বর্তমানে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে থার্টি ফার্স্ট উদযাপিত হয়। পাকিস্তান আমলে, এমনকি স্বাধীনতার অনেক পরেও এ দেশের মানুষ ‘থার্টি ফার্স্ট’ শব্দের সাথেই পরিচিত ছিল না। গত শতকের শেষের দিকে ইংরেজদের অনুকরণে বাংলাদেশে থার্টি ফার্স্ট উদযাপনের প্রচলন শুরু। এটা ব্যাপক প্রচার পায় ২০০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর মধ্য রাতে মিলেনিয়াম বা সহস্রাব্দ পালনের মাধ্যমে। মধ্য রাতের পর বিশ্ব একুশ শতকে প্রবেশ করে। এরপর ‘থার্টি ফার্স্ট’-এর ব্যাপক প্রসার ঘটে।
থার্টি ফার্স্ট পালনের যে রেওয়াজ বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে তা সুস্থ সংস্কৃতি বা বিনোদন নয়। বরং একটি মারাত্মক ভাইরাস। তরুণ ও যুবসমাজের দেশপ্রেম এবং ধর্মীয় চেতনা ধ্বংস করে দেয়ার জন্য এমন একটি ভাইরাসই যথেষ্ট হতে পারে।
হাজার হাজার বছরের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যে ভরপুর আমাদের এই জনপদ। রাতকেন্দ্রিক কোনো সংস্কৃতি এ দেশে গড়ে ওঠেনি। ‘বারো মাস তেরো পার্বণের দেশ’ হওয়া সত্ত্বেও কোনো পার্বণই রাতের সাথে সম্পৃক্ত নয়। এ দেশের মানুষ পরিশ্রমী, কষ্টসহিঞ্চু। শ্রমজীবী মানুষগুলোর সারা দিন পরিশ্রমের পর জারি গান, সারি গান, পুঁথি পাঠের আসরের যে নির্মল বিনোদন তা রাতের কিয়দংশের অনুষ্ঠান। ইসলামের আগমনের পর এ দেশের মানুষ এক নতুন ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়। বাঙালি সংস্কৃতির সাথে ইসলামি সংস্কৃতির সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে সমৃদ্ধ স্থানীয় সংস্কৃৃতি।
কুরআনের সুস্পষ্ট বক্তব্য- ‘আমি তোমাদের ঘুমকে শান্তির বাহন করেছি, রাতকে করেছি আচ্ছাদানকারী ও দিনকে জীবিকা অর্জনের সময় বানিয়ে দিয়েছি।’ (সূরা নাবা)
হাদিস শরিফে এশার আগে ঘুমানো এবং এশার নামাজের পর বৈষয়িক কার্যাবলি সম্পাদনের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কদর রজনী, শবে মেরাজে দীর্ঘ রাত জেগে একাকী নফল এবাদত, বিশেষ করে শেষ রাতে তাহাজ্জুদ অবশ্যই ইসলামে গুরুত্বপূর্ণ এবাদত।
‘থার্টি ফার্স্ট’ ভিন দেশ থেকে আমদানি করা একটি বিকৃত বিজাতীয় সংস্কৃতি। যেসব জাতির কাছে নিজস্ব কোনো ক্যালেন্ডার নেই, তারা দিন গণনার জন্য ইংরেজি নববর্ষকে বরণ করতে পারে; কিন্তু বাংলাভাষী মানুষ ইংরেজি নববর্ষকে এভাবে উন্মাদনায় বরণ করতে পারে না। আমাদের আছে বাংলা বর্ষ এবং ইসলামি বর্ষপঞ্জি বা হিজরি সন। দু’টি সনই বিজ্ঞানসম্মত এবং সমৃদ্ধ। এর পরও ভিন্ন সংস্কৃতির একটি সালকে বরণ করার জন্য বাড়াবাড়ি করা হীনমন্যতা ছাড়া কিছুই নয়।
গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠী, খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষগুলো এখনো ওই সন দু’টি নিজেদের ক্যালেন্ডার হিসেবে ধরে রেখেছেন। এক শ্রেণীর পরজীবী গোষ্ঠী যেভাবে ‘থার্টি ফার্স্ট’ নিয়ে মেতে উঠেছে, আমার আশঙ্কা ১০০ বছর পরে আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে বাংলা সন হারিয়ে যাবে। এ দেশে ‘মগী’ সনের প্রচলন ছিল। ১৮৯৬ সালে উপকূলীয় বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল যাতে বহু মানুষের মৃত্যু হয়। উপকূলবাসীর কাছে সেটি ‘৫৯মগীর তুফান’ নামে পরিচিত ছিল। কারণ সে সময় এখানে ইংরেজি সাল গণনার প্রচলন ছিল না, মানুষ মগী সন গণনার মাধ্যমেই সময়ের হিসাব রাখত। ১০০ বছর পরে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়জন শিক্ষার্থী বলতে পারবেন মগী সন নামক কোনো ক্যালেন্ডারের কথা কখনো শুনেছে কি না। এই জনপদে জনজীবনের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত এই সন যেভাবে হারিয়ে গেছে, বাংলা সনও হারিয়ে যেতে বসেছে।
যেভাবে ‘থার্টি ফার্স্ট’ পালন করা হয়, বিকৃত রুচির বহিঃপ্রকাশ ছাড়া কোনো মতেই এটাকে উৎসব বলা যাবে না। উৎসব সেটাই, যেখানে সব বয়সের সব স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ থাকে, থাকে সুস্থ বিনোদন। ‘থার্টি ফার্স্ট’ নৈতিকতার চরম অধঃপতন এবং অশ্লীলতার প্রদর্শনী।
ঘর থেকে বেরিয়ে লং ড্রাইভে চলে যাওয়া, রাস্তায় যুবক-যুবতীদের ঢলাঢলি, ছাড়াও সাগর তীরে বা নাইট কাবগুলোতে যা হয় সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন অভিভাবক কি তার সন্তানদের সাথে বসে এসব উপভোগ করতে পারবেন?
তরুণ-তরুণীদের চরিত্র নষ্ট করে ফেলা, যুবসমাজকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নীলনকশার একটি অংশ ‘থার্টি ফার্স্ট’।
বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে এ দেশের ও যুবকদের চারিত্রিক দৃঢ়তা দেখাতে হবে, নৈতিকতার বলে বলিয়ান হতে হবে। নৈতিক চরিত্রের জোরেই মুসলমানগণ গোটা বিশ্ব শাসন করেছিলেন। আবার যখনই চরিত্রে ঘুণে ধরেছে, ভিন্ন জাতি তাদের ওপর চেপে বসেছে। চরিত্র ধ্বংস করে দেয়ার জন্য বহুমুখী তৎপরতা চলছে। এই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে সজাগ হতে হবে প্রতিটি অভিভাবককে, সচেতন হতে হবে গোটা জাতিকে। চরিত্র বিধ্বংসী যেকোনো কথিত উৎসব বর্জনে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
আমার এই লেখাটি দৈনিক নয়াদিগন্তে প্রকাশিত হয়নইম কাদের
E-mail : nayeemquaderctg@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন