রাষ্ট্র চিন্তক ফরহাদ মাজহার |
বাংলাদেশ বার্তা: ২৫ জুলাই ২০১৫ইং, নির্বাচনই গণতন্ত্র- এ ধরনের একটি ধারণার প্রকট প্রাবল্য বাংলাদেশে দীর্ঘকাল ধরে আমরা দেখেছি। তবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে তামাশা জনগণ দেখেছে, সে কারণে নির্বাচন ও গণতন্ত্রের সম্পর্ক নিয়ে কিছু কিছু ভাবনা শুরু হয়েছে বটে; কিন্তু আমার অনুমান সেটা খুবই ক্ষীণ। সাধারণ মানুষের মধ্যে রাষ্ট্রক্ষমতার ন্যায্যতা কিংবা রাষ্ট্রের ধরন নিয়ে পর্যালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি না থাকাটা অন্যায় কিছু নয়। তারপরও জনগণ তাদের মতো করে রাষ্ট্রকে বোঝার এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের চেষ্টা করে। নির্বাচন তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, এই একটিমাত্র ক্ষেত্রে তারা রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত জানানোর সুযোগটুকু পায়। একটি গণবিরোধী ও অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যেখানে সাধারণ মানুষকে সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতিসহ জীবনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র থেকে নির্বাসিত করেছে এবং ক্ষমতা অল্পকিছু ব্যক্তি ও পরিবারের হাতে কুক্ষিগত করেছে, সেই পরিস্থিতিতে ভোট দিতে পারার অধিকার অনেক বড় হয়ে জনগণের সামনে হাজির হয়। ফলে নির্বাচন গণতন্ত্র নয় ঠিক; কিন্তু গণবিরোধী ও কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘাড়ের ওপর ভূতের মতো রাষ্ট্রের চেপে বসে থাকার মধ্যে ভোট দিতে পারা একদম নিঃশ্বাস নেয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ।এতটুকু যদি বুঝে থাকি তাহলে সাম্প্রতিককালে আন্দোলন করে ক্ষমতাসীনদের উৎখাত করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল দুর্বল বা ক্ষীয়মান হয়ে গিয়েছে বা অচিরেই হবে বলে আমি মনে করি না। কিছু কিছু দৈনিকে এ ধরনের বিশ্লেষণ চোখে পড়েছে যার কোনো বাস্তব ভিত্তি নাই। এটা পরিষ্কার, বিএনপি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটানো কিংবা বাংলাদেশকে রাজনৈতিকভাবে বিকাশের অভিমুখ নির্দেশ করার ক্ষেত্রে কোনো অবদান রাখতে অক্ষম। কিংবা শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগের মতো বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে এমন কোনো নেতৃত্বের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবে না, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে গুণগত রূপান্তর ঘটাতে সক্ষম। যদিও এর পূর্ণ সুযোগ এক-এগারোর সময় থেকে ২০১৩ সালের শেষ নাগাদ বাংলাদেশে পুরাপুরি জারি ছিল। বাংলাদেশের জনগণ একটি গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার ও রাষ্ট্রের রূপান্তরের জন্য মানসিকভাবে তৈরি ছিল। কিন্তু বিএনপি পুরনো ভাঙা রেকর্ডের মতো নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি ছাড়া বিদ্যমান ক্ষমতা ও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের নীতি ও কৌশল সম্পর্কে জনগণকে কোনো দিশা দিতে পারেনি। কিন্তু নির্বাচনী দল হিসেবে বিএনপির দুর্বল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। বিএনপি যদি তার দলের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা আওয়ামী লীগের এজেন্টদের বের করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে- এখন সেটা খুবই ভালো সময়। আগামী নির্বাচনে, যদি শেখ হাসিনা দয়াপরবশ হয়ে এমন কোনো অসম্ভব সিদ্ধান্ত আদৌ নিয়ে ফেলেন, তাহলে এই নেতারা অন্তত বিএনপির ভেতরে বসে কোনো অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালাতে সক্ষম হবে না।
আন্দোলনের ব্যর্থতার জন্য বিএনপি বা খালেদা জিয়া যতোটা দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণী, যাদের আমরা ঠাট্টা করে কিংবা আদর করে সুশীল বলে সম্বোধন করতে পছন্দ করি। এরা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির পক্ষাবলম্বনের নামে বাংলাদেশের এক-এগারোর মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা একটি চরম ফ্যাসিস্ট এবং নাগরিক ও মানবিক অধিকারবিরোধী রাজনৈতিক ক্ষমতার পক্ষে নির্লজ্জভাবে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচনপন্থী দল হিসেবে বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন জোট সমাজের বাইরের কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। সমাজের ক্ষমতাসীন শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী সুশীল সমাজের এই রাজনৈতিক মূর্খতা ও অদূরদর্শিতা বাংলাদেশে অনির্বাচিত ও অবৈধ ফ্যাসিস্ট ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করেছে। অর্থাৎ নির্বাচনী রাজনীতি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মর্ম ও কাঠামোগত সমস্যার কোনো সমাধান নয়, এ ব্যাপারে জনমত গড়ে তোলার দায়িত্ব সমাজের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর। কিন্তু তারা দুটি রাজনৈতিক শিবিরে বিভক্ত হয়ে এখন একবার খালেদা জিয়া আরেকবার শেখ হাসিনাকে দোষারোপ করে নিজদের বুদ্ধিজীবিতা ফলিয়ে যাচ্ছে। যা অতিশয় বিরক্তিকর।
এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেও খালেদা জিয়া আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তার রাজনীতির সীমিত পরিসরে গণতন্ত্র ও ফ্যাসিস্ট ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিরসনের চেষ্টা করেছেন। আলবৎ ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু সে কারণে বিএনপি ভেঙে যাবে তার সম্ভাবনা নাই। যদি ভাঙা বলতে বিএনপি থেকে আওয়ামীপন্থীরা বহিষ্কৃত বা নিজেরা বেরিয়ে যায় সেটা ভিন্ন তর্ক। একই কারণে আন্দোলন-সংগ্রামে পূর্বের মূল্যায়ন এখনও সহজ নয়। কারণ বিএনপি ও বিএনপির নেতৃত্ব্াধীন অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও দ্বন্দ্বের স্পষ্ট ছবি আমাদের কাছে নাই। এটা বোঝা যাচ্ছে, একটি শক্তিশালী ধারা বিএনপির মধ্যে কাজ করছে, যারা মনে করে ইসলামপন্থী, বিশেষত জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ বিএনপির ত্যাগ করা উচিত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দল হিসেবে ইসলাম প্রশ্ন বিএনপি কিভাবে নীতিগত ও কৌশলগতভাবে মোকাবেলা করবে তা নিয়ে অবশ্যই তর্ক হতে পারে, কারণ আদর্শগত মর্মের দিক থেকে বাংলাদেশের বর্তমান ও আগামী রাজনীতির নির্ধারক ইসলাম। একে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নাই। মর্মের দিক থেকে এটাই নির্ধারক প্রশ্ন। গণতন্ত্রের দিক থেকে কৌশলগত দিক হচ্ছে, পাশ্চাত্য লিবারেল রাজনীতির কাঠামোর মধ্যে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় আবেগ, সংবেদনা, স্বপ্ন ও সংকল্প বিএনপি তার জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বয়ানের মধ্যে কিভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়। কিন্তু বিএনপিকে জামায়াতে ইসলামী থেকে বিচ্ছিন্ন করা যে একান্তই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান কৌশল, এটা বোঝার জন্য খুব একটা রাজনৈতিক জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না।
নির্বাচনী রাজনীতির দিক থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের মূল জায়গাটা কী? শেখ হাসিনা স্পষ্টই জানেন, সেটা হল তার পক্ষে কোনো জনসমর্থন নাই। তার পাবলিক রেটিং নিুমুখী, একে ঊর্ধ্বমুখী করার কায়দা নাই বললেই চলে। অথচ তিনিই ক্ষমতায় থাকতে চান। তাই তাকে যেভাবেই হোক নিজেকে ক্ষমতায় রেখেই সংকটের সমাধান খুঁজতে হবে। এর কোনো বিকল্প নাই। দুনিয়ায় বলপ্রয়োগ করে গুম, খুন, আইনবহির্ভূতভাবে হত্যা, জেল-জুলুমসহ হেন কোনো অত্যাচার-নির্যাতন নাই, যা করা সম্ভব নয়। কিন্তু আফসোস, যা করা যায় না তা হল বলপ্রয়োগ করে পাবলিক রেটিং বা জনসমর্থন বাড়ানো। এমনকি নিজের পক্ষে গণমাধ্যমগুলোর সরকারিকরণেও ফায়দা নাই বললেই চলে।
দেশের রাজনৈতিক সংকট হিসেবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান বয়ান হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতের উপস্থিতিই বুঝি বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের প্রধান কারণ- এটাকেই প্রচার-প্রপাগান্ডা তৎপরতার প্রধান এজেন্ডা বানিয়েছেন শেখ হাসিনা এবং নিরন্তর তা প্রচার করছেন। যদিও তিনি মুখে বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান সমস্যা জামায়াত, আসলে তিনি বোঝাতে চান ইসলামী বা ইসলামপন্থী রাজনীতি। আওয়ামী লীগের দিক থেকে এটা অবশ্য সঠিক নির্ণয়। তার পক্ষে পাশ্চাত্য পরাশক্তির সমর্থনের মূল জায়গাটা এখানে। তিনিই বাংলাদেশে ইসলামী সন্ত্রাস দমনের প্রধান শক্তি ও সেনাপতি। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশল হচ্ছে, জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনীতিকে দমন করা। বিএনপি কেন জামায়াতের সঙ্গে জোট বেঁধেছে, একেই তিনি বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান সমস্যায় পরিণত করেছেন। কিন্তু এ কাজ করতে গিয়ে তিনি গণসমর্থনের ভিত্তি হারিয়েছেন। নির্বাচনী রাজনীতির পরিমণ্ডলে শেখ হাসিনার ইসলামপন্থী রাজনীতির বিরোধিতা তার সমর্থনের পরিসর বাড়াচ্ছে না, বরং সংকুচিত করে এনেছে। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচন দেয়ার অর্থ হচ্ছে তার হেরে যাওয়া। যে কারণে পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়েই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি নির্বাচন দেবেন না। যদি আদৌ দেন সেটা তার অধীনেই হতে হবে যাতে তিনি নির্বাচিত হয়ে আসেন।
এটা যদি আমরা বুঝে থাকি তাহলে বিএনপির রাজনৈতিক দুর্দশার জন্য জামায়াতই দায়ী- বিএনপির মধ্যে যারা এই ধারা বহন করেন তারা আসলে আওয়ামী রাজনীতিই করছেন। খালেদা জিয়াকে নেতা না মেনে তারা শেখ হাসিনাকে নেতা মানতেই পারেন। সেক্ষেত্রে তাদের উচিত আওয়ামী লীগে যোগদান করা এবং জামায়াতসহ বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনীতির বিরোধিতা করা। সেটাই হবে সৎ রাজনীতি।
কাগজে দেখেছি, খালেদা জিয়া তার দলের কিছু কিছু নেতাকে আওয়ামী লীগ করার উপদেশ দিয়েছেন। এটা ভালো পরামর্শ। বিএনপির ঘাড়ের ওপর এই নেতাদের বসে থাকার কোনো যুক্তি আসলেই নাই। ফলে বাংলাদেশের রাজনীতির মেরুকরণ স্বাভাবিক যেভাবে হওয়ার কথা সেভাবে ত্বরান্বিত হলে তা বিএনপির নির্বাচনী রাজনীতির জন্য খুবই ভালো হবে।
একটি দৈনিক পত্রিকায় দেখেছি, সিরিজ লেখার মধ্য দিয়ে বিএনপির ময়নাতদন্ত চলছে। দেখে খুব কৌতুক বোধ করেছি। কেউ মারা গেলে বা খুন হলে ময়নাতদন্ত হয়। ধরে নেয়া হয়েছে, বিএনপিকে কেউ হত্যা করেছে এবং হত্যার ক্লু বের করার জন্য ময়নাতদন্ত চলছে। বিএনপির রাজনীতির দিক থেকে গত এক দশকের জাতীয় রাজনীতির একটা মূল্যায়ন হতেই পারে। কিন্তু বিএনপি এখনই নিহত, আর গণমাধ্যম তার ময়নাতদন্ত করছে দেখে খুবই আমোদ লাভ করেছি।
শেখ হাসিনা সত্বর কোনো নির্বাচন দেবেন, এটা মনে হয় না। তিনি দমন-পীড়নের পথেই থাকবেন এবং কোনো না কোনো মামলায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে শাস্তি দিয়ে তাদের নির্বাচনের অযোগ্য করবেন, তারপর একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন দেবেন- এটাই গুজব আকারে আমরা শুনছি। এটা কতটা সম্ভব বলা মুশকিল।
বাংলাদেশে রাজনীতি ও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রশ্ন এখনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, নাগরিক ও মানবিক অধিকার, বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা ও নাগরিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের দায় ও কর্তব্যের উপলব্ধি এবং সর্বোপরি জনগণের সাংগঠনিক ক্ষমতা, অর্থাৎ গণক্ষমতা অর্জনের ওপর নির্ভর করছে। কিন্তু এ পর্যায়ে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই-সংগ্রাম, অর্থাৎ গণতন্ত্র নির্ভর করছে রাষ্ট্র কায়েমের নীতি ও কৌশল সম্পর্কে জনগণকে অবহিত ও সচেতন করার ওপর। এই কাজ বাংলাদেশে ধীরগতিতে ঘটছে, সেটা খালেদা জিয়া কিংবা শেখ হাসিনার দোষ না।
আমাদের উচিত আয়নায় নিজেদের মুখ দেখা। সেখানে বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবিতার অপ্রাপ্তবয়স্ক সুরত আমাদের আরও দীর্ঘদিন আমোদিত রাখতে পারবে। ইনশাল্লাহ।
২৪ জুলাই ২০১৫। ৯ শ্রাবণ ১৪২২।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন