মেডিকেলে ক্লাস শেষ করে তিনতলা থেকে নিচে নামছি , এমন সময় দেখলাম হন্তদন্ত হয়ে এক বৃদ্ধ আমার দিকে ছুটে আসছেন। বৃদ্ধের চোখে জল। বোধহয় কান্না করছিলেন। এসেই বললেন -
- বাবা , একটু শুনো।
- কি হয়েছে চাচা?
- তোমার গায়ে এপ্রণ দেখে দৌড়ে আসলাম বাবা, এই সাদা কাপড়টা দেখলে ভরসা পাই বড়।
আমি নির্ভরতাসূচক হাসি দিয়ে বললাম -
- বলুন চাচা , দেখি কি করতে পারি।
উনি মন খারাপ করে বলা শুরু করলেন। ওনার কথার সারমর্ম করলে এই হয় , ওনার স্ত্রী বেশ ক'বছর ধরে অসুস্থ। গতকাল ডাক্তারের কাছে এসেছেন , এবং অবস্থা খুব বেশী আশংকাজনক বিধায় ডাক্তার বলেছেন আজই অপারেশন করতে হবে।
উনি টাকা যোগাড় করেছেন কিন্তু অপারেশনের জন্য এক ব্যাগ রক্ত লাগবে, সেটা উনি সংগ্রহ করতে পারেননি। আর সেটা না পেলে ওনার স্ত্রীকে বাঁচানো সম্ভব হবে না।
রক্তের গ্রুপ O+ , অনায়াসেই পেয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু ওনার আত্মীয় স্বজনদের মাঝে কারো এ গ্রুপের রক্ত নেই। আমার রক্তের গ্রুপ ও O+ , আমিই দিতাম রক্ত কিন্তু শেষবার রক্ত দিয়েছি আড়াই মাস ও হয়নি। অন্তত তিন মাস হওয়া উচিত।
তবু ওনাকে আশ্বাস দিয়ে বললাম ,
- চাচা ,চিন্তা করবেন না। ব্লাড ব্যাংকে পাওয়া যাবে মনে হয়। চলুন দেখে আসি।
উনি বোধহয় কিছুটা স্বস্তি পেলেন। খানিকটা দম ছেড়ে আমার পিছন পিছন হাটা শুরু করলেন। আমি ব্লাড ব্যাংকে গিয়ে সবকটা রিজার্ভ করা রক্তের ব্যাগ চেক করলাম কিন্তু O+ এর একটাও ব্যাগ পেলাম না!
আসলে আমার আর কিছুই করার ছিলো না। আমি ওনার দিকে ফিরে মন খারাপ করে বলি -
- চাচা , O+ এর কোন রক্ত নেই এখানে , আপনি আরেকটু খুঁজে দেখেন।
অবাক হয় লক্ষ্য করলাম, এটা শোনার সাথে সাথে স্ত্রী কে বাঁচানোর আশায় বুক বেধে রাখা বৃদ্ধের উজ্জ্বল চোখদুটো হঠাৎ করে যেন নিষ্প্রভ হয়ে এলো! চোখের কোণে একটু জলও!
আমি হতভম্বের মত দাড়িয়ে রইলাম। বৃদ্ধ কিছু না বলে মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছেন। আমি তখন নিজের সাথে যুদ্ধ করে চলেছি। একসময় চিন্তা করলাম, আমার শরীরের হয়তো কিছুটা সমস্যা হবে কিন্তু এক ব্যাগ রক্তের বিনিময়ে হয়তো বাঁচবে একটি প্রাণ , হয়তো থামাতে পারব স্ত্রীকে বাঁচানোর আকুঁতি জানানো এক বৃদ্ধের কান্না। আমি পিছন থেকে ডাক দিলাম -
- চাচা!
ডাক শুনে উনি এদিক ফিরে শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমি হাসিমুখে বললাম -
- আমিই রক্ত দিবো। চলেন।
আমার আবার হতভম্ব হওয়ার পালা। বৃদ্ধ কান্নাভেজা চোখে ছুটে এসে জাপটে ধরলেন আমাকে, যেন আমি তার কত আপন , কত চেনা! আমি হেসে তার পিঠে হাত রাখলাম। তারপর সেদিন রক্ত দিয়ে বৃদ্ধের স্ত্রীকে দেখে এলাম। আমার এতটুকুও খারাপ লাগেনি সেদিন।
এরপর আর জানা হয়নি কিছু।
প্রায় এক বছর পর্।
আমি মেডিকেলে যাওয়ার জন্য বাসার সামনে থেকে রিকশায় উঠলাম। তো কিছুক্ষণ পর, মেডিকেলের সামনে চলে এলাম। রিকশা থেকে নামার পর ভাড়া মিটিয়ে দেয়ার জন্য যেই মানিব্যাগে হাত দিলাম , রিকশাওয়ালা বললেন ,
- বাবা , ভাড়া দেয়া লাগবেনা।
- কেন?
- আমারে চিনতে পারছেন?
আমি চমকে উঠলাম! এইতো সেদিনের সেই বৃদ্ধ লোকটি! আমি কিছু বলে উঠার আগেই উনি হাসিমুখে বললেন -
- বাবা , আমার বউটা এখন ভালো আছে। তোমারে কৃতজ্ঞতা জানানোর উপায় আমার জানা নাই। আল্লাহর কাছে দোয়া করি , একদিন অনেক বড় ডাক্তার হইবা বাজান, অনেক বড়।
আমি ওনার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে হেসে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করি। আমি আবার ওনাকে ভাড়া নেওয়ার জন্য অনুরোধ করি।
উনি মাথা নাড়িয়ে হেসে বললেন -
- যাই ,বাজান।
আমি স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রই। গ্রীষ্মের মধ্যদুপুরে তপ্ত সূর্যের নিচে রিকশায় প্যাডেল চেপে বৃদ্ধ ততক্ষনে অনেকদূর চলে গিয়েছেন। আমি অবাক তাকিয়ে থাকি মানুষটির দিকে।
আর হয়তো কোনদিন দেখা হবে না, কিন্তু চলে যাওয়ার আগে বৃদ্ধ আমাকে একটি জিনিস শিখিয়ে গিয়েছেন, সেটি হলো, ভালোবাসা। বয়সের ভাড়ে ন্যুব্জ হয়ে যাওয়া হাড় জিরজিরে স্ত্রীর প্রতি বৃদ্ধের ভালোবাসা সত্যি আমাকে মুগ্ধ করেছে , শিখিয়েছে অনেক কিছু।
আসলে কি , ভালোবাসাটা দৈহিক সৌন্দর্য, অর্থের প্রাচুর্য বা বাহ্যিক রূপ দেখে হয় না , ভালোবাসাটা আসে হৃদয়ের খুব গহীন থেকে , মনের অনন্ত অন্ত:স্থল থেকে।
পৃথিবীর প্রত্যকটা মানুষ যদি পাশের মানুষটাকে এমন করে ভালোবাসত, পৃথিবীটা কত্তো সুন্দর হতো! নিজের প্রতি প্রিয় মানুষটির ভালোবাসায় মুগ্ধ হতাম আমরা প্রতিটিক্ষণ!
✎ লিখেছেন: ধূসরাভ শুভ্র
- বাবা , একটু শুনো।
- কি হয়েছে চাচা?
- তোমার গায়ে এপ্রণ দেখে দৌড়ে আসলাম বাবা, এই সাদা কাপড়টা দেখলে ভরসা পাই বড়।
আমি নির্ভরতাসূচক হাসি দিয়ে বললাম -
- বলুন চাচা , দেখি কি করতে পারি।
উনি মন খারাপ করে বলা শুরু করলেন। ওনার কথার সারমর্ম করলে এই হয় , ওনার স্ত্রী বেশ ক'বছর ধরে অসুস্থ। গতকাল ডাক্তারের কাছে এসেছেন , এবং অবস্থা খুব বেশী আশংকাজনক বিধায় ডাক্তার বলেছেন আজই অপারেশন করতে হবে।
উনি টাকা যোগাড় করেছেন কিন্তু অপারেশনের জন্য এক ব্যাগ রক্ত লাগবে, সেটা উনি সংগ্রহ করতে পারেননি। আর সেটা না পেলে ওনার স্ত্রীকে বাঁচানো সম্ভব হবে না।
রক্তের গ্রুপ O+ , অনায়াসেই পেয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু ওনার আত্মীয় স্বজনদের মাঝে কারো এ গ্রুপের রক্ত নেই। আমার রক্তের গ্রুপ ও O+ , আমিই দিতাম রক্ত কিন্তু শেষবার রক্ত দিয়েছি আড়াই মাস ও হয়নি। অন্তত তিন মাস হওয়া উচিত।
তবু ওনাকে আশ্বাস দিয়ে বললাম ,
- চাচা ,চিন্তা করবেন না। ব্লাড ব্যাংকে পাওয়া যাবে মনে হয়। চলুন দেখে আসি।
উনি বোধহয় কিছুটা স্বস্তি পেলেন। খানিকটা দম ছেড়ে আমার পিছন পিছন হাটা শুরু করলেন। আমি ব্লাড ব্যাংকে গিয়ে সবকটা রিজার্ভ করা রক্তের ব্যাগ চেক করলাম কিন্তু O+ এর একটাও ব্যাগ পেলাম না!
আসলে আমার আর কিছুই করার ছিলো না। আমি ওনার দিকে ফিরে মন খারাপ করে বলি -
- চাচা , O+ এর কোন রক্ত নেই এখানে , আপনি আরেকটু খুঁজে দেখেন।
অবাক হয় লক্ষ্য করলাম, এটা শোনার সাথে সাথে স্ত্রী কে বাঁচানোর আশায় বুক বেধে রাখা বৃদ্ধের উজ্জ্বল চোখদুটো হঠাৎ করে যেন নিষ্প্রভ হয়ে এলো! চোখের কোণে একটু জলও!
আমি হতভম্বের মত দাড়িয়ে রইলাম। বৃদ্ধ কিছু না বলে মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছেন। আমি তখন নিজের সাথে যুদ্ধ করে চলেছি। একসময় চিন্তা করলাম, আমার শরীরের হয়তো কিছুটা সমস্যা হবে কিন্তু এক ব্যাগ রক্তের বিনিময়ে হয়তো বাঁচবে একটি প্রাণ , হয়তো থামাতে পারব স্ত্রীকে বাঁচানোর আকুঁতি জানানো এক বৃদ্ধের কান্না। আমি পিছন থেকে ডাক দিলাম -
- চাচা!
ডাক শুনে উনি এদিক ফিরে শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমি হাসিমুখে বললাম -
- আমিই রক্ত দিবো। চলেন।
আমার আবার হতভম্ব হওয়ার পালা। বৃদ্ধ কান্নাভেজা চোখে ছুটে এসে জাপটে ধরলেন আমাকে, যেন আমি তার কত আপন , কত চেনা! আমি হেসে তার পিঠে হাত রাখলাম। তারপর সেদিন রক্ত দিয়ে বৃদ্ধের স্ত্রীকে দেখে এলাম। আমার এতটুকুও খারাপ লাগেনি সেদিন।
এরপর আর জানা হয়নি কিছু।
প্রায় এক বছর পর্।
আমি মেডিকেলে যাওয়ার জন্য বাসার সামনে থেকে রিকশায় উঠলাম। তো কিছুক্ষণ পর, মেডিকেলের সামনে চলে এলাম। রিকশা থেকে নামার পর ভাড়া মিটিয়ে দেয়ার জন্য যেই মানিব্যাগে হাত দিলাম , রিকশাওয়ালা বললেন ,
- বাবা , ভাড়া দেয়া লাগবেনা।
- কেন?
- আমারে চিনতে পারছেন?
আমি চমকে উঠলাম! এইতো সেদিনের সেই বৃদ্ধ লোকটি! আমি কিছু বলে উঠার আগেই উনি হাসিমুখে বললেন -
- বাবা , আমার বউটা এখন ভালো আছে। তোমারে কৃতজ্ঞতা জানানোর উপায় আমার জানা নাই। আল্লাহর কাছে দোয়া করি , একদিন অনেক বড় ডাক্তার হইবা বাজান, অনেক বড়।
আমি ওনার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে হেসে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করি। আমি আবার ওনাকে ভাড়া নেওয়ার জন্য অনুরোধ করি।
উনি মাথা নাড়িয়ে হেসে বললেন -
- যাই ,বাজান।
আমি স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রই। গ্রীষ্মের মধ্যদুপুরে তপ্ত সূর্যের নিচে রিকশায় প্যাডেল চেপে বৃদ্ধ ততক্ষনে অনেকদূর চলে গিয়েছেন। আমি অবাক তাকিয়ে থাকি মানুষটির দিকে।
আর হয়তো কোনদিন দেখা হবে না, কিন্তু চলে যাওয়ার আগে বৃদ্ধ আমাকে একটি জিনিস শিখিয়ে গিয়েছেন, সেটি হলো, ভালোবাসা। বয়সের ভাড়ে ন্যুব্জ হয়ে যাওয়া হাড় জিরজিরে স্ত্রীর প্রতি বৃদ্ধের ভালোবাসা সত্যি আমাকে মুগ্ধ করেছে , শিখিয়েছে অনেক কিছু।
আসলে কি , ভালোবাসাটা দৈহিক সৌন্দর্য, অর্থের প্রাচুর্য বা বাহ্যিক রূপ দেখে হয় না , ভালোবাসাটা আসে হৃদয়ের খুব গহীন থেকে , মনের অনন্ত অন্ত:স্থল থেকে।
পৃথিবীর প্রত্যকটা মানুষ যদি পাশের মানুষটাকে এমন করে ভালোবাসত, পৃথিবীটা কত্তো সুন্দর হতো! নিজের প্রতি প্রিয় মানুষটির ভালোবাসায় মুগ্ধ হতাম আমরা প্রতিটিক্ষণ!
✎ লিখেছেন: ধূসরাভ শুভ্র
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন