ শাহরিয়ার হাসান ও ফারুক হোসেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের পাঁচ কর্মী কামাল উদ্দিন, এনায়েত হোসেন, আহসানউল্লাহ, আবদুল হক ও মো. আরিফ। এই আরিফ ওয়ার্ড কাউন্সিলর ময়নুল হকের শ্যালক।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট সরওয়ার আলম বলেন, ব্যবসায়ীরা চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে মামলা করতে কিংবা সাক্ষ্য দিতে রাজি হচ্ছিলেন না। এ কারণে সরকারি কাজে বাধা ও দোকান ভাঙচুরের অভিযোগে ১০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন