বর্তমান পরিস্থিতিতে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হলে দলীয় প্রার্থীদের ভরাডুবির পাশাপাশি খুনোখুনির ঘটনা বাড়বে বলে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা সরকারকে সতর্ক করেছে
আধিপত্য বিস্তার, দলীয় পদ-পদবি, ভূমি দখল, টেন্ডারবাজি, চাঁদার টাকা ভাগাভাগি ও মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণসহ অভ্যন্তরীণ নানা কোন্দলে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর মাত্র ২১ মাসে প্রায় দেড়শ' নেতাকর্মী খুন হয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হলে দলীয় প্রার্থীদের ভরাডুবির পাশাপাশি খুনোখুনির ঘটনা আরো বাড়বে বলে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা সরকারকে সতর্ক করেছে।
সারাদেশে একই ধরনের ভয়াবহ চিত্রে সরকারের নীতি-নির্ধারক মহলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়েছে। আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড থেকে শুরু করে সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মাঝে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। বিব্রতকর পরিস্থিতিতে দু'পক্ষ থেকেই দলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে।
তবে দীর্ঘমেয়াদি কোন্দলে দলীয় অভ্যন্তরে জেঁকে বসা অস্থিতিশীলতা নিরসন করা আদৌও সম্ভব হবে কিনা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। তাদের ভাষ্য, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন যে টাইম ফ্রেম বেঁধে দিয়েছে, এ স্বল্প সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগের অন্তর্কোন্দল দূর করা সত্যিকার অর্থেই কঠিন হবে।
সরকারের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, আসন্ন পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলের মাঠ পর্যায়ের পরিস্থিতি পর্যালোচনায় জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দাসহ (এনএসআই) একাধিক সংস্থাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তারা বিভিন্ন স্তর থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এতে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নয় শতাধিক ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাদের মধ্যে প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব রয়েছে। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রায় নিয়মিতই তাদের মধ্যে সহিংস সংঘাতের ঘটনা ঘটছে। প্রায় তিন হাজার ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য মুখিয়ে রয়েছে। দলীয় মনোনয়ন না পেলে তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে লড়বেন এ প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এরই মধ্যে অনেকে পলিটিক্যাল ক্যাডারদের পাশাপাশি পেশাদার সন্ত্রাসীদের দলে ভেড়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রটি জানায়, এসব পরিস্থিতি দ্রুত মোকাবেলা করে দলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব না হলে আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা নির্বাচনে ভরাডুবি ঘটবে বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, আগামী ডিসেম্বরে দেশের ৩২৩টি পৌরসভা নির্বাচনের সময় নির্ধারিত হয়েছে। এরপর মার্চ-এপ্রিলে ৪ হাজার ৫৫৩টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হবে বলে ইতোমধ্যে ঘোষণা এসেছে। আর প্রথমবারের মতো এসব স্থানীয় সরকারের নির্বাচন দলীয়ভাবে হওয়ার সিদ্ধান্তও এসেছে সরকারের কাছ থেকে।
এদিকে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিয়ে গোয়েন্দারা উদ্বেগ প্রকাশ করলেও দলটির শীর্ষ নেতারা প্রকাশ্যে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তারা বলছেন, দলের ভেতর কোনো কোন্দল নেই। সন্ত্রাসী, খুনি ও মাদক ব্যবসায়ীদের কোনো দলও নেই। একটি কুচক্রীমহল আওয়ামী লীগের উন্নয়নে ঈর্ষান্বিত হয়ে নানা অপপ্রচার করছে।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের দাবি, দলীয় কোন্দলে কোনো খুনোখুনির ঘটনা ঘটেনি। যদি এমন প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে দল ও সরকার অবশ্যই এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি-জামায়াতসহ অন্য বিরোধী দলগুলোর রাজনীতিতে সক্রিয় কোনো ভূমিকা না থাকায় সরকারি দলের নেতাকর্মীরা ব্যক্তিগত নানা সুযোগ-সুবিধা হাসিলের জন্য বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ফলে ক্ষমতাসীন দলটির মধ্যে খুনোখুনি ও অন্তর্দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিভিন্ন স্তরের প্রশাসন রাজনৈতিক চাপে কোণঠাসা থাকায় তাদের পক্ষেও এ পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। হত্যাকা-ের সঠিক বিচার না হওয়ার কারণে তা ক্রমেই বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন অপরাধ বিশ্লেষকরা।
এ ব্যাপারে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, অনেক দিন ধরে ক্ষমতায় থাকার কারণে মাঠ পর্যায়ে দলটির নেতাকর্মীরা কিছুটা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে গেছে। আর দলের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতারা অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কথা স্বীকার না করলেও গত এক বছরে সংঘটিত অর্ধশতাধিক হত্যাকা-ের নেপথ্যে দলীয় নেতাকর্মীদের সংশ্লিষ্টতার সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ সরকারের কাছে উপস্থাপন করেছে।
গত ৩ জানুয়ারি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার ফুলতলা বাজার এলাকায় প্রতিপক্ষের গুলিতে যুবলীগকর্মী মো. জামাল উদ্দিন খুন হন। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে ২০ জানুয়ারি যশোরের মণিরামপুরে শাহিনুর রহমান নামে এক যুবলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ৬ মার্চ ২০১৫ নাটোরে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ওয়ার্ড যুবলীগ নেতা সিরাজ শিকদার (৪০) খুন হয়েছেন। ৮ এপ্রিল যশোর শহরের দুর্বৃত্তরা গুলি করে খুন করে মঞ্জুর রশিদ নামে এক আওয়ামী লীগ নেতাকে। স্থানীয়দের দাবি, দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধের জের ধরে এই হত্যাকা- সংঘটিত হয়। ১১ এপ্রিল কুমিল্লায় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ শহর ছাত্রলীগ সভাপতি ও কুমিল্লা সার্ভে ইন্সটিটিউটের ভিপি সাইফুল ইসলাম গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। ১৬ এপ্রিল দিনাজপুরে হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের মো. জাকারিয়া ও ভেটেরিনারি অনুষদের মাস্টার্সের মিল্টন নামে দুই ছাত্র নিহত হন। ২৩ এপ্রিল রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে যুবলীগ নেতা শরিফুজ্জামানসহ দুজন খুন হয়েছেন।
১৩ মে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে টাঙ্গাইলের মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রলীগ নেতা নিহত হন। ১৫ মে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কুমিল্লার তিতাস উপজেলার কড়িকান্দি বাসস্ট্যান্ডে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতার অনুসারীদের গোলাগুলিতে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মাসুম সরকার মারা যান। ৫ জুন ঝালকাঠি সদর উপজেলায় তৌহিদুল ইসলাম সিকদার নামে এক যুবলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীরা। ১৯ জুন ফেনীতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে বালিগাঁও ইউনিয়ন যুবলীগের সহ-সভাপতি মোহাম্মদ মানিক নিহত হন। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে স্থানীয় যুবলীগের অপর একটি গ্রুপের সঙ্গে বিরোধের জের ধরে এ হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটে।
২৮ জুন লালমনিরহাট সদর উপজেলা যুবলীগ সদস্য বুলেটকে (৩২) কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীরা। গত ৪ জুলাই চট্টগ্রামে জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে সৃষ্ট সংঘর্ষে নুরুল হুদা নামে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের এক নেতা নিহত হন। ৫ জুলাই কুমিল্লার মনোহরগঞ্জে তুচ্ছ ঘটনায় ইয়াকুব আলী নামের এক আওয়ামী লীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করেছেন স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। ১১ জুলাই রাজবাড়ী সদরের পাঁচুরিয়া ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি আবদুস ছাত্তার খুন হন। ২১ জুলাই জেলার রানীনগরে জমি নিয়ে বিরোধের জেরে আমজাদ হোসেন নামে আওয়ামী লীগের এক নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২৪ জুলাই পাবনার বেড়া উপজেলার আমিনপুর থানা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দানেজ শেখকে কুপিয়ে হত্যা করেছে প্রতিপক্ষ। ১ আগস্ট সন্দ্বীপের মগধরা ইউনিয়নের নামারবাজার এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে যুবলীগের এক কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ৭ আগস্ট নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার দেওটি ইউনিয়ন যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক মিলন সরকারকে (২৮) কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীরা। একইদিন বরিশালের আগৈলঝাড়ায় রাসেল ব্যাপারী নামে ছাত্রলীগের এক কর্মী খুন হন।
১২ আগস্ট দুপুরে সিলেট মদন মোহন কলেজ ক্যাম্পাসে আগের দিনের বিরোধের জেরে ছাত্রলীগকর্মী আবদুল আলীকে প্রণজিৎ দাশের নেতৃত্বে কয়েকজন মিলে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেন। ১৩ আগস্ট রাত সাড়ে ৯টার দিকে রাজধানীর মধ্যবাড্ডার পানির ট্যাংকি এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে যুবলীগের দু'গ্রুপের গোলাগুলিতে আওয়ামী লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের ৩ নেতা নিহত হন। কোরবানির পশুর হাটের ইজারা নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে ক্ষমতাসীন দলের এই তিন নেতা খুনের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। গত ১৫ আগস্ট দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দেয়াকে কেন্দ্র করে কুষ্টিয়া শহরের মজমপুর গেট এলাকায় জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার ওপর গুলিবর্ষণ করেন আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা। এ ঘটনায় সবুজ (২৪) নামে আওয়ামী লীগের এক কর্মী নিহত ও অন্তত ১০ জন আহত হন।
১৪ সেপ্টেম্বর গফরগাঁও উপজেলার নিগুয়ারি ইউনিয়নে ১নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খুন হন। ২৯ সেপ্টেম্বর যশোরের বেনাপোলে প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীরা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস সামাদকে কুপিয়ে হত্যা করে।
উৎসঃ যাযাদি
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন