আইনমন্ত্রী বলছেন, দুই পরিবার বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। দুই পরিবার বলছে, কারা কর্তৃপক্ষ, আইন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলছেন তা সত্য নয়। তাদের দাবি সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাননি। দুই পরিবারের চ্যালেঞ্জ মন্ত্রীরা গ্রহণ করতে রাজি হননি। তারা প্রাণভিক্ষার কাগজপত্র মিডিয়াকে দেখাতেও অপারগতা প্রকাশ করেছেন। কেন এই অপারগতা, তা আরো বড় প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। এটা কোনো গোপন দলিল নয়। আইনে বাধাও নেই। তাহলে মিডিয়ার হাতে প্রাণভিক্ষার কথিত আবেদনটি তুলে না দিয়ে সরকার কী বোঝাতে চেয়েছে? তা ছাড়া ৪৯ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যার অবকাশ রেখে মন্ত্রী কেন এর পেছনে দৌড়ালেন?
এই ধূম্রজাল ও বিভ্রান্তির ভেতর জনগণ কাকে বিশ্বাস করবে? আবেদনটি প্রকাশ করলে সরকার অন্তত প্রাণভিক্ষা ইস্যুতে দায়মুক্ত হয়ে যেত। অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক থেকে বঙ্গভবনের প্রাতিষ্ঠানিকতাও রক্ষা পেত। দুই পরিবারের দাবি সত্য কি মিথ্যা, সেটা জাতি জেনে যেত। তাতে কারো লাভ না হলেও লিগেসির প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকত না। রাজনৈতিক জেদ বড় হয়ে যেত না।
এখন মিডিয়াও বিশ্বাসযোগ্যতা ধরে রাখতে পারছে না। কোনটা মতলবি প্রচারণা, কোনটা খবর, সেটাও অনেক মিডিয়াকর্মী ভুলে বসেছেন। সমস্বরে সমান্তরাল সরকারি ও মিডিয়ার বক্তব্য মন্তব্য সত্যানুরাগীদের মন বিষিয়ে তুলেছে। ক্ষমতাসীনেরা লাভবান হলেও বস্তুনিষ্ঠতার নিরিখে আমাদের মিডিয়া আরো একবার ক্ষতিগ্রস্ত হলো। কিছু মিডিয়ার একতরফা ভূমিকা খোদ প্রধানমন্ত্রীরও পছন্দ হয়নি। দুই পিঠ দেখানো মিডিয়ার কাজ। পক্ষ-বিপক্ষ মিডিয়া নয়, জনগণের ভাবনা।
রাজনৈতিক বক্তব্যের বিশ্বাসযোগ্যতার বিবেচনায় বর্তমান সরকারের কোনো মুখপাত্র পরীক্ষিত নন। তারা কেউ ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরও নন। তারা মিথ্যা বলছেন, এমন সোজাসাপটা মন্তব্য করব না। বলতেই হবে, এর মাধ্যমে অনেক সত্য চাপা পড়ে যাওয়ার অভিযোগ তীব্রতর হওয়ার সুযোগ অবারিত হলো। এর দায় সরকারকেই নিতে হবে। তবে দু’জন ম্যাজিস্ট্রেটের কারাভ্যন্তরে দীর্ঘক্ষণ অবস্থান, মিডিয়াকে কিছু না জানিয়ে বেরিয়ে যাওয়া, তাৎক্ষণিক কারা কর্র্তৃপক্ষের বরাতে মিডিয়াকে প্রাণভিক্ষার তথ্য জানিয়ে দেয়ার অতি উৎসাহ প্রদর্শন, সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা ছাড়া- এর বরাত দিয়ে মন্ত্রীদের বক্তব্য দেয়া, অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে কথিত প্রাণভিক্ষার কাগজ বা নথি চালাচালি, দণ্ডপ্রাপ্তদের সাথে আইনজীবীদের দেখা করতে না দেয়া, দ্রুততম সময়ের মধ্যে সব কাজ সাঙ্গ করে ফাঁসি কার্যকর করা, ক্যামেরা ট্রায়ালের বাড়তি উৎসাহসহ সরকারের সব ভূমিকাকে ওভার অ্যাকটিং মনে হয়েছে। কোনো ওভার অ্যাকটিং বা অতি নাটকীয়তায় সত্য থাকে না, জীবনঘনিষ্ঠতার কোনো ছোঁয়া পাওয়া যায় না- এ ক্ষেত্রেও জনগণের সন্দেহকে অপনোদন না করে বরং বাড়িয়েছে। এই সন্দেহ শপথ ভঙ্গের অভিযোগ পর্যন্ত যেতে পারে।
কখনো কখনো মনে হয়েছে, ট্রাইব্যুনাল একটা আস্থার সঙ্কটে পড়েছে। চার-চারটি ফাঁসি, একজনও অপরাধ স্বীকার করছে না। প্রাণভিক্ষা করছে না। নিজেকে নির্দোষ দাবি করে ধীরস্থিরভাবে ফাঁসিকে নিঃসঙ্কোচে মেনে নিয়ে মৃত্যুর সাথে আলিঙ্গন করছে- এটা ট্রাইব্যুনাল ও সরকারকে নিশ্চয়ই ভাবিয়ে তুলেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অভিযোগ ও চাপ অবজ্ঞা করলেও এটা যেন সরকার মেনে নিতে পারছিল না। এক ধরনের বিবেকী দংশন কি সরকারকে তাড়া করছে? এটাই কি অতি নাটকীয়তার কারণ!
গ্লানিমুক্তির শ্লাঘাবোধ, ধিক্কারের কাহিনী, মিষ্টিমুখের খবর এক দিকের চিত্র; অন্য দিকে জনগণের নিরুত্তাপ থাকা, জিজ্ঞাসুর দৃষ্টি, ভাব প্রকাশে সংযত থাকা নিশ্চয়ই কোনো-না-কোনো ধারণাকে স্পষ্ট করে। সেখানে বিশ্বাসযোগ্যতার মানদণ্ডে কাদের প্রতি জনগণের আস্থার সূচক ঝুঁকে আছে, সেটা বিবেচনায় নেয়া দরকার। দেশ ও জাতি বিভাজিত। রাজনৈতিক কারণে বিভক্ত। জনগণের বিরাট অংশ নানা কারণে সংক্ষুব্ধ। একটি অংশ বিকারগ্রস্ত হলেও বেশির ভাগ মানুষ আস্থাহীনতার চরম সঙ্কটে রয়েছে। তাদের বিশ্বাসের জায়গায় সরকারের কোনো কথাই ঠাঁই পায় না। তাহলে মিডিয়ার একসুরো তীব্র ও ঝাঁজালো মন্তব্য শুনছে কারা? কারাই বা আমলে নিচ্ছে? সরকার কি দেখছে না, দেশের কোন মানুষেরা পুলিশ-বেষ্টনী ভেদ করে জানাজা পড়ছে? কবর জিয়ারতেই বা মানুষের স্রোত কেন অগণন? আমাদের জিজ্ঞাসা, এতটা ওভার অ্যাকটিং বা অতি নাটকীয়তার মাধ্যমে সব কিছুকে প্রহসনে পরিণত না করলে এমন কী হতো! মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিতরা দোষ স্বীকার করেছে- এটা বলার জন্য এত অস্থির না হলে কি চলছিল না! বিচারবহির্ভূত হত্যা তো কতই হচ্ছে। গুম-অপহরণের তো শেষ নেই। খুনের মামলার কত রাঘব বোয়াল আড়ালে থাকছে। আওয়ামী লীগ নেতা হলে সাত খুন মাফ। যেখানে হাজার অপরাধী মাফ পেয়ে যাচ্ছে- সেখানে এত বছর পর সন্দেহের তীর ছুড়ে প্রাণসংহার না করলে হাজার অপরাধী না হয় ক্ষমা পেত, কোনো নিরপরাধের জান কবজের প্রশ্ন উঠত না।
যারা দণ্ড ভোগ করে ফেলেছেন, তাদের প্রতি আর ঘৃণা ছিটিয়ে কী লাভ? কার লাভ? এর মাধ্যমে রাজনৈতিক জিঘাংসা ও ইস্যুর নিষ্পত্তি হলো কই! জাতি কি হাজার সমস্যা এড়িয়ে এসব ক্যারিকেচার নিয়ে খুব একটা ভাবছে? মনে হয় না।
ভারতীয় নেতা প্রণব মুখার্জি মনে করেন, বাংলাদেশ এখন ‘সমৃদ্ধ গণতন্ত্রের’ দেশ। হ্যাঁ, এমন গণতন্ত্রের দেশই তাদের কাম্য। তবে ভারতের জন্য নয়, পড়শিদের জন্য। বিশেষত নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতীয় নীতি এমনটিই হয়ে আসছে। পুরো জাতি মনে করে, দেশ ও জনগণ কার্যকর গণতন্ত্রের অভাবে স্বৈরতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী সরকারের অপশাসনের সঙ্কটে রয়েছে। সুশাসন ও আইনের শাসনের অভাবে ককিয়ে মরছে, আর প্রণব বাবু দেখছেন সমৃদ্ধ গণতন্ত্রের দেশ। প্রণব বাবুরা আমাদের কোন ধরনের গণতন্ত্র প্রেমের তাজমহল দেখাচ্ছেন? দেখার এই পার্থক্য দিয়েই জাতি ফাঁসির দণ্ডকেও দেখতে বাধ্য হচ্ছে। এ জাতি ভুলে যায়নি, ১৯৫ জন চিহ্নিত পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীকে ভারতের দূতিয়ালিতে কিভাবে জামাই আদরে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সে দিকে ইঙ্গিত করে তার ও বাঙালির উদারতার মাহাত্ম্য তুলে ধরেছিলেন। তাই দেশীয়দের প্রাণভিক্ষার অতি নাটকীয়তার ভেতরেও জনগণ অন্য এজেন্ডার আভাস পাচ্ছে। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও মিডিয়া আমাদের একমাত্র মানদণ্ড নয়। জনগণের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের জায়গায় সরকার ও অনুগত মিডিয়ার উপস্থিতি নেই। জনগণকে কোনো কিছু শিখিয়ে-পড়িয়ে বুঝিয়ে বলতে হয় না। জনগণ সব কিছু দেখছে; শুনছে। নিজেদের মতো করে বুঝেও নিচ্ছে। সেই জায়গায় সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা শূন্যের কোঠায়।
প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়তা দলীয় চিন্তায় আচ্ছন্ন কর্মী ও নেতাদের মেজাজ ফুরফুরে করে দিতেই পারে। জনগণ সেটাকে দৃঢ়তা ভাবছে, না প্রতিহিংসার চিতায় দাউ দাউ করে জ্বলা আগুনে অন্য কিছু দেখছে, সেটা খুঁজে দেখতে হবে সরকারকেই। তা ছাড়া ইস্যুটিকে আজকের প্রেক্ষাপটে যেভাবে দেখা হচ্ছে, ইতিহাস হয়তো ভিন্নমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখতেও পারে। তাই কিছু বিষয় ইতিহাসের কাছে সোপর্দ করে দেয়া সবার জন্যই মঙ্গল। যারা বিশ্বাস করেন জন্ম-মৃত্যুর ফয়সালা আসমানে হয়, জমিনে নয়; তারাও তো সান্ত্বনার একটা পথ খুঁজে পেতে পারেন। নয়া দিগন্তের সৌজন্যে
masud2151@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন