ইসলামী ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট দক্ষিণগাও বাজার এর পক্ষ থেকে সকল গ্রাহক, শুভাকাংখীসহ স

আচ্ছালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ। ইসলামী ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট দক্ষিণগাও বাজার এর পক্ষ থেকে সকল গ্রাহক, শুভাকাংখীসহ সবাইকে জানাই সালাম শুভেচ্ছা। এইগ্রুপে যারা আছেন তাদের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এলাকার এলাকারসকলকে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে বিদেশ থেকে রেমিটপন্স পাঠানোর আহবান জানাচ্ছি। রাজারবাগ, কুসুমবাগ, দক্ষিনগাও, শাহীবাগ, মানিকদিয়া, বাইকদিয়া, নন্দিপাড়াসহ সকল এলাকার গ্রাহক, শুভাকাংখী, শুভানুধ্যায়ীদের প্রদত্ত মোবাইল নাম্বারে যোগাযোগ করার অনুরোধ করা হলোঃ ০১৭১১-৪৫৮১৫১, ০১৭০০৯২৫২৪১

শনিবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৫

জাতীয়তাবাদী বিকারের বিপদ -ফরহাদ মজহার


স্বীকার করতে বাধা নাই, তরুণ বয়সে কবিতা লিখবার দোষ থাকবার কারণে ফকির লালন শাহের প্রতি আমার আগ্রহের কারণ ছিল তাঁর গান। তার জন্য আবদুল আলিমকে আমি আজ অবধি দোষী করি। তাঁর গাওয়া দুটো গান শ্রুতি ও স্মৃতির ওপর চিরকালের জন্য লিখিত হয়ে গিয়েছিল। একটি হচ্ছে ‘কে কথা কয়রে দেখা দেয় না’, আর ‘দ্বিতীয় গানটি হচ্ছে ‘ও যার আপন খবর আপনার হয় না’। পাকিস্তান আমলে অতিশয় জনপ্রিয় এই ‘পল্লীগীতি’র গায়ক কিভাবে আমাকে প্রভাবিত করেছে তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাই। পল্লীগীতি থেকে কুষ্টিয়া, কুষ্টিয়া থেকে লালন ও ফকিরফ্যাকড়াদের কাহিনী এবং ধীরে ধীরে নদিয়া এক অভূতপূর্ব ভাবের ভূগোল হিসাবে হাজির হতে শুরু করে। তারপর ইসলাম ও আখেরি নবিকে নিয়ে নদিয়ার তত্ত্ব গানঃ ‘এসে মদিনায় তরিক জানায়, তরিক জানায় কে সংসারে/কে তাহারে চিনতে পারে? নদিয়া প্রশ্ন নবি তো এসেছে ঠিকই/কিন্তু চিনল কে তাঁকে? এরপর নদিয়ার হাহাকার ও আর্তনাদ : ‘দেখা দিয়ে ওহে রসুল ছেড়ে যেও না/তোমার মতো দয়াল বন্ধু আর পাবো না’। ইত্যাদি
দর্শনে আমার আগ্রহ তীব্র হবার পর ফকির লালন শাহকে আমি নদিয়ার ভাবের ভাবুক হিসাবে বোঝার প্রয়োজনীয়তা তীব্র ভাবে বুঝতে পারি এবং নদিয়ার ভাবের চিহ্নসূত্রগুলো অনুসরণ করতে গিয়ে লালনের আগের মহাজনদের পদচিহ্ন অনুসরণ করা কর্তব্য বোধ করি। সেই পথে হেঁটে হোসেন শাহের আমলসহ চৈতন্যের কীর্তনে মুখর ‘নদিয়া নগর’ আবিষ্কার করি। আমার জন্য এটা ছিল এক চরম প্রাপ্তি, কারণ প্রথাগত চিন্তার শক্ত বেড়াজাল ভাঙবার এটা ছিল প্রায় অদৃশ্য ও অতিশয় ক্ষুদ্র ছিদ্রপথের মতো। যে ছিদ্রটুকুকে নিজেকে বদ্ধ খাঁচা থেকে বের হবার মতো বড় করবার জন্য আমাকে রক্তাক্ত আঙুলে দিনের পর দিন চেষ্টা চালাতে হয়েছে। নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই করতে হয়েছে। আমার ইঁদুরের মতো দাঁত নাই। নখও নাই। ফলে মাংস ও হাড়ের ওপর ভরসা করেই আমাকে বিনয়ী হয়ে নিজের পথ নিজে চিনে নিতে হয়েছে। এই শক্ত লোহার বেড়া কেটে বেরিয়ে আসার সাধ্য আমার আছে কখনই তা মনে হয় নি। এখনও মনে হয় না। কিন্তু একজন মানুষকে পেয়ে গিয়েছিলাম নদিয়ায়। ফকির লবান শাহ। আব্দুর রব ফকির নামে তিনি এলাকায় পরিচিত। এখন সবাইকে ছেড়ে তিরোধান করেছেন। কে কথা কয়, কিন্তু দেখা দেয় না তার সন্ধান করা কিম্বা নিজের খবর নিজে নেবার কাজ যে নিছকই নিজের দেহে কোন রহস্যময় জিনিস সন্ধান নয়, একালে তার অর্থ ভিন্ন সেটা সতর্ক করে দিয়েছিলেন প্রথম সাক্ষাতেই। এরপর সতর্ক করেছেন বারবার। কল্পনার বাহাদুরি, তন্ত্রের কারিগরী কিম্বা বুদ্ধির আলো ফেলে নিজের মধ্যে কিছু খুঁজে বেড়ানো নয় বরং প্রাকৃতিক বিবর্তন ও ইতিহাসকে অবিচ্ছিন্ন গণ্য সেই অভিজ্ঞতার মধ্যে নিমজ্জিত যে কর্তা আমাদের মধ্যে কথা বলে তার ডাক শুনতে পাবার সাধনা করাই একালের কর্তব্য। এই কর্তব্যটুকু বুঝিয়েছিলেন প্রাণপণ। সেই ডাক শুনবার সাধনা করতে গেলে কল্পনা, কারিগরি, বুদ্ধিসহ সকল বৃত্তিই সমভাবে ও সহজ ব্যবহার জরুরী। এই হিম্মত যাঁর কাছ থেকে দান হিসাবে মানুষ পায়, তাঁর দাসত্ব বা এবাদতই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। সেই বোধটুকু হারিয়ে ফেললে এ কালে মানুষ অন্ধ। এই সাবধান বাণীটুকু সবস্ময়ই আমার সম্বল হয়ে আছে।
যা ভাণ্ডে তাই ব্রহ্মাণ্ডে এই ঘোষণা জারি থাকার পরেও একদা সাধককুল ভেবেছিলেন, শরীর মানে নিজের ভাণ্ড, আর ব্রহ্মাণ্ড বুঝি সেই শরীর থেকে আলাদা। তাঁরা নিজ দেহকে ব্রহ্মাণ্ড গণ্য করে দেহ সাধনা করেছেন। নিজ শরীরকে ব্রহ্মাণ্ড জ্ঞানে কল্পনায়, বুদ্ধির বিষয়ে কিম্বা তাদের নিজেদের তান্ত্রিক কারিগরীর অধীনে আনবার কথা ভেবেছেন, কিন্তু ব্রহ্মাণ্ডের আবির্ভাব, বিবর্তন বা ইতিহাসের খোঁজ নেবার দায় মনে করেন না। সাধকদের সেই কাল অনেক আগেই গত হয়ে গিয়েছে। সর্বব্যাপী ব্রহ্মাণ্ডে, কিম্বা বর্তমান জগতে, কিম্বা প্রকৃতির প্রাকৃতিকতার মধ্যে যে ভাবেই বলিÑ সামাজিক জীবন ও ব্যক্তির যাপন গুরুত্বপূর্ণ। দেহকে এই বৃহত্তর অর্থে বোঝা দরকার। তাহলে এই বৃহত্তরকে অর্থেই কে কথা কয় কিন্তু দেখা বা ধরা দেয় না, কথাটা একালে প্রাসঙ্গিক বা নদিয়ার ভাষায় ‘বর্তমান’ হতে পারে। কথা কইবার মানুষ্টির সন্ধান একালে জরুরী।
বলাবাহুল্য ফকির লালন শাহ বা তাঁর অনুসারীরা আমরা যেভাবে বুঝি সেই অর্থে এঁরা কেউই আধ্যাত্মিক বা মরমী নন। রক্তমাংসের মানুষ। মানুষ ভজনা করেন। কারণ মানুষের মধ্য দিয়েই জগত ও ইতিহাস ‘বর্তমান’ হয়। তাঁরা ভাববাদীও নন, বস্তুবাদীও নন। নিজেদের বলেন, বর্তমানবাদী। অনুমানে বিশ্বাস নাই। আস্থাও নাই। অনুমানের আল্লায় বিশ্বাস করেন না। কারণ আল্লাহ সর্বত্র আছেন, সর্বত্রই বর্তমান। মধ্যবিত্ত এদের জীবনের ওপর রংচং চড়িয়ে নানান বিকৃতির মিশাল দিয়ে নানা ভাবে বুঝে থাকে। ভাব বা বস্তুর তর্ক করতে গিয়ে মুর্গি আগে নাকি আণ্ডা আগে এই সকল বাহাসে তাদের আগ্রহ দেখিনি। মানুষ হিসাবে আমরা নিজে সাক্ষাৎ ‘বর্ত’ থেকে ‘ বর্তমানে’ কি করছি সেটাই তাদের প্রধান বিবেচ্য এটাই চিরকাল তাদের সঙ্গে সঙ্গ দিয়ে বুঝেছি।
দুই
কথাটি এভাবে শুরু করেছি কারণ সমাজে উত্থিত প্রশ্ন ও দ্বন্দ্ব সংঘাতের সমাধান নিম্ন বর্গের সাধারণ মানুষ কিভাবে করেন, তার প্রতি আমার আগ্রহ দীর্ঘদিনের। হয়তো তাদের দিক থেকে বাংলাদেশের ইতিহাস বোঝার চেষ্টা করলে আমরা আমাদের এখনকার সমস্যা সমাধানের কিছু সূত্র পেলেও পেতে পারি। নদিয়ার ভাবের কথাই ধরা যাক। নিদেন পক্ষে হোসেন শাহের আমল থেকে শুরু করে একাল অবধি বাংলার ভাবচর্চার ‘রাজনীতি’ বোঝা জরুরী। নদিয়ার ভাব জাতপাত, নারীপুরুষ, শ্রেণিতে শ্রেণিতে ভেদের বিরোধী। তাহলে তাকে গ্রেফ মরমি বা আধ্যাত্মিক বলার অর্থ হচ্ছে দৈনন্দিন সেই বিরোধিতার কর্তব্য থেকে নিজেকে বিচ্যুত করা। সাধু মণ্ডলি থেকে খারিজ হয়ে যাওয়া।
নদিয়া গ্রেফ ভূগোল কিম্বা ঔপনিবেশিক মানচিত্রের নদিয়া জেলা নয়। এটা হোসেন শাহ ও চৈতন্যের নদিয়া। ইসলাম যেখানে জাত পাত বিরোধী আন্দোলনের ছত্রছায়া ও প্রেরণা। জানা দরকার এই ইসলাম স্থানীয় অধিবাসীদের আরব, ইরানি বা তুরানি বানাবার চেষ্টা করে নি। অথচ আরব, ইরান, তুরান, পাঠান সকলের কাছ থেকেই সে অকাতরে গ্রহণ করেছে। দ্বিধা করে নি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ধর্মের প্রশ্নকে কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক পরিচয় বা ‘জাতি’ হিসাবে পরিচিতি নির্ণয়ের আইডেন্টিটি কার্ড বানাবার চেষ্টাও করে নি। এই এক ইসলাম যাকে এই সময়ের ইসলাম দিয়ে চেনা মুশকিল। অথচ এই সম্ভাবনা ইসলামের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। ইসলাম ধর্মের বৈশিষ্ট্য বৈশ্বিক সাম্প্রদায়িক বা জাতীয়তাবাদী নয়। তাই তাঁরা বাঙালি, মুসলমান বা হিন্দুর ভজনা করি বলেন নি, বলেছেন আমরা মানুষ ভজনা করি।
বলা বাহুল্য সেই সময়ে ধর্ম, ধর্ম চর্চা ও পরিচয়ের রাজনীতি ছিল না তা নয়, কিন্তু আধুনিক জাতীয়তাবাদ যে জাতিবাদী ও সেকুলার পরিচয়কে প্রধান গণ্য করে আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে তোলে, সেখানে ধর্ম পরিচয়ের চেয়ে জাতিবাদী পরিচয় প্রধান হয়ে উঠতে বাধ্য। জাতীয়তাবাদ তখন ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। ধর্ম তার প্রতিযোগী ও শত্রু হয়ে ওঠে। তাহলে এখনকার সময় তখনকার সময় নয়। তখনকার ধর্মের ভূমিকা এখনকার ধর্মের ভূমিকা রাখে নি। সেই সময়ের জাতি পরিচয়ের সঙ্গে আধুনিক জাতীয়তাবাদের জাতি পরিচয়ের ফারাক আছে। বর্ণ বা জাত জাতের পরিচয় বটে, কিন্তু তার পরিণতি বর্ণাশ্রম প্রথায় এবং সেই প্রথার বাস্তবায়ন ও টিকিয়ে রাখার দায় পালন করে ধর্ম। তাকে ধর্ম দিয়েই মোকাবিলা করতে হয়েছে। সেখানে সংঘাত কিম্বা ন্যায়-অন্যায় ঘটেনি তা নয়। আমাদের বুঝতে হবে ধর্ম বলি, জাতি বলি, জাতীয়তাবাদ বলি কিম্বা বলি আধুনিক রাষ্ট্র সব কিছুকেই ইতিহাসের আলোকেই বোঝা দরকার।
জাতীয়তাবাদ ও আধুনিক রাষ্ট্র যখন ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তখন সমাজে ও ইতিহাসে নতুন ধরণের সমস্যা তৈরি হয়। প্রশ্ন হচ্ছে আমরা এই সংঘাতকে স্বীকার করি কিনা। দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে একে আমরা ধর্মের সমস্যা হিসাবে কতোটা দেখি? আর কতোটা জাতীয়তাবাদ ও আধুনিক রাষ্ট্র নির্মাণের? সেই জাতীয়তাবাদ ভাষা ও সংস্কৃতির দ্বারা নির্ণয় করা হোক, কিম্বা হোক ধর্মের পরিচয়ের দ্বারা তাতে কিছুই আসে যায় না। আমাদের বুঝতে হবে আমরা আজ ইসলাম কিম্বা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব নিয়ে বিপদে পড়ি নি। আমরা বিপদে পড়েছি জাতীয়তাবাদ ও কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার প্রতিষ্ঠন হিসাবে আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার ভয়ানক বিপদের মধ্যে। যেখানে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা কুক্ষিগত করে বাঙালি জাতিবাদীরা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে নেমেছে। আর পালটা ধর্মবাদী জাতীয়তাবাদীরা সেই ক্ষমতা নিজেদের কুক্ষিগত করতে চায়। এই বিপদের মধ্যে আমরা পড়েছি।
যদি এই কথাটা মানি তাহলে তৃতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, ধর্ম, জাতীয়তাবাদ ও আধুনিক রাষ্ট্রের কঠোর পর্যালোচনা এবং আমাদের জন্য বাস্তব সমাধান অন্বেষণের জন্য পরস্পরের সঙ্গে কথা বলা ও সংকট নিরসনের জন্য আমরা তৈরি কিনা। এর উত্তর হচ্ছে না। নেতিবাচক। না, আমরা তৈরি না। আমরা বরং হানাহানি, হিংসা ও হত্যার রাজনীতিতে বিশ্বাসী। আমরা দুই পক্ষই গোরস্থানের দিকে চলেছি। আমাদের হুঁশ নাই।
কী করে বুঝি যে আমরা তৈরি না। কী করে বুঝি আমরা হানাহানি ও পরস্পরকে হত্যার জন্য তৈয়ারি? এটা বুঝি যখন দাবি করি আমি মুক্তমনা, আমার বুদ্ধি মুক্ত। আমি বিজ্ঞানচেতনা সম্পন্ন প্রতিপক্ষ পশ্চাতপদ, মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক। কিম্বা যখন মনে করি আমিই সত্য আমিই আল্লার সৈনিক, নাস্তিকদের কতল করাই আমার ঈমানি কর্তব্য। তখন বুজি আমরা আরো লাশের জন্য কাতর।
আর এটা আরো বুঝেছি গত চার তারিখে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের বক্তব্য পড়ে। প্রথম আলোর প্রশ্ন ছিল, “ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি উভয় পক্ষের রাজনীতিই ক্ষতিকর হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন আবুল কাসেম ফজলুল হক। এ ক্ষেত্রে কি সংলাপ, আলোচনা, সমঝোতা, বোঝাপড়ার সুযোগ রয়েছে কি না, যেমনটা দেখা গেছে তিউনিসিয়ায়?”
আনিসুজ্জামানের উত্তর : “আমি মনে করি, দুই পক্ষকে এক করে দেখা ঠিক নয়। ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে আমরা দেশকে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি এমন কথা মেনে নেওয়াও খুব কঠিন। কারণ পাকিস্তানের ধর্মীয় রাষ্ট্রীয় কাঠামো থেকে বের হয়েই আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রের একটা স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সেখানে যাঁরা ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চান বা ধর্মীয় আদর্শে দেশ চালাতে চান, তাঁদের সঙ্গে যদি ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের এক করে দেখি, তাহলে ঠিক হয় না। এই দুই পক্ষের মধ্যে সংলাপ-সমঝোতার সুযোগ খুব বেশি নেই। কারণ, যারা এসব আক্রমণ পরিচালনা করছে, হত্যা করছে, তারা তো কোনো যুক্তিতর্কের মধ্যে যাচ্ছে না, গেলে তো তারা লিখেই প্রতিবাদ করত। হয়তো ওই মতাবলম্বী অনেকের সঙ্গে আলোচনা সম্ভব, যারা সহিংসতার পথে অগ্রসর হচ্ছেন না। কিন্তু যারা সহিংসতা করছে, যারা হত্যা করছে, তারা তো সিদ্ধান্তই নিয়েছে যে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মধ্যে না গিয়ে শারীরিক বলপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে তারা সবকিছু করবে”।
ধর্ম, ধর্মরাষ্ট্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা বলতে আনিসুজ্জামান কি বোঝেন সেটা তিনিই জানেন। তাঁর শত্রু তিনি আগাম চিহ্নিত করে রেখেছেন। নিজে না পারেন তাদের শেখ হাসিনার র‌্যাব, পুলিশ, মিলিটারি দিয়ে মারবেন ও মারছেন। আনিসুজ্জামান বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীদের শিরোমণি। আবুল কাসেম ফজলুল হক কোন আবেগ বা শোকে কাতর হয়ে “ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি উভয় পক্ষের রাজনীতিই ক্ষতিকর” Ñ একথা বলেন নি। তিনি অনেক ভেবেচিনতে বুঝে শুনেই কথাটা বলেছেন, সেটা তিনি নিজেও বারবার বলেছেন। কিন্তু অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তার কিছুই বোঝেন নি। আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেছেন, রাজনৈতিক ও আদর্শিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বর্তমান সংঘাত ও সমাধানের সূত্র খুঁজতে হবে। আনিসুজ্জামান একে বুঝেছেন হত্যাকারীর সঙ্গে সংলাপ, আলোচনা, সমঝোতা, বোঝাপড়া করা। এটা যদি স্রেফ বিচ্ছিন্ন হত্যাকাণ্ড বলে সমাজ বিবেচনা করত তাহলে সেটা বিচ্ছিন্ন ভাবে পুলিশ ও আদালতের ব্যাপারের অধিক কোন বিষয় হোতনা। এই বিষয় নিয়ে আমাদের ভাবতেও হোতনা। পুরা সাক্ষাৎকার পড়ে আমার মনে হয়েছে, আনিসুজ্জামান ধর্মবাদী ও ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীদের মধ্যে সংঘাত, হানাহানি ও হত্যা জিইয়ে রাখতে চান। এর সঙ্গে শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকা এবং বর্তমান জঙ্গী ও সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ব্যবস্থা বহাল রাখার প্রশ্ন জড়িত। একদল হত্যা করছে গুপ্ত বাহিনী হয়ে ধর্মের নামে। আরেকদল হত্যা করছে জাতির নামে, রাষ্ট্রের নামে, ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে। একদল ব্যবহার করছে চাপাতি, আর অন্যদল ব্যবহার আইনশৃংখলা বাহিনী, তাদের প্রাণঘাতী মারণাস্ত্র। শুধু তাই নয়, আইন বহির্ভূত হত্যা, হেফাজতে, মৃত্যু ও গুম খুন দিয়ে জাতি ও রাষ্ট্রের প্রতিপক্ষকে নিত্যদিন হত্যা করা হচ্ছে। আনিসুজ্জামান জাতিবাদী ও রাষ্ট্রবাদী হত্যা ও হিংসার এই রূপ ও বাস্তবতাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করছেন। তিনি যে ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলছেন তার জন্য বাংলাদেশের জনগণ যুদ্ধ করে নি। তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা পড়ে দেখতে পারেন। কামাল হোসেন মুসাবিদা করেছেন আর তিনি তা অনুবাদ করেছেন। আওয়ামী লীগ তার দলীয় কর্মসূচি হিসাবে আওয়ামী লীগের চার নীতি আমাদের চাপিয়ে দিয়েছে। একে তিনি বলছেন ‘স্তম্ভ’। বাহাত্তরেও বাঙালি জাতিবাদীরা কোন প্রকার সংলাপ, আলোচনা, সমঝোতা, বোঝাপড়ার প্রয়োজন মনে করে নি। আজও মনে করে না।
আমাদের অবশ্যই জাতিবাদী ইসলামের চাপাতির বিরুদ্ধে যেমন দাঁড়াতে হবে একই ভাবে আনিসুজ্জামানদের জাতিবাদী হিংসা, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। আমাদের অবশ্যই বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি ও ইসলামকে জাতিবাদি বা জাতীয়তাবাদী অধঃপতন থেকে রক্ষা করতে হবে। সেখানে বাঙালি জাতীয়াতাবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম যেমন জরুরী একই ভাবে জাতিবাদী বা সাম্প্রদায়িক ইসলামের বিরুদ্ধে সংগ্রাম সমান ভাবে জরুরী। আনিসুজ্জামান ও দুই পক্ষের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আমরা এর পরে আনিসুজ্জামানের সাক্ষাৎকারের পুরোটা নিয়ে পরের কিস্তিতে আলোচনা করব। এখন নদিয়া কেন্দ্র করে দুই একটি কথা বলে শেষ করছি।
তিন
তাহলে অনুমান করা যায় ইসলাম একরকম একাট্টা কিছু নয়, তার নানান সামাজিক ও ঐতিহাসিক রূপ রয়েছে, চর্চাভেদে তার ভাল মন্দ আছে। সুলতানি আমলে ইসলাম জাতীয়তাবাদী রূপ নিয়ে আসে নি। ধর্ম হিসাবেই তার আবির্ভাব ঘটেছিল, সংঘাত ও বিরোধের ক্ষেত্রও ছিল ধর্ম। সর্ব ক্ষেত্রে এর ফল ইতিবাচক হয়েছে সেটা আমার দাবি নয়। কিন্তু ইসলাম সেই সময় জাতীয়তাবাদী বা বিশেষ একটি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসাবে আসে নি, এটা বুঝতে পারা আমাদের জন্য এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নœ বর্ণের বা নীচু জাতের মানুষ এবং অর্থনৈতিক ভাবে প্রান্ত সীমার জনগোষ্ঠীর কাছে ইসলাম যে অর্থ নিয়ে হাজির হয়েছিল তার সঙ্গে ইসলাম ডাকনামে যা কিছু এখন আমাদের সামনে হাজির সবকিছুকে মেলানো যাবে না। এই দিকটি বোঝার জন্য যদি আমরা আন্তরিক হই, তাহলে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধান আমরা অবশ্যই করতে সক্ষম হবো। সুলতানি আমলে ইসলামের ইতিহাস আমাদের নতুন ভাবে পাঠ ও পর্যালোচনা দরকার, তার ভালমন্দ বিচারের অবকাশ রয়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু এই ইতিহাস আমাদেরই ইতিহাস। আমাদের বেড়ে ওঠার, কিম্বা বেড়ে না ওঠার ইতিহাস।
তবে যতোটুকু এই সময়ের ইতিহাস আমরা বুঝি সেই সময় এই দেশের ভূগোল, ভাব ও ভাষার মধ্যেই ইসলাম নিজেকে সবার আগে কায়েম করবার চেষ্টা করেছে, ভিন দেশের সংস্কৃতি চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করে নি। আমাদের আরব, ইরানি বা তুরানি বানায় নি। আমাদের বাঙালি বানিয়েছে। বাংলা ভাষা শিখিয়েছে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিকাশের শর্ত তৈরি করে দিয়েছে। অন্তত সুলতানি আমলের ইতিহাস আমাদের সেই সাক্ষ্য দেয়। নদিয়ার ইতিহাস সেই দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু এই দেশের মুসলমান ‘নদিয়া’, ‘চৈতন্য’, ‘নদিয়ার ভাব’ ইত্যাদিকে এখনও হিন্দুদের বিষয় বলেই গণ্য করে, হিন্দুদের ইতিহাস হিসাবেই বিবেচনা করে, তাদের নিজেদের বেড়ে ওঠার ইতিহাস নয়। এই ঐতিহাসিক অজ্ঞতা ও জাতীয়তাবাদী অসুখের মধ্যে ইসলামের অধঃপতন বাংলাদেশের জনগণের জন্য বিপদের জায়গা। বাঙালি মুসলমান সুনির্দিষ্ট ভাবে নিজের ইতিহাস অনুসন্ধান করতে অর্থাৎ নিজেকে জানতে আগ্রহী নয়। সে তার নিজের খবর নিতে রাজি না। সুলতানদের চেয়ে বাংলাদেশের মুসলমানদের কাছে মুঘলদের কদর বেশি। তারা এখনও নিজেদের মুঘলদের বংশধর মনে করে, স্বপ্ন দেখে একদিন তারা আবার ভারতবর্ষে মুসলমান সাম্রাজ্য কায়েম করবে। সুলতানি বাংলায় ইসলাম কিভাবে ভাষায় ও ভাবে তাদের আবির্ভূত হবার ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে সেই গৌরবটুকু জানবার ও বুঝবার তার আগ্রহ খুবই ক্ষীণ।
তাহলে বাঙালি, বাংলাভাষী এবং ঐতিহাসিক ও জন্মসূত্রে যদি কেউ মুসলমান হয়ে থাকে তাহলে এই অঞ্চলে ইসলামের ইতিহাস পাঠ ও পর্যালোচনা গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয়তাবাদী যুগে ইসলামের জাতীয়তাবাদী ভূমিকার পর্যালোচনা আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। জাতীয়তাবাদী ইসলাম পাকিস্তানি আমলে ইউরোপের মতো মুসলিম রেনেসাঁর স্বপ্ন দেখেছে, তার ফল সর্বক্ষেত্রে খারাপ হয়েছে বলা যাবে না। কিন্তু একাত্তরে সেই ইসলাম পক্ষ নিয়েছে সহিংস পাকিস্তানী রাষ্ট্রের। পক্ষ নিয়েছে তাদের যারা রাষ্ট্রের নামে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আজ বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা ও ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীরা একই কাজ করছে। একে আমি অধঃপতন বলছি। বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি ও ইসলামকে এই অধঃপতন থেকে উদ্ধার করা আমাদের সকলেরই কর্তব্য হয়ে উঠেছে। অধঃপতন ঘটার কারণ ও ইতিহাস বোঝা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি একটি গুরুতর ঐতিহাসিক কর্তব্য।
কাণ্ডজ্ঞানে বোঝা যায় জাতীয়তাবাদের উত্থান ও শক্তিবৃদ্ধির আগে ইসলামের এই অধঃপতন অসম্ভব ছিল। ইসলামের জাতীয়তাবাদী বা সাম্প্রদায়িক অধঃপতন একমাত্র জাতীয়তাবাদী বা সাম্প্রদায়িক যুগেই সম্ভব। সেটা ঘটেছে ঔপনিবেশিক আমলে হিন্দু জাতীয়তাবাদের পরিগঠন এবং তাকে ‘বাঙালি’র একমাত্র পরিচয় হিসাবে হাজির করবার রাজনীতির প্রতিক্রিয়া ও পরিণতিতে। ইসলামকে জাতীয়তাবাদী পরিচয়ের পরিচয়পত্র হিসাবে হাজির করা এই দেশের মুসলমানরা শিখেছে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের কাছ থেকে। ঔপনিবেশিক আমলে কলকাতায় ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক ‘বাঙালি জাতি’র ধারণা গড়ে ওঠা এবং সেই পরিচয়ের আড়ালে উচ্চ বর্ণের হিন্দুর ইতিহাস ও পরিচয় আড়াল করবার প্রতিক্রিয়া থেকে এই দেশের মুসলমানরা ইসলামি জাতীয়তাবাদের ঝাণ্ডা তুলে ধরেছিল। ঠিক যে এই দেশের কৃষক পাকিস্তান চেয়েছিল, কারণ জাতীয়তাবাদী হিন্দুর হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার অর্থ একই সঙ্গে জমিদারতন্ত্র ও মহাজনী শোষণ থেকে মুক্তি। কিন্তু ইসলামের নামে তারা সাম্প্রদায়িকতা চায় নি। ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা থেকেই তারা বুঝেছে হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা রাজনৈতিক দিক থেকে বর্ণাশ্রম ও জাত পাতের বিরোধিতা অর্থাৎ নিম্ন বর্ণের এবং নিম্ন বর্গের মানুষের সঙ্গে উচ্চ বর্ণের অভিজাত হিন্দু শ্রেণি- যারা ততোদিনে ‘ভদ্রলোক’ হিসাবে পরিচিত হতে শুরু করেছে- তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক লড়াই। এই দিকটি এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বুঝতে ভুল করে নি। কলকাতার উচ্চ বর্ণের বাঙালিত্বকে এই দেশের মুসলমানরা উচ্চ বর্ণের হিন্দুর হিন্দুত্ববাদ হিসাবে ঠিকই বুঝেছে। কিন্তু তার বিরোধিতা করতে গিয়ে তারা নিজেরা জাতীয়তাবাদের যুগে জাতীয়তাবাদী হয়ে গিয়েছে। জাতীয়বাদীদের দেখাদেখি আধুনিক জাতিরাষ্ট্র বানানো আদৌ ইসলামের রাজনৈতিক প্রকল্প হতে পারে কিনা এটা তারা ভাবে নি। অথচ এটাই সকলকে ভাবতে হবে। জাতিবাদী রাষ্ট্রই মুসলমানরা বানাতে চায়। বিশেষণ হিসাবে আধুনিক রাষ্ট্রের সামনে ইসলামি বসিয়ে দিলে সেটা আধুনিক ইসলামি রাষ্ট্র হয়ে যায় না। মুসলমান জাতীয়তাবাদীদের কাছ থেকেই সাম্প্রদায়িকতা রপ্ত করেছে। এই দোষ আগে কাটিয়ে তুলতে হবে। নইলে ইসলাম বিদ্বেষীদের পরাস্ত করা যাবে না।

তাহলে এই দেশে ইসলামের সাম্প্রদায়িক ও জাতীয়তাবাদী বিকার পরিহার করে নতুন গণশক্তি নির্মাণের পথ কী হতে পারে এবং সেই নির্মাণে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কিভাবে আমরা ধারণ করব তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। আগামী আরেকটি লেখায় আনিসুজ্জামানের সাক্ষাৎকার ও বাংলাদেশে হত্যার রাজনীতির পর্যালোচনার সূত্র ধরে আমরা আবুল কাসেম ফজলুল হক যে কথা বলেছেন তার অসাধারণ তাৎপর্য অনুধাবনের চেষ্টা করব।

৫ নভেম্বর ২০১৫। ২১ কার্তিক ১৪২২। শ্যামলী।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন