অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও অবকাঠামো উন্নয়নে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পিছিয়ে আছে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায়। আইনের শাসনের উপস্থিতি বিবেচনায় বিশ্বের ১০২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৩তম।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের (ডব্লিউজেপি) চলতি বছরের প্রতিবেদনে বাংলাদেশে আইনের শাসন পরিস্থিতির এই চিত্র উঠে এসেছে।
২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থাটি পাঁচ বছর ধরে বিশ্বে আইনের শাসন সূচক (রুল অব ল ইনডেক্স) পরিমাপ করছে।
গত ৯ জুন সংস্থাটি তাদের চলতি বছরের প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
বিশ্বের যে সাতটি অঞ্চলের ১০২টি দেশে ডব্লিউজেপি এই সমীক্ষা চালিয়েছে, তার মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) এবং উত্তর আমেরিকার বেশির ভাগ দেশ আইনের শাসন সূচকে এগিয়ে আছে। প্রথম থেকে চতুর্থ অবস্থানে আছে চারটি স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ: ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন ও ফিনল্যান্ড। এই সূচকে যুক্তরাজ্য ১২তম, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ১৯। সবশেষ ১০২তম অবস্থানে আছে ভেনেজুয়েলা।
এ সমীক্ষা অনুসারে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো আইনের শাসনে পিছিয়ে আছে। এ সূচকে নেপালের অবস্থান ৪৮তম। এরপর রয়েছে শ্রীলঙ্কা (৫৮), ভারত (৫৯), বাংলাদেশ (৯৩), পাকিস্তান (৯৮) ও আফগানিস্তান (১০১)।
সমীক্ষার ফলাফল বলছে, সরকারের উন্মুক্ততার দিক থেকে অনেকটা এগিয়েছে বাংলাদেশ। তবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি। দুর্নীতির দিক থেকে ১০২টি দেশের মধ্যে ৯৮তম বাংলাদেশ। দেশে আইনের শাসনের পথে এর পরের বড় বাধা নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো এবং দেওয়ানি বিচারব্যবস্থা।
বৈশ্বিক ফলাফলে দেখা যায়, উন্নত ও উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে আইনের শাসন পরিস্থিতি বেশি ভালো। তুলনামূলকভাবে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত এবং মধ্যম ও নিম্ন আয়ের দেশগুলো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় পিছিয়ে আছে।
আইনের শাসনের মানদ-: আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিভিন্ন মানদ-ের মধ্য থেকে চারটি বিষয়কে মূলনীতি ধরে এ সমীক্ষা চালিয়েছে ডব্লিউজেপি। এ চারটি বিষয় হলো: ১. সরকারি প্রতিষ্ঠান ও কর্মকর্তা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকেরা আইনের অধীনে জবাবদিহি করে কি না; ২. আইনগুলো স্পষ্ট, বহুল প্রচারিত, স্থিতিশীল, ন্যায়সংগত ও সমানভাবে প্রয়োগ করা হয় কি না এবং এসব আইন ব্যক্তিগত, সম্পত্তির নিরাপত্তাসহ মৌলিক অধিকার রক্ষা করে কি না; ৩. আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া ও প্রয়োগের পদ্ধতি সুষ্ঠু ও কার্যকর কি না; ৪. সমাজের সমর্থনপুষ্ট যোগ্য, নীতিমান ও স্বাধীন প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সময়মতো ন্যায়বিচার পাওয়া যায় কি না।
সূচক নির্ণয়পদ্ধতি: ডব্লিউজেপি বলছে, এ সমীক্ষায় ১০২টি দেশের এক লাখেরও বেশি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা ও সংশ্লিষ্ট দেশের বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া হয়েছে। আইনের শাসন সূচক তৈরির জন্য তাঁদের কাছ থেকে নয়টি বিষয়ে মতামত নেওয়া হয়। এগুলো হলো: ১. সরকারি ক্ষমতার সংযত প্রয়োগ ২. দুর্নীতির অনুপস্থিতি ৩. উন্মুক্ত সরকার ৪. মৌলিক অধিকার ৫. শৃঙ্খলা ও নিরাপত্ত া ৬. প্রয়োগকারী সংস্থা ৭. দেওয়ানি বিচার ৮. ফৌজদারি বিচার ৯. অনানুষ্ঠানিক বিচার।
গবেষণা সংস্থাটি বলছে, প্রতিটি দেশের তিনটি বড় শহরের কমপক্ষে এক হাজার ব্যক্তির কাছ থেকে প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে এসব বিষয়ে মতামত নেওয়া হয়েছে। এরপর সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে গড়ে ৩০০ বিশেষজ্ঞ নির্বাচন করে বিশেষজ্ঞ প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে তাঁদের মতামত নেওয়া হয়। প্রত্যেক দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি জরিপ সংস্থাকে দিয়ে স্থানীয় পর্যায়ের জরিপ চালানো হয়েছে।
সূচক নির্ণয়ের পরবর্তী পর্যায়ে ইকোনমেট্রিক্স অ্যান্ড অ্যাপলায়েড স্ট্যাটেসটিকস ইউনিট অব দ্য ইউরোপিয়ান কমিশনস জয়েন্ট রিসার্চ সেন্টারের সঙ্গে যৌথভাবে স্পর্শকাতরতা বিশ্লেষণ করেছে ডব্লিউজেপি। এরপর আগের বছরগুলোর সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণ ও আরেক দফা যাচাইয়ের পর এসব তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা: ডব্লিউজেপির গবেষণা ফল বলছে, বাংলাদেশে সরকারের নীতির বিরুদ্ধে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের ক্ষমতা গণমাধ্যমের সবচেয়ে কম।
মত প্রকাশের স্বাধীনতার মতো মৌলিক অধিকার একটি দেশে কতটা কার্যকর, তা এ সমীক্ষায় জানতে চাওয়া হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ সমীক্ষার ফল বলছে, ৪০ শতাংশ মানুষ মনে করে, দেশের মানুষ সরকারের নীতি ও পরিকল্পনার বিষয়ে ভয়ভীতি ছাড়া দ্বিমত পোষণ করতে পারে। ৩১ শতাংশ মনে করে, নাগরিক সমাজের সংগঠন এবং রাজনৈতিক দলগুলো স্বাধীনভাবে সরকারি নীতির বিরোধিতা করতে পারে। মাত্র ২৮ শতাংশ মানুষ মনে করে, গণমাধ্যমগুলো নির্ভয়ে সরকারের বিরোধিতা করতে পারে।
পুলিশে আস্থাহীন মানুষ: আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে কাজ করলেও পুলিশ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এ জন্য পুলিশ কতখানি আইনের অধীনে আছে, তা জানতে চেষ্টা করেছে ডব্লিউজেপি। দেখা গেছে, বাংলাদেশের মাত্র ২৫ শতাংশ মানুষ মনে করে পুলিশ আইন মেনে কাজ করে। ২৬ শতাংশ মনে করে, সন্দেহভাজন আসামিদের মৌলিক অধিকার পুলিশ রক্ষা করে। আর মাত্র ১৮ শতাংশের ধারণা হলো, আইন ভঙ্গ করলে পুলিশ শাস্তি পায়।
এ ক্ষেত্রে বিশ্বের উদাহরণ হতে পারে নিউজিল্যান্ড। সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশটির শতভাগ মানুষ মনে করে তাদের পুলিশ আইন মেনে কাজ করে এবং আসামিদের মৌলিক অধিকার রক্ষা করে। আর ৯৯ শতাংশ মনে করে, আইন ভাঙলে তাদের পুলিশ সাজা পায়।
দুর্নীতি: দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মানুষেরা পুলিশ বাহিনীর ৬৩ শতাংশকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে মনে করে। এরপরেই রয়েছেন আইনপ্রণেতারা। এসব দেশের মানুষ ৫৭ ভাগ সংসদ সদস্যকে দুর্নীতিবাজ বলে মনে করে। দুর্নীতিগ্রস্তদের মধ্যে এরপর রয়েছেন স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ অঞ্চলের মানুষ সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে বিচার বিভাগের কথা বলেছেন। গবেষণা প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলাদা করে কিছু বলার নেই।
তবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ২০১৩ সালের গ্লোবাল করাপশন ব্যারোমিটার বলছে, বাংলাদেশের ৬৪ শতাংশ মানুষ পুলিশ বাহিনীকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে মনে করে। আর ২০১২ সালে সেবা খাতে দুর্নীতি নিয়ে টিআইবির করা জাতীয় খানা জরিপে বলা হয়েছে, দেশের ৭৫ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সেবা নিতে গিয়ে কোনো না-কোনোভাবে দুর্নীতির শিকার হয়েছে।
দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিচার: সমীক্ষার ফলাফল বলছে, বাংলাদেশে দেওয়ানি বিচারব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় সমস্যা মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘ সময় এবং এর ঝামেলাপূর্ণ প্রক্রিয়া। এরপরে রয়েছে আইনজীবীর খরচ। তেমনি ফৌজদারি বিচারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো তদন্তের পর্যায়ে দুর্নীতি। পাশাপাশি সাক্ষীদের অপর্যাপ্ত নিরাপত্তা, অদক্ষ তদন্ত, সরকারি কৌঁসুলিদের দুর্নীতি ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারা ইত্যাদির জন্য ফৌজদারি বিচারপ্রার্থীকে সমস্যায় পড়তে হয়।
দুর্নীতি নিয়ে টিআইবির ২০১২ সালে করা খানা জরিপের ফলাফলে বলা হয়েছে, ৫৭ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ দেশে বিচারিক সেবা পেতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছে। ৬৮ শতাংশ মানুষ বিচারিক সেবা পেতে ঘুষ দেয়, যার মধ্যে ৪০.১ শতাংশ দেয় দ্রুত শুনানি করানোর জন্য।
ডব্লিউজেপির সমীক্ষার ফলাফলে বলা হয়েছে, ফৌজদারি বিচারের ক্ষেত্রেও মামলা নিষ্পত্তিতে দেরি মানুষের জন্য অন্যতম সমস্যা। এ ছাড়া বিচারের আগে দীর্ঘদিন কারাগারে আটকে থাকা, অপর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা প্রভৃতি ফৌজদারি বিচারব্যবস্থাকে পিছিয়ে দিয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন