আমার বাবা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আপাদমস্তক একজন রাজনীতিবিদ। আমি এই মানুষটি এবং অন্য আরও কিছু প্রসঙ্গ নিয়ে কিছু কথা লিখছি। নিজের বাবাকে নিয়ে লেখা বোধহয় খুব শোভন নয়! আপাতদৃষ্টিতে এ কাজটি আমি আজ করতে চাই এবং করব।
মির্জা আলমগীরের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্ব্বীরা তাকে শ্রদ্ধা করেছেন সবসময়। এলাকায় যে কোনো বিপদে আপদে প্রথমে ছোটেন তাঁর কাছে, সমাধানের জন্য। তিনি যে দলেরই হোননা কেন, তিনি যে ধর্মেরই হোন না কেন। বলুকাকার একটি কথা মনে পড়ে গেল। নির্বাচনী প্রচারণায় আমি হাঁটছি এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ায়। বলুকাকার বাসার সামনে এসেছি, সঙ্গে থাকা দু’জন বললেন—ভেতরে যাওয়ার দরকার নেই, তিনি আব্বুর বিরুদ্ধে প্রচারণা করছেন। আমি তবু এগিয়ে গেলাম। ঘরে ঢুকতেই দেখি বলুকাকা আর ক’জন বসে। বললাম, বলুকাকা, আব্বুর জন্য দোয়া করবেন। বলুকাকা হেসে বললেন—মাগো, রাজনৈতিক কারণে আমি তোমার বাবার বিরোধিতা করছি; কিন্তু মানুষ আলমগীরের জন্য আমার মঙ্গল কামনা নির্ভেজাল, সবসময়।
নাম বলছি না, তবে আওয়ামী লীগের এক বিখ্যাত বাগ্মী রাজনীতিবিদ এক টকশোতে আব্বুর সঙ্গে বসতে চাননি। তার স্রেফ কথা, এই ভদ্রলোকের সঙ্গে আমি ঝগড়া করতে পারব না। শতভাগ সততার সঙ্গে মানুষটি সারা জীবন রাজনীতি করেছেন; নিজের আদর্শ, নিজের বিশ্বাসের সঙ্গে কখনো সমঝোতা করেননি। শুধু বোঝেননি, এই বাংলাদেশে তিনি বড়ই অনুপযুক্ত এক রাজনীতিবিদ।
একটি ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার আজ এই মানুষটিকে যেভাবে অপদস্থ করল, তা আসলেই উদাহরণ হয়ে থাকবে চরম অবিচারের। কী অপরাধ ছিল তাঁর? তিনি বিরোধী দলের মহাসচিব, সরকারের সমালোচনা করতেন, কর্মীদের সংগঠিত করতেন, তাঁদের উজ্জীবিত করতেন সরকারবিরোধী আন্দোলনে প্রকাশ্যে বক্তৃতা দিয়ে, যা পুরো বাংলাদেশের মানুষ দেখত, শুনত, উপলব্ধি করার চেষ্টা করত। তিনি বোমাবাজি করেছেন কিংবা করিয়েছেন? গাড়িতে আগুন দিতে বলেছেন? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মির্জা আলমগীরের চরম শত্রুও তা বিশ্বাস করবে না!
পঁয়ষট্টি বছরের মানুষটাকে আমি প্রায়ই প্রশ্ন করতাম—আব্বু, এই নষ্ট, পচে যাওয়া সমাজে তুমি কেন এখনও রাজনীতি করছ? ’৭১- পূর্ববর্তী রাজনীতির সেই পরিবেশ তো আর নেই। আগেও রাজনীতিবিদদের বন্দি করা হতো, তাদের সঙ্গে যথাযথভাবে ব্যবহার করা হতো, আজতো কোনো নিয়ম নেই, আজতো গ্রেফতার করেই রিমান্ডে নিয়ে প্রাগৈতিহাসিকভা ভেবে অত্যাচার করে। এসব বাদ দাও না! আব্বু স্মিত হেসে বলতেন, ‘শেষ চেষ্টাটা করেই দেখি, আমার তো চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই।’ তাঁর খুব প্রিয় কবিতার একটি লাইন প্রায়ই আমাকে বলতেন, ‘এখনি অন্ধ বন্ধ করো না পাখা।’ আমার এই বাবার বিরুদ্ধে এই সরকার দুটি আজব মামলা দিয়েছে। একটিতে অভিযোগ, আব্বু এবং আরও ক’জন মিলে সচিবালয়ে ককটেল ফুটিয়েছে বা ফোটাতে সহযোগিতা করেছে; আরেকটিতে অভিযোগ, তাঁর এবং আরও ক’জনের প্ররোচনায় ২৯ এপ্রিল একটি বাস পোড়ানো হয়েছে। মামলার চার্জশিট পড়ছিলাম। নিজের অজান্তেই হেসে উঠলাম। আমাকে হাসতে দেখে আমার এক স্টুডেন্ট প্রশ্ন করল, কেন হাসছি। ওকে পুরো ঘটনাটা খুলে বললাম। ও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। তোমার বাবাকে আসামি বানিয়েছে? এই মামলায়? ওর বিস্ময় দেখে বললাম, বাংলাদেশের ৯৯ ভাগ মানুষ তোমার মতোই বিস্মিত! ওকে বললাম—জানো, এই সরকার দুই- তৃতীয়াংশ ভোট পেয়ে সরকার গঠন করেছে, এরা দিনবদলের কথা বলেছে! ওর বিস্ময় আরও বাড়ল। ‘বল কী, এটা নির্বাচিত সরকার! আমি তো ভেবেছি, এটা স্বৈরাচারী সামরিক সরকার।’ খারাপ লাগছিল। বললাম, ‘চিন্তা করো না, ঠিক হয়ে যাবে, সরকার একটু টালমাটাল এখন, ঠিক হয়ে যাবে।’
আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ঘটনাটা আসার পরে অনেকেই আমার কাছে জানতে চাইল পুরো ব্যাপারটা। খুব চেষ্টা করলাম দেশের ‘ভাবমূর্তি’ রক্ষা করে বুঝিয়ে বলার। সবাইকে আশ্বাস দিলাম, আমাদের বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থা আছে। নিম্নআদালত আব্বুদের জামিন নামঞ্জুর করে তাদের কারাগারে পাঠিয়েছে। রায় ঘোষণার পরপরই আব্বুকে ফোন দিলাম। ভীষণ পজিটিভ, হাসছিলেন আমার দুশ্চিন্তা দেখে। হঠাত্ গলাটা বোধহয় আবেগে কিছুটা বুজে এলো। বললেন —‘মাগো, তুমি সাহস হারিয়ো না, আমরা একসঙ্গে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করব, করতেই হবে। যা-ই হোক, তুমি সাহস হারিয়ো না মা।’ আমি আর কথা বলতে পারলাম না। তাঁকে বললাম না, আমি আর স্বপ্ন দেখি না বাংলাদেশ নিয়ে, আমি আর আশা করি না। আমার কেন জানি আজকাল শুধু মনে হয়, ওরা ভিন্নমতাবলম্বী, সাহসী, সত্যবাদী, দেশপ্রেমিক কোনো বাংলাদেশী নাগরিককে মুক্ত থাকতে দেবে না। তুমি যদি স্বাধীনভাবে কথা বলতে চাও, চুপ করে থাকো। এর কিছুই তাঁকে বলা হোল না। শুধু বললাম, ‘তুমি ভালো থেকো আব্বু।’
আমার প্রিয় শিক্ষক প্রফেসর আনোয়ার হোসেনের লেখা আজকাল প্রায়ই পড়ি। সব লেখাতেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রামের কথা, তাঁর ভাইয়ের আত্মদানের কথা, সোনার বাংলা নিয়ে তাঁর পরিবারের স্বপ্নের কথা। আমারও মনে পড়ে ১/১১-এর পরে তাঁর সাহসী ভূমিকার কথা, আরেকটু আগেকার কথাও মনে পড়ে, শামসুন নাহার হলে পুলিশি অভিযানের বিরুদ্ধে তাঁর সাহসী ভূমিকার কথা। আমরা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। স্যারকে দেখতে গিয়েছিলাম তাঁর বাসায়, তাঁর আগেও স্যারের বাসায় গেছি রাতের খাবার খেতে, ক’জন বন্ধুসহ। কিছুদিন আগে মেইলে পেলাম তাঁর চিঠি, ১/১১- এর পরে কোর্টে দেয়া তাঁর জবানবন্দিসহ, তাঁকে ভোট দেয়ার আবেদন করে। এই স্যার আজ আর প্রতিবাদ করছেন না, গর্জে উঠছেন না, মিছিলে যাচ্ছেন না। উনি দেখছেন, সেই একই পুলিশি রিমান্ডে রাজনৈতিক নেত্রীকে চার পেয়ে পশুর মতো অত্যাচার করা হচ্ছে, মেয়েটি দাঁড়াতে পারছে না, সেই একই রিমান্ডে মানুষের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া হচ্ছে, সেই একই বাহিনী রাতের অন্ধকারে তুলে নিয়ে যাচ্ছে কারও বাবাকে, কারও স্বামীকে, কারও সস্তানকে, ক’দিন পরে বুড়িগঙ্গায় ভেসে উঠছে মানুষের হাত, পা। স্যার কিন্তু কিছুই বলছেন না। স্যার একটি রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাস করেন জানি। খুব স্বাভাবিক। প্রতিটি মানুষ রাজনৈতিক। কিন্তু যে কোনো অন্যায় তো অন্যায়ই, যে কোনো অবিচার তো অবিচারই, যে কোনো অত্যাচার তো অত্যাচারই। এসবের তো অন্য কোনো নাম নেই, অন্য কোনো সংজ্ঞা নেই। তবে? তাঁর এই নীরবতার কারণ কী? স্যারের একটি লেখা পড়লাম, কালের কণ্ঠে। তিনি লিখেছেন তাঁর প্রিয় শিক্ষককে নিয়ে। সেই লেখাতেও তিনি কয়েকবার উল্লেখ করলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর অতীত সংগ্রামের কথা। প্রশ্ন করি তাঁকে, আপনার ভাই যে আদর্শের জন্য জীবন দিয়েছেন, তার কতটুকু এই ‘সোনার বাংলা’য় বাস্তবায়ন হয়েছে? প্রশ্ন করি তাঁকে, বর্তমানকে তিনি কীভাবে দেখছেন এবং বর্তমানে তিনি কী করছেন? সংগ্রাম কি চলমান প্রক্রিয়া নয়? আমি স্যারের কথা উল্লেখ করলাম, কারণ আমি মনে করি বাংলাদেশের বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবীকে তিনি প্রতিনিধিত্ব করেন। আমাদের আঁতেলরা এক একটি দলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে গিয়ে কেমন জানি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হয়ে যান। একটি মার্কা, একটি রঙ তাঁদের অন্ধ করে দেয়। চোখের সামনে সমাজটা নষ্ট হয়ে যায়, চোখের সামনে মানুষগুলো কুঁকড়ে যায়, চোখের সামনে দেশটা বধ্যভূমিতে পরিণত হয়, এদের কিচ্ছু যায় আসে না। একটু আগেই খবর পেলাম, আনোয়ার স্যার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মনোনীত হয়েছেন, স্যারের সাম্প্রতিক নীরবতার কারণটা এখন বোধগম্য হলো! সোহেল তাজের পদত্যাগের পর একটি ব্যাপার আমার কাছে পুরো পরিষ্কার। আমরা সবাই এক একটি সোহেল তাজ। আমরা খুব সাহস, উদ্যোগ নিয়ে নেমে পড়ি সমাজ বদলাবো বলে। ফেসবুকে এমন ঝড় তুলি, সে ঝড়েই যেন উড়ে যায় সব অনাচার, রাজনীতিবিদদের গালিগালাজ করে অর্গাজমের সমপরিমাণ আনন্দ বোধ করি, অন্যের পিণ্ডি চটকিয়ে দাবি করি—আমিই আলাদা, আমিই শুদ্ধ। তারপর যখন দৈত্যগুলো কামড়ে দেয়, তখন গাল ফুলাই, অবুঝ শিশুর মতো বলি—‘আমি তোমার সঙ্গে আর খেলব না।’ বিশাল একটা চিঠি লিখে পালিয়ে যাই আমেরিকা। ব্যস, নাটকের এখানেই সমাপ্তি।
আমার কিছু উচ্চশিক্ষিত বন্ধু আছে, এরা প্রায়ই বিভিন্ন আড্ডায়, ফেসবুকে রাজনীতিবিদের পিণ্ডি চটকায়। খুব ফ্যাশনের কাজ, নিজের নিরপেক্ষতা প্রমাণের কী সাংঘাতিক চেষ্টা, অনেক হাত তালি। ভাবখানা এমন, ‘হলো তো? দেশ ও সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালন করা শেষ, এবার চলো, শীশা খেতে যাই।’ সুবিধাবাদের চূড়ান্ত! রাজনীতিবিদদের গালি দিয়ে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলানো যায় না, এ সহজ কথাটি আমার উচ্চশিক্ষিত বন্ধুদের মাথায় ঢোকে না, সম্ভবত ইচ্ছাকৃতভাবেই! আমার বাবা একটি কথা আজকাল প্রায়ই বলেন, ‘আমাদের দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিবর্তনে একটি অন্যতম মূল ভূমিকা রেখেছে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত। পুঁজিবাদ আর ভোগবাদের প্রভাবে এই মধ্যবিত্ত আজ নির্লিপ্ত হয়ে গেছে, সুবিধাজনক বলে।’ আর আমার মাথা বলে, এটা খুব ভয়ঙ্কর একটা অবস্থা। কোনো নিয়মতান্ত্রিকভাবে, সভ্যভাবে এই অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়। আজ ব্যক্তি মির্জা আলমগীরের ওপর যে অন্যায় হলো, যে অবিচার হোল—এর ফল ভোগ করতে হবে পুরো জাতিকে। এটা পরিষ্কার। আজ অথবা কাল। নগর পুড়লে দেবালয় এড়ায় না।
লেখক : কলামিস্ট, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন