নিম্ন আয়ের দেশ বাংলাদেশ। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় পিছিয়ে আছে এ দেশটি। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বড় বাধা দুর্নীতি। সরকারের উন্মুক্ততার দিক থেকে অনেকটা অগ্রগতি হয়েছে। তবে এখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত। বিশেষ করে মিডিয়ার ক্ষেত্রে তা তলানিতে। এক্ষেত্রে সুশীল সমাজ ও রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাধীনতাও সামান্য।
আইন লঙ্ঘনের দায়ে পুলিশকে শাস্তি দেয়ার ঘটনা বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে কম। এসব কথা বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা দ্য ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের (ডব্লিউজেপি) এক প্রতিবেদনে। এ বছর বিশ্বের মোট ১০২টি দেশের ওপর তারা সমপ্রতি এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনের নাম দেয়া হয়েছে ‘ডব্লিউজেপি রুল অব ল ইনডেক্স ২০১৫’। এ তালিকায় বাংলাদেশ রয়েছে নিচের দিকে ৯৩ নম্বরে অবস্থানে। গত এক বছরে আইনের শাসনের সূচকগুলোর কি পরিবর্তন হয়েছে তা তুলে ধরা হয়েছে এতে। প্রতিবেদনে কার্যকর আইনের শাসনের সুফল সম্পর্কে বলা হয়েছে, কার্যকর আইনের শাসন দুর্নীতি কমায়, দারিদ্র্য ও রোগব্যাধি লাঘব করে এবং জনগণকে অবিচার থেকে সুরক্ষা দেয়। নয়টি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে এই তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। সেগুলো হলো- সরকারি ক্ষমতার সংযত প্রয়োগ, দুর্নীতির অনুপস্থিতি, উন্মুক্ত সরকার, মৌলিক অধিকার, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা, প্রয়োগকারী সংস্থা, দেওয়ানি বিচার, ফৌজদারি বিচার ও অনানুষ্ঠানিক বিচার। সরকারি ক্ষমতার সংযত প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিশ্বে ১০২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তে। দুর্নীতির অনুপস্থিতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রয়েছে ৯৮ নম্বর অবস্থানে। উন্মুক্ত সরকারের ক্ষেত্রে ৭৩ নম্বরে। মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে ৮৮ নম্বরে। আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৬ নম্বরে। প্রয়োগকারী সংস্থার দিক দিয়ে বাংলাদেশ রয়েছে ৯৬ নম্বরে। দেওয়ানি বিচারে ৯৩তম ও ফৌজদারি বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৮তে। বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এখানে মিডিয়ার মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে শতকরা মাত্র ২৮ ভাগ। রাজনৈতিক দলগুলোর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে শতকরা ৩১ ভাগ। সুশীল সমাজের সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা আছে শতকরা ৩১ ভাগ। জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে শতকরা ৪০ ভাগ। বাংলাদেশের মানুষ সমস্যার সমাধানের জন্য ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার দ্বারস্থ হবে কি না এ সম্পর্কে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখানে দুর্নীতি বেশ প্রবল। সেখানে কি প্রতিকার মিলবে সে বিষয়ে সচেতনতার অভাব আছে। প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের বিরুদ্ধে রয়েছে পক্ষপাতিত্বের জোরালো অভিযোগ। তবে এক্ষেত্রে কোর্ট ফি খুব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নয়। ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় বাংলাদেশের মানুষ যেসব সমস্যা মোকাবিলা করছে সে সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এখানে বিচারের আগে দীর্ঘ সময় আটকে রাখা হয়। মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে। মানবসম্পদের ঘাতটি রয়েছে। বিবাদির আইনি সহায়তা পর্যাপ্ত নয়। রয়েছে দুর্নীতি। ওই রিপোর্টে পুলিশের জবাবদিহিতার প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, পুলিশ কর্মকর্তারাও যে আইনের সেবা করেন তার বাইরে নন। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাবিদদের জিজ্ঞাসা করে তার উত্তরের ভিত্তিতে পুলিশের জবাবদিহিতা সম্পর্কে তথ্য দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন করা হয়েছিল- এক. আইন অনুসারে কি পুলিশ কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে? দুই. সন্দেহজনক ব্যক্তির মৌলিক অধিকারের প্রতি কি পুলিশ সম্মান দেখায়? তিন. আইন লঙ্ঘনের জন্য কি তাদেরকে শাস্তি পেতে হয়েছে? এক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য যে তথ্য মিলেছে তা হতাশাজনক। প্রথম প্রশ্নের জবাবে শতকরা মাত্র ২৫ ভাগ মানুষ বলেছেন তারা মনে করেন পুলিশ আইন অনুযায়ী কাজ করে। শতকরা ২৬ ভাগ মানুষ মনে করেন সন্দেহভাজন ব্যক্তির মৌলিক অধিকারের প্রতি সম্মান দেখায় পুলিশ। তবে পুলিশকে আইন লঙ্ঘনের জন্য শাস্তি পাওয়ার ঘটনা বিরল। শতকরা মাত্র ১৮ ভাগ মানুষ এক্ষেত্রে ইতিবাচক জবাব দিয়েছে। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী শুধু বাংলাদেশই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো আইনের শাসনে পিছিয়ে আছে। এ ক্ষেত্রে নেপালের অবস্থান ৪৮তম। এরপর রয়েছে শ্রীলঙ্কা (৫৮), ভারত (৫৯), বাংলাদেশ (৯৩), পাকিস্তান (৯৮) ও আফগানিস্তান (১০১)। ওই সূচক অনুযায়ী, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও অবকাঠামো উন্নয়নে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের যে সাতটি অঞ্চলের ১০২টি দেশে ডব্লিউজেপি সমীক্ষা চালিয়েছে, তার মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) এবং উত্তর আমেরিকার বেশির ভাগ দেশ আইনের শাসন সূচকে এগিয়ে আছে। প্রথম থেকে চতুর্থ অবস্থানে আছে চারটি দেশ- ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন ও ফিনল্যান্ড। এই সূচকে যুক্তরাজ্য ১২তম, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ১৯। সবশেষ ১০২তম অবস্থানে আছে ভেনিজুয়েলা।
সূচক নির্ণয় পদ্ধতি: ডব্লিউজেপি বলছে- এ সমীক্ষায় ১০২টি দেশের এক লাখেরও বেশি মানুষের নিত্যদিনের জীবনের অভিজ্ঞতা ও সংশ্লিষ্ট দেশের বিশেষজ্ঞদের মতামত নেয়া হয়েছে। গবেষণা সংস্থাটি বলছে, প্রতিটি দেশের তিনটি বড় শহরের কমপক্ষে এক হাজার ব্যক্তির কাছ থেকে প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে এসব বিষয়ে মতামত নেয়া হয়েছে। এরপর সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে গড়ে ৩০০ বিশেষজ্ঞ নির্বাচন করে বিশেষজ্ঞ প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে তাদের মতামত নেয়া হয়। প্রতিটি দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি জরিপ সংস্থাকে দিয়ে স্থানীয় পর্যায়ের জরিপ চালানো হয়েছে। সূচক নির্ণয়ের পরবর্তী পর্যায়ে ইকোনমেট্রিক্স অ্যান্ড অ্যাপলায়েড স্ট্যাটেসটিকস ইউনিট অব দ্য ইউরোপিয়ান কমিশনস জয়েন্ট রিসার্চ সেন্টারের সঙ্গে যৌথভাবে স্পর্শকাতরতা বিশ্লেষণ করেছে ডব্লিউজেপি। এরপর আগের বছরগুলোর সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণ ও আরেক দফা যাচাইয়ের পর এসব তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মানুষরা পুলিশ বাহিনীর ৬৩ শতাংশকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে মনে করে। এরপরই রয়েছেন আইনপ্রণেতারা। এসব দেশের মানুষ ৫৭ ভাগ সংসদ সদস্যকে দুর্নীতিবাজ বলে মনে করেন। দুর্নীতিগ্রস্তদের মধ্যে এরপর রয়েছেন স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ অঞ্চলের মানুষ সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে বিচার বিভাগের কথা বলেছেন। গবেষণা প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলাদা করে কিছু বলার নেই। মানব জমিনের সৌজন্যে
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন