গাজীপুরে জনসভা ডেকে পিছু হটার ঘটনাকে ভালো চোখে দেখছেন না বিএনপির সমর্থকরা। এ নিয়ে দলের ভিতরে-বাইরে সমালোচনার ঝড় বইছে। বিএনপি নেতা-কর্মীদের একাংশ বলছেন, গতকাল গাজীপুর না যাওয়ার সিদ্ধান্ত রাজনৈতিকভাবে বিএনপিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সরকারের হাতে তাদের সমালোচনা করার অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়েছে। বার বার ভুল সিদ্ধান্তে দলকে চরম মূল্য দিতে হচ্ছে।
আরেক পক্ষ বলছে, দল ও জোটগতভাবেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে ক্ষতির চেয়ে লাভই হয়েছে। তবে জনসভা থেকে পিছু হটায় রাজনৈতিক বিশিষ্টজনেরা বলছেন, এটা বিএনপির রাজনৈতিক 'অদূরদর্শিতা'। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, কয়েকটি কারণে গাজীপুরে জনসভা থেকে পিছু হটেছে বিএনপি। এর মধ্যে একটি হলো গত শুক্রবার রাতে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বেগম খালেদা জিয়ার বৈঠকে এ বিষয়ে একজন প্রভাবশালী সদস্য বেগম জিয়াকে জানান, ৩ ও ৫ জানুয়ারির আগে বড় কোনো ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। এতে ওই দুটি কর্মসূচি ভেস্তে যাবে। আরেক যুক্তি তুলে ধরে বলা হয়- গাজীপুরে বিএনপি সাংগঠনিকভাবেও দুর্বল। ওই জনসভায় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে। অনেকেই গ্রেফতার হয়ে যাবেন।
দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাও গ্রেফতার হতে পারেন। এ ছাড়া আজ চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং আইয়ের সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার বৈঠকের কথা রয়েছে। চীনের প্রভাবশালী মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে বিএনপি। তাই এর আগে কোনো অঘটনে না যাওয়াই ভালো বলেও স্থায়ী কমিটির কোনো কোনো সদস্য মনে করেন। অবশ্য বেশ কয়েকজন সদস্য এসব পরামর্শের বিরোধিতাও করেন। তবে তাদের প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকেনি। স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী এক সদস্যের কথাই গ্রহণ করে জনসভায় না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বেগম জিয়া। একই সঙ্গে গাজীপুরে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল এবং সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তবে গুলশান কার্যালয় থেকে বেরিয়ে স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য জনসভা না করে গাজীপুরে হরতাল পালনের সিদ্ধান্তকে 'ভুল' বলে আখ্যা দেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, 'আমরা ৫ জানুয়ারি গণতন্ত্র হত্যা দিবস হিসেবে পালন করব। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি। এর আগে বড় কোনো ঝুঁকিতে না যাওয়াই ভালো বলে অনেকে মনে করেন। তাই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জনসভা না করে গাজীপুরে হরতালের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।' তবে জনসভা থেকে পিছু হটায় ২০-দলীয় জোটের শরিক দলগুলোও চরম হতাশ। জামায়াত, লেবার পার্টিসহ বেশির ভাগ শরিক দল বেগম খালেদা জিয়ার গাজীপুর অভিমুখী যাত্রার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনকে 'আত্দঘাতী' হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগরীর শীর্ষ এক নেতা এটিকে একটি 'ভুল' সিদ্ধান্ত আখ্যা দিয়ে বলেন, 'আমাদের যথাযথ প্রস্তুতি ছিল যেখানেই বাধা, সেখানেই সমাবেশ করার। তা করলেই রাজনৈতিক কৌশলগতভাবে ২০ দল আরও এগিয়ে যেত।' নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, 'জনসভা না করে হরতাল কর্মসূচি দেওয়ায় বিএনপি আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটা কাটিয়ে উঠতেও তাদের সময় লাগবে। কারণ, এতে দলের নেতা-কর্মীরাও হতাশ হয়েছেন। রাজনৈতিক কর্মসূচি হঠাৎ করেই মোড় ঘুরিয়ে ফেলায় মাঠপর্যায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাই আমি এর যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ দেখি না।' যোগাযোগ করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ বলেন, 'গাজীপুরের জনসভা না করার পেছনে বিএনপির নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা অবশ্যই ছিল। তারা দল ও জোটগতভাবে বৈঠক করেছে। সেখানে যা ভালো মনে করেছে তা-ই তারা করেছে। এতে ভালো হলো কি মন্দ হলো, সবই তাদের নিজস্ব ব্যাপার।' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, 'বিএনপি শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন কর্মসূচি করতে গেলে পুলিশ বাধা দিচ্ছে।
ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে অথবা ছাত্রলীগ-যুবলীগের মাধ্যমেও বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। আবার বিএনপি এসবের প্রতিবাদে হরতাল কর্মসূচি দিলে বলা হয়, দলটির আন্দোলনের শক্তি নেই। এখন বিএনপিকেই এই তিন বাধার আলোকে বাস্তবতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ আমি মনে করি, এখনো আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপির জনপ্রিয়তা অনেক বেশি।' সাবেক সংসদ সদস্য মেজর মো. আখতারুজ্জামান (অব.) বলেন, সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হতো ১৪৪ ধারা ভেঙে গাজীপুরে জনসভা করা অথবা গাজীপুর অভিমুখে যাত্রা শুরু করা। যদি যাত্রাপথে কোনো বাধা আসত তাহলে সে বাধা সাহসের সঙ্গে জনগণকে নিয়ে মোকাবিলা করে রাজনৈতিক বিজয় নিয়ে আসা যেত। যাত্রাপথে জনগণও তখন তার পাশে থাকত। কারণ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে মাঠে নামতে সাধারণ মানুষ ও বিএনপির তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা মুখিয়ে ছিল। জনসভা না করে হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করাও বিএনপির ভুল রাজনীতির একটি অংশ। এটা বিএনপির আরও একটি অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন