ইসলামী ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট দক্ষিণগাও বাজার এর পক্ষ থেকে সকল গ্রাহক, শুভাকাংখীসহ স

আচ্ছালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ। ইসলামী ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট দক্ষিণগাও বাজার এর পক্ষ থেকে সকল গ্রাহক, শুভাকাংখীসহ সবাইকে জানাই সালাম শুভেচ্ছা। এইগ্রুপে যারা আছেন তাদের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এলাকার এলাকারসকলকে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে বিদেশ থেকে রেমিটপন্স পাঠানোর আহবান জানাচ্ছি। রাজারবাগ, কুসুমবাগ, দক্ষিনগাও, শাহীবাগ, মানিকদিয়া, বাইকদিয়া, নন্দিপাড়াসহ সকল এলাকার গ্রাহক, শুভাকাংখী, শুভানুধ্যায়ীদের প্রদত্ত মোবাইল নাম্বারে যোগাযোগ করার অনুরোধ করা হলোঃ ০১৭১১-৪৫৮১৫১, ০১৭০০৯২৫২৪১

রবিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৪

দেখা হবে জান্নাতের সিঁড়িতে: সানোয়ার জাহান


ছোটবেলা থেকে সবাই আমাকে পিয়ারি বলে ডাকতো। আমাদের অরজিনাল বাড়ি ছিল মুর্শিদাবাদে। আমার দাদারা জমিদার ছিলেন। আমার আব্বা উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। পাকিস্তান হওয়ার পরে কলকাতার চাকরি ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। ঢাকায় এসে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। এই সরকারি চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জেলায় ঘুরেছেন। তিনি শেষ বয়সে দিনাজপুরে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে অবসর নেন ও স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আমার ভালো নাম সানোয়ার জাহান, আমার পিতার নাম মীর নাতেক আলী ও মাতা নূরজাহান বেগম।

আমি ইডেন মহিলা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের জনসভায় আমি প্রথম সারিতে অবস্থান নিয়েছিলাম। আমি তখন ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী। আমি ২৩ মার্চ রাত্রে ঢাকা ত্যাগ করি ও কুষ্টিয়ার কুমারখালী চলে যাই। তখন আব্বা সেখানকার সার্কেল অফিসার ছিলেন। সেখানকার আওয়ামী লীগ নেতা কিবরিয়া সাহেব (পরবর্তীতে এমপি) সহ অন্যান্য নেতাদের সাথে আমাদের পরিবারের সুসম্পর্ক ছিল। তারা আমাদের বাসায় আসতেন। যুদ্ধ শুরু হলে আমরা কুমারখালী ছেড়ে খোকশা নামক গ্রামের দিকে চলে যাই। মাসখানেক পরে আমরা আবার কুমারখালীতে ফেরত আসি। ওখানে আমরা নানা উপায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করি ও সাহায্য-সহযোগিতা করি। আমার মা মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সরবরাহ করতেন। স্বাধীনতার যুদ্ধে বিজয় অর্জিত হওয়ার পরে মুক্তিযোদ্ধারা বাসায় এসে উল্লাস করে ও মিষ্টি বিতরণ করে। এর কিছুদিন পরে আমরা দিনাজপুরে চলে যাই। এরও কিছু দিন পরে আমি ইডেন মহিলা ছাত্রী ইউনিয়নের জিএস ছিলাম। পরে আমি ছাত্রী ইউনিয়নের নেত্রীদের নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবরের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছি।

১৯৭৬ সালে পারিবারিকভাবে আবদুল কাদের মোল্লার সাথে আমার বিয়ে হয়। তখন আবদুল কাদের মোল্লা একজন মেধাবী ছাত্র ও লেখক হিসাবে সুপরিচিত ছিলেন। আমার আব্বা দৈনিক ইত্তেফাকে পবিত্র শবে মেরাজের উপরে একটা লেখা পড়ে আবদুল কাদের মোল্লাকে পছন্দ করেন। তখন তাঁর নামে কোনো যুদ্ধ অপরাধ তো দূরের কথা, সাধারণ যে কোনো অপরাধের জন্যও কোনো মামলা এমন কি জিডি পর্যন্ত হয়নি। তাঁর যদি কোনো মামলা অথবা কোনো গুজবও থাকতো, তবে আমাদের মতো সম্ভ্রান্ত পরিবার উনার সাথে আমার বিয়ে দিতেন না, আমিও সম্মত হতাম না।

পর্দার ব্যাপারে উনি অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। বিয়ের দিনে সুটকেসের ভিতরে আমার জন্য হাত ও পায়ের মোজা দিয়েছিলেন। আমার এক মামা মোজাগুলো দেখে বলেছিলেন ‘এখনই এত কঠোরতা অবলম্বন করছো বাবা’। উত্তরে উনি বলেছিলেন ‘বিড়াল মারলে প্রথম রাতে মারাই ভালো’।

আমি প্রথম যখন শ্বশুর বাড়িতে গেলাম, সারা গ্রামের লোকজন ভেঙ্গে পড়েছিলো আমাকে দেখার জন্য। কিন্তু উনি আমার পর্দা রক্ষার জন্য কঠোর ছিলেন। এতে আত্মীয়-স্বজনরা মনঃক্ষুণœ হলেও উনি তার পরোয়া করেননি।

আমার স্বামী আবদুল কাদের মোল্লা ১৯৭৭ সালে জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন। এরপর তিনি দৈনিক সংগ্রামে সাংবাদিকতা শুরু করেন। তিনি ১৯৮২/৮৩ সালে পরপর দুইবার ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচিত সহ-সভাপতি ছিলেন। ঐ সময় ইকবাল সোবহান চৌধুরীসহ প্রথিতযশা সাংবাদিকদের সাথে তিনি আড্ডা দিতেন প্রেস ক্লাবে। এই সময় সাংবাদিক ইউয়নিয়ন ও কল্যাণ ফান্ডের টাকা তিনি বিশ্বস্ততার সাথে সংক্ষরণ করেছেন। অসহায়, বেকার, দুঃস্থ, অসুস্থ সাংবাদিকদের কল্যাণে অন্যান্য সাংবাদিক নেতাদের সাথে নিয়ে কাজ করেছেন। তার আমানতদারীতা নিয়ে কেউ কোনোদিন কোন প্রশ্ন করেননি। কারণ তিনি ছিলেন সবার বিশ্বস্ত ও প্রিয় ‘ মোল্লা ভাই’।

তিনি ১৯৮৬ সালে এরশাদের শাসনামলে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রাখার কারণে গ্রেফতার হন। পরে গণ-আন্দোলনের মুখে সরকার তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ১৯৯১ সালে তিনি জামায়াতের ঢাকা মহানগরীর আমীর হন। এরপর ১৯৯৬ সালে তিনি কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ-এর সাথে গ্রেফতার হন। ঐ সময় তিনি আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিম, আব্দুস সামাদ আজাদ, জাতীয় পার্টির নেতা আনোয়ার হোসেন মঞ্জুসহ প্রমুখদের সাথে লিয়াজোঁ কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। কিছুদিন পরেই তিনি জেল থেকে ছাড়া পান। পরে তিনি জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হন। এই সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি কখনোই যুদ্ধ অপরাধী অথবা অন্য কোনো মামলার অপরাধী এই কথা কেউ বলতে পারেনি। খুন-ধর্ষণ, লুটতরাজ ইত্যাদি জঘন্য সব অভিযোগ বা অভিযোগের গুজব কখনোই উনার নামে ছিল না।

আমার স্বামী আবদুল কাদের মোল্লা সব সময় সৎ ছিলেন। হালাল রুজি-রোজগারের ব্যাপারে উনি অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। উনার চাওয়া-পাওয়া অত্যন্ত সীমিত ছিল, অল্পেই তুষ্ট থাকতেন। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে উনার কোনো চাহিদা ছিল না। সারাদিন উনি নানা কাজে ব্যস্ত থাকলেও রাত্রে এসে ছেলে-মেয়েদের খোঁজ-খবর নিতেন।

আমার প্রথম সন্তান হওয়ার পর উনি প্রোগ্রাম করে বাসায় এসে বাচ্চাকে ধরে রাখতেন। এমনকি পায়খানা-প্রস্রাবও করিয়ে দিতেন। বাচ্চাদেরকে ঘাড়ে করে উনি ঘুরে বেড়াতেন।

উনি নিজের কাজ নিজে করতে পছন্দ করতেন। সেলাই করা থেকে শুরু করে কাপড় ধোয়া, উনি নিজে করতে চাইতেন বা করতেন। উনার যত কাজই থাক, কুরআন তিলাওয়াত ও হাদীস না পড়ে সাধারণত ঘুমাতেন না। স্ত্রী হিসাবে তিনি কখনো আমার অমর্যাদা করেননি। ছেলে-মেয়েসহ আমাদের প্রায়ই কুরআন-হাদীসের আলোকে শিক্ষাদান করতেন। সব সময় সত্যের উপর থাকার জন্য তিনি জোর করতেন।

আমার স্বামী যন্ত্রের মতো কাজ করেছেন। বিয়ের পর থেকে আমি দেখেছি উনি নিরলসভাবে সংগঠনের জন্য কাজ করেছেন। যখনই কেউ কোনো মিটিং বা প্রোগ্রামের জন্য ডেকেছে, উনি ছুটে গেছেন। ইসলামী আন্দোলনের প্রয়োজনে যখন যেখানে প্রয়োজন তিনি গিয়েছেন। আমার ছোট ছেলে মওদূদ হওয়ার দিন উনার কিশোরগঞ্জে প্রোগ্রাম ছিলো। উনি আমাকে বললেন যে, আমার তো জরুরি প্রোগ্রাম আছে। আমি চলে গেলে তুমি ম্যানেজ করে নিতে পারবে কিনা, আমি বললাম পারবো। উনি চলে গেলেন কিশোরগঞ্জ। পরেরদিন এসে তিনি মওদূদ এর মুখ দেখলেন।

ব্যবসায়ী, কূটনীতিক, শিক্ষক, সাংবাদিক, সরকারি কর্মকর্তাসহ সব মহলে উনার গ্রহণযোগ্যতা ও অবাধ যাতায়াত ছিলো। উনার বুক ভরা সাহস ছিলো। সত্য কথা বলতে তিনি দ্বিধা করতেন না। তিনি অত্যন্ত রসিক লোক ছিলেন। নানা গল্পে-কৌতুকে রসময় কথায় আসর মাত করে রাখতেন। এই জন্য সকল মহলে উনার ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিলো।

সম্ভব হলে উনি আমাকে ও বাচ্চাদেরকে বেড়াতে নিয়ে যেতেন। উনার বিভিন্ন জেলায় নানা কর্মসূচি থাকতো। উনি সম্ভব হলে আমাকে নিয়ে যেতেন। বাসার কাজের মানুষের ব্যাপারে তিনি সহৃদয় ছিলেন। তাদের সাথে সদ্বব্যবহার করার জন্য বলতেন। আত্মীয়-স্বজন আসলে তাদের আদর-যত্ম করার জন্য বলতেন। তিনি নানা সামাজিক সংস্থার সাথে যুক্ত ছিলেন। মাদরাসা, এতিমখানা, স্কুল, কলেজ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন।

জেলখানায় শেষ দুটি দেখায় উনি আমাকে বলেছেন, আমি ইসলামী আন্দোলন করার কারণে তোমাকে যতটুকু সময় প্রয়োজন ছিল দিতে পারিনি। ছেলে-মেয়েদের সব ইচ্ছে পূরণ করতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করো। আমি উত্তরে বলেছি, প্রশ্নই আসে না ক্ষমা করার। ইসলামী আন্দোলনের জন্য যা করা দরকার তুমি তাই করেছ। আমি বরং সাংসারিক প্রয়োজনে তোমাকে বিরক্ত করেছি। কারণে-অকারণে নানা প্রয়োজনের কথা বলেছি। উত্তরে তিনি বলেন, তোমরা সর্বঅবস্থায় আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখবে ও ধৈর্য ধরবে।

যেদিন উনার ফাঁসি হয় সেদিন সাক্ষাতে উনি আমাকে বলেনÑ বাকি ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিবে। পারিবারিক সকল দায়িত্ব পালন শেষে আল্লাহ যেন তোমাকে দ্রুত আমার কাছে নিয়ে আসেন।

তিনি আরো বলেন তোমরা ব্যক্তিগতভবে কোনো প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করবে না। ইসলামী আন্দোলন এদেশে প্রতিষ্ঠা ও বিজয়ী হওয়ার মাধ্যমে আমার প্রতি যে অন্যায় করা হয়েছে, তার বদলা হবে। একমাত্র ইসলামকে এদেশে জয়ী করেই ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা আমার প্রতি ফোঁটা রক্তের প্রতিশোধ নিবে। এটা সবাইকে বলে দিবা। তিনি আরও বলেনÑ হালাল রোজগারের মাধ্যমে জীবন ধারণ করবা। হালাল রোজগারে কেউ কখনও না খেয়ে মরে না। আর কারও হারাম রোজগারের গাড়ি-বাড়ি দেখে আফসোস করবা না। এটা আল্লাহতায়ার খুবই অপছন্দ। ইনশাআল্লাহ তোমাদের সাথে আমার জান্নতের সিঁড়িতে দেখা হবে।

লেখক : শহীদ আবদুল কাদের মোল্লার স্ত্রী।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন