বাংলাদেশ বার্তাঃ জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের আগুনে পোড়া খাঁটি সোনা। দেশপ্রেমিক এবং জাতীয় অগ্রগতির অগ্রপথিক। ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার বিপ্লবের ফলে তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে উপনীত হন, অনেকটা তার অজান্তেই। অজান্তে বলছি এ জন্য যে, ৩ নভেম্বর যখন খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে, এর প্রাথমিক পর্বেই সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে চিফ অব আর্মি স্টাফের পদ থেকে বরখাস্ত করে তাকে গৃহবন্দী করা হয়। ৭ নভেম্বরের বিপ্লবের মাত্র চার দিনের মাথায় তিনি শুধু মুক্ত হলেন তা-ই নয়, ছাত্র-জনতা-সৈনিকের কাছে তিনি আবির্ভূত হলেন একজন ত্রাতারূপে, তাদের আশা-আকাক্সক্ষার মূর্ত প্রতীকরূপে, অনেকটা শেষ ভরসার মতোই। কিন্তু কীভাবে? এ জন্যই ৭ নভেম্বরের বিপ্লব সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত হতে হলে এর পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কে সজ্ঞাত হওয়া প্রয়োজন।
৭ নভেম্বরের বিপ্লবে মেজর জেনারেল জিয়া ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন কোনো যড়যন্ত্রের মাধ্যমে নয়। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে তিনি নিহত হতে পারতেন। কোনো পূর্বপরিকল্পনার মাধ্যমে তিনি ক্ষমতায় আসেননি। তিনি ক্ষমতাসীন হলেন বিপ্লবের সদর দরজা দিয়েই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের একাংশের ষড়যন্ত্রে সংঘটিত সামরিক অভ্যুত্থান এবং ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের ফলে সৃষ্ট ক্ষমতাশূন্যতার জন্য, ক্ষমতার শূন্যস্থান পূরণ করতে তাকে ক্ষমতাসীন হতে হয় শুধু জাতীয় স্বার্থে, জাতীয় ঐক্য সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে।
জাতীয় ঐক্যের কথা বলছি এ কারণে যে, ওই সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনা করুন, দেখবেন দেশের প্রশাসন অনেকটা স্থবির, প্রাণহীন। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা ছিলেন বিভক্ত, উদ্যোগবিহীন। দেশে তখন কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব ছিল না। মুসলিম লীগের মতো দক্ষিণপন্থী দলগুলো নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রহরে। বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠনের সময় দেশের সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই। বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদ ১৫ আগস্ট ক্ষমতাসীন হয়ে বাকশালকে বেআইনি ঘোষণা করেন। অন্য কথায়, ৭ নভেম্বর দেশে কোনো রাজনৈতিক সংগঠন ছিল না। জাতীয় জীবনের সঙ্কটকালে যে সামরিক বাহিনী স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক রূপে জাতীয় ঐক্য সমুন্নত রাখতে সচেষ্ট থাকে, বাংলাদেশে তখন তা-ও ছিল ত্রিভঙ্গ মুরারি। এমনই সময়ে ৭ নভেম্বরের বিপ্লবের মাধ্যমে জেনারেল জিয়াউর রহমান জাতীয় স্বার্থে কাণ্ডারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ৭ নভেম্বরের বিপ্লবের সাথে আরো দু’জন কৃতী মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকা সংশ্লিষ্ট। তাদের একজন আবু তাহের, অন্যজন খালেদ মোশাররফ। আবু তাহেরের সাথে জিয়াউর রহমানের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। দু’জনই দেশের কৃতী সন্তান।
একজন জাতীয়তাবাদী, অন্যজন আন্তর্র্জাতিক সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। জাতীয়তাবাদের পরশমণির স্পর্শে একজন চেয়েছিলেন বাংলাদেশকে বিশ্বসভায় গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে। জনগণের মাধ্যমে সামাজিক শক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে গণমুখী ও সচেতন করে জাতীয় মহাশক্তির উদ্বোধন করতে। অন্যজন চেয়েছিলেন সামরিক বাহিনীকে সোভিয়েত মডেলে শ্রেণিযুদ্ধের শাণিত অস্ত্ররূপে ব্যবহার করে বাংলাদেশে শ্রেণীহীন সমাজ গঠন করতে। উদারনৈতিক গণতন্ত্রের প্রতি একজনের বিশ্বাস ছিল অত্যন্ত দৃঢ় ও মজবুত। অন্যজন কিন্তু উদারনৈতিক গণতন্ত্রকে বুর্জোয়া গণতন্ত্র হিসেবে অর্থহীন মনে করে বিশ্বাস করতেন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশে। একজনের গতি তাই নির্ধারিত হয়েছে বহুদলীয় গণতন্ত্রে ও তার আনুষঙ্গিক ক্রিয়াকলাপের দিকে। অন্যজনের দৃষ্টি ছিল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের দিকে।
প্রতিরক্ষা বাহিনী সম্পর্কে জিয়াউর রহমান ও আবু তাহেরের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। জিয়াউর রহমানের কাছে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণ এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তার অতন্দ্র প্রহরী হিসেবেই রাজনৈতিক সমাজে প্রতিরক্ষা বাহিনী অর্থপূর্ণ। আবু তাহের কিন্তু প্রতিরক্ষা বাহিনীকে দেখেছেন সামাজিক শক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুসংহত করার মাধ্যম হিসেবে। তাই প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন, বিশেষ করে সৈনিকদের মধ্যে পেশাদারী বৃদ্ধির মাধ্যমে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী জিয়াউর রহমান চেয়েছিলেন প্রতিরক্ষা বাহিনীকে আধুনিকতার আলোয় সমুজ্জ্বল করতে। মার্ক্সীয় দর্শনের অনুসারী আবু তাহেরের কাছে মূল্যবান মন্ত্র ছিল, ‘পুরনো সামরিক বাহিনীকে টুকরো টুকরো করে গুঁড়িয়ে দাও। তারপর আবার তাকে গড়ে তোলো’ [Smash the old army, dissolve it and then build a new]|। উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গির এ পার্থক্য অনুধাবন না করে এ দুই কৃতী মুক্তিযোদ্ধার কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে তাদের প্রতি ভয়ঙ্কর অবিচার করা হবে।
৩ নভেম্বরে সামরিক অভ্যুত্থানে যার সূচনা, ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার বিপ্লবে তার পরিণতি। ৩ নভেম্বরের আরেকজন কৃতী মুক্তিযোদ্ধা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ঢাকা ব্রিগেডের কমান্ডার শাফায়াত জামিলের সহযোগিতায় বঙ্গভবন ব্যতীত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নিজেকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করেন এবং সামরিক বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দান করেন। তিনি মন্ত্রিসভা ও জাতীয় সংসদ বাতিল করেছেন। মেজর হাফিজের মধ্যস্থতায় তিনি বঙ্গভবনে অবস্থান গ্রহণকারী ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। দু’টি শর্তে তিনি তাদের সাথে বোঝাপড়া করেছিলেন। এক. বাংলাদেশ বিমানের ফকার ফ্রেন্ডশিপ বিমানে তাদের দেশের বাইরে নিরাপদে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। দুই. এর পরিবর্তে তারা খালেদের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করবেন। এভাবে তিনি অত্যন্ত সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন বটে। কিন্তু সে নিয়ন্ত্রণ ৯০ ঘণ্টার বেশি স্থায়ী হয়নি। ৭ নভেম্বর তিনি এবং তার সঙ্গী-সাথীরা সিপাহিদের দ্বারা পরাস্ত এবং অবশেষে নিহত হন।
খালেদ মোশাররফ কেন সেই অভ্যুত্থান ঘটাল সে সম্পর্কে ভিন্নমত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের ভাবমূর্তি অক্ষুণœ রাখতে এবং তার রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের জন্যই এ অভ্যুত্থান। কেউ বা বলেন, খালেদ মোশাররফ ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে বিধ্বস্ত সামরিক বাহিনীর ‘চেইন অব কমান্ড’ ফিরিয়ে আনতে এ অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন। কেউ কেউ আবার বলেন, খালেদের সহযোগিতায় এবং ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ (জঅড)-এর উদ্যোগেই এ অভ্যুত্থান ঘটেছিল। এসবের কোনোটিই যে বাস্তবতার নিরিখে টেকে না, তা বলাই বাহুল্য। খালেদ মোশাররফ কট্টর মুজিববাদীও ছিলেন না এবং কোনো সময় আওয়ামী লীগ খালেদকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকার করেছে বলেও কোনো প্রমাণ নেই। যদি সত্যিই তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্ব করতেন, তাহলে অভ্যুত্থানের আগে অথবা পরে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সাথে কথা বলতেন, এমনকি যে কয়েক দিন তিনি ক্ষমতায় ছিলেন, তার মধ্যে আওয়ামী নেতাদের সমন্বয়ে একটি মন্ত্রিসভাও গঠন করতেন।
খালেদ মোশাররফের সামরিক অভ্যুত্থানে ভারত খুশি হয়েছিল বটে এবং ভারতের পত্রপত্রিকায় এ ঘটনাকে এক ‘ঐতিহাসিক ঘটনা’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু এ অভ্যুত্থান ঘটানোর ক্ষেত্রে ভারতের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। অন্য দিকে, খালেদ মোশাররফ যে সামরিক বাহিনীতে নির্দেশসূত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য এ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, তা-ও যুক্তির ধোপে টেকে না। কারণ, তিনি নিজেই তার জ্যেষ্ঠতম কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানকে শুধু গৃহবন্দী করেননি, তাকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিলেন যেন তিনি নিজে ওই পদে অধিষ্ঠিত হতে পারেন।
৩ নভেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানকে নিরোধক অভ্যুত্থান (Veto Coup) হিসেবে চিহ্নিত করাই সমীচীন। ১৯৭৩ সালের প্রথম থেকে সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীতে যে অসংখ্য বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গড়ে উঠেছিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সামরিক শাখা গণবাহিনীর উদ্যোগে, সেই প্রক্রিয়াকে বানচাল করাই ছিল এ অভ্যুত্থানের লক্ষ্য। গণবাহিনীর উদ্যোগে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাগুলোর কাজ যেভাবে অগ্রসর হচ্ছিল, বিশেষ করে ৭ নভেম্বরের ১২ দফা সনদে দাবিনামা বিশ্লেষণ করলে মনে হয়, অনেকটা অসময়ে অর্থাৎ সব কিছু পরিণত পর্যায়ে পৌঁছার আগেই এ অভ্যুত্থান ঘটে যায়। খালেদও অনুভব করেছিলেন, এ অবস্থায় গণবাহিনীর পরিকল্পনা নস্যাৎ করা সম্ভব না হলে দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাঠামো ভেঙে পড়বে পুরোপুরি।
এ প্রেক্ষাপটে ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার বিপ্লবকে ব্যাখ্যা করাই সঠিক। গণবাহিনীর প্রধান কর্নেল আবু তাহের জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট অথবা তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে গৃহবন্দিত্ব থেকে তাকে মুক্ত করতে অগ্রসর হননি। তিনি অগ্রসর হয়েছিলেন খালেদ মোশাররফের উদ্যোগকে নস্যাৎ করতে। এ জন্য যেসব স্লোগান অত্যন্ত ফলপ্রসূ হতে পারে তা-ই তারা বেছে নিয়েছিলেন। ‘রুশ-ভারতের দালাল’, ‘ভারতের দালাল’, ‘জয় বাংলা’র বদলে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’- এসব স্লোগান হিসাব-নিকাশ করে বাছাই করা হয়েছিল। ওই সময়ে গণবাহিনীর জন্য জিয়ার প্রয়োজন ছিল অনেক বেশি; বিশেষ করে একজন সেরা মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশাররফের সামরিক অভ্যুত্থানকে অতি সহজে ঘায়েল করার জন্য।
জিয়াউর রহমান কিন্তু এ বিপ্লবের ফলে সরাসরি চলে এলেন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে এবং বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এমনকি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে জিয়ার উপস্থিতি বিপ্লবাত্মক হয়ে ওঠে। এ সময় বাংলাদেশের রাজনীতি এক বৈপ্লবিক মোড় নেয়, যা বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে নিয়ে আসে নতুন এক চিৎশক্তি; যার প্রভাব জাতীয় জীবনের নিঃশ্বাস- প্রশ্বাসে আজো চিরঞ্জীব হয়ে আছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন