ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন এসেছে- এই বার্তাই বাংলাদেশকে দিয়েছেন দেশটির সফররত বিদেশ সচিব ড. সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সচিবের সঙ্গে পৃথক বৈঠকে বার্তাটি স্পষ্ট করেন ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশের ওই কূটনীতিক। গতকাল দুপুরে ২৪ ঘণ্টার সফরে ঢাকায় আসার পর পররাষ্ট্র ভবন ও রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে বিভিন্ন বৈঠক ও ভোজে অংশ নেন তিনি। পররাষ্ট্র দপ্তরের গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে জয়শঙ্কর ‘ভাল আলোচনা হয়েছে’ জানিয়ে দুই দেশের মধ্যে আরও বেশি সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন। গত ২৮শে জানুয়ারি নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে ভারতের বিদেশ সচিবের পদে দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিশেষ নির্দেশনা নিয়ে সার্কভুক্ত দেশগুলো সফরের অংশ হিসেবে ভুটানের পর বাংলাদেশ সফর করছেন তিনি
ঢাকায় এটি তার প্রথম এবং গুডউইল সফর। ভারতীয় অতিথি পররাষ্ট্র দপ্তর ছেড়ে যাওয়ার পর বিকালে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক। সেখানে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একেক সরকারের একেক পলিসি থাকে। ভারতের সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেশটির ফরেন পলিসিতে ‘বড় রকমের পরিবর্তন’ এসেছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার শপথ অনুষ্ঠানে প্রতিবেশী নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সার্কসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে যে কোন সমস্যার সমাধান দ্রুত করার ব্যাপারে দিল্লি এখন অনেক বেশি মনোযোগী বলেও মনে করেন তিনি। সচিব বলেন, ভারতের এই সরকারের বিশেষ একটি দিক লক্ষ্য করেছি আমরা। তারা প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করতে চায়, অমীমাংসিত সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করতে চায়। বর্তমান সরকার আঞ্চলিক সম্পর্ক উন্নয়নে ফোকাস দিচ্ছে। তার সঙ্গে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের বৈঠকের বিষয়ে সচিব বলেন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক কিভাবে নতুন উচ্চতায় নেয়া যায়, সে ব্যাপারে আলোচনার জন্যই দেশটির পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। প্রগাঢ় বন্ধুত্ব জোরদার করাই তার সফরের লক্ষ্য। দিল্লির প্রতিনিধিদের সঙ্গে সচিবের আলোচনায় তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে ‘বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা’ জানানো হয়েছে উল্লেখ করে সচিব বলেন, তিস্তার বিষয়টি তারা ইতিবাচকভাবেই নিয়েছে। তারাও এ সমস্যার সমাধান করতে চান। পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে দ্বিপক্ষীয়, উপ-আঞ্চলিক, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক মোটা দাগে ওই তিন ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা কিভাবে আরও বাড়ানো যায় তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানান বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব।
মন্ত্রীর সঙ্গে ‘গঠনমূলক ও ফলপ্রসূ’ আলোচনা হয়েছে: বিকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে ভারতের বিদেশ সচিব সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর বলেন, মন্ত্রীর সঙ্গে গঠনমূলক ও ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। আমরা পারস্পরিক আরও সহযোগিতা চাই। এর আগে সচিবের সঙ্গে বৈঠক শেষেও গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন তিনি। সেখানে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত আকারে বৈঠকের আলোচ্যসূচি নিয়ে কথা বলেন তিনি। জয়শঙ্কর বলেন, সার্ক ও বিমসটেক ও দ্বিপক্ষীয় বিষয়াদি নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। অত্যন্ত ভাল আলোচনা হয়েছে আমাদের। আমি আমার পরবর্তী মিটিংগুলোর দিকে তাকিয়ে আছি। তিস্তা নিয়ে কি আলোচনা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি বলেছি, আমরা সব বিষয়েই কথা বলেছি।
হাসিনাকে মোদির চিঠি: এদিকে খুব শিগগিরই বাংলাদেশ সফরের আগ্রহ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণের জবাব পাঠিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দিল্লির বিদেশ সচিব সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর গতকাল সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এ সংক্রান্ত চিঠি হস্তান্তর করেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব একেএম শামীম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, “ওই চিঠিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে, তিনি আগ্রহের সঙ্গে ঢাকা সফরের জন্য অপেক্ষা করছেন।” নরেন্দ্র মোদির ওই চিঠিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ভারত সফরের আমন্ত্রণও জানানো হয়েছে বলে উল্লেখ করেন প্রেস সচিব। জাতীয় সংসদ ভবনে ওই বৈঠক হয়। সার্ক দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের প্রয়াসের অংশ হিসেবে জয়শঙ্করকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে পাঠিয়েছেন মোদি। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের বিষয়ে বৈঠকে শেখ হাসিনা জানতে চাইলে জয়শঙ্কর ইতিবাচক সাড়া দেন বলে জানান শামীম চৌধুরী। প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরাও তার জন্য অপেক্ষা করছি।’ বৈঠকে বাংলাদেশে ভারতের অর্থায়নপুষ্ট প্রকল্পগুলো নিয়েও আলোচনা হয়। শামীম চৌধুরী বলেন, এলওসি’র আওতায় বিভিন্ন প্রকল্পগুলো ভালভাবে এগুচ্ছে বলেও জয়শঙ্কর তার সরকারের সন্তোষের কথা প্রকাশ করেন। বিদ্যুৎ খাতে বাংলাদেশ ও ভারতের সহযোগিতার বিষয়েও বৈঠকে কথা হয়। ত্রিপুরার পালটানা থেকে আরও বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়ে আগ্রহ দেখান শেখ হাসিনা। জবাবে জয়শঙ্কর ‘অবশ্যই বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আসবে’ বলে জানিয়েছেন। বিদ্যুৎ উৎপাদনে দুই দেশের বেসরকারি খাতকেও কাজে লাগানোর কথাও বলেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব। বৈঠকে ভুটান থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আনার বিষয়েও আলোচনা হয় বলে জানান শামীম চৌধুরী। শিগগিরই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ‘ ট্রেড প্রটোকল’ এবং ‘এগ্রিমেন্ট বিটুইন কোস্টাল শিপিং’ এই দুটি চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার বিষয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সার্কের বাইরেও দ্বিপক্ষীয় প্রচেষ্টার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের কথাও বলেছেন। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী, দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী এবং ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ উপস্থিত ছিলেন।
দেড় ঘণ্টা বিলম্বে এলেন, যাবেন আজ সকালে: সকাল পৌনে ১০টায় ঢাকায় পৌঁছানোর কথা ছিল তার। কিন্তু আবহাওয়ার কারণে দুপুরের অল্প আগে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে বিদেশ সচিবকে বহনকারী ভারতীয় বিমানটি। নির্ধারিত সময়ের প্রায় দেড় ঘণ্টা বিলম্বে শুরু হয় পররাষ্ট্র দপ্তরের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক। সময় কমে যাওয়ায় ওই বৈঠকে ‘সুনির্দিষ্ট কিছু হয়নি’ বলে জানান পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক। তিস্তার পানি বণ্টন এবং স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে ভারতের তরফে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা চায় বাংলাদেশ। স্থল সীমান্ত চুক্তির বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এটি এখন ভারতের লোকসভার অনুমোদনের অপেক্ষায়। স্থল সীমান্ত চুক্তির বিষয়টি শিগগিরই সমাধান হবে বলে আশাবাদী পররাষ্ট্র সচিব। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে ভারত যে জোর দিচ্ছে সেটি জয়শঙ্করের নিয়োগের এক মাসের মধ্যে তার এই সফরে ইঙ্গিত রয়েছে। তিনি বলেন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ‘এতটাই গভীর’ যে ‘আপনি যদি প্রত্যেকটি বিষয় নিয়ে একছত্র লিখেন তাহলে ২৫ পাতার একটি দলিল হয়ে যাবে। “বিস্তারিত আলোচনা আমরা করি মূলত, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়ের বৈঠক (এফওসি) এবং যৌথ পরামর্শ কমিশন (জেসিসি) পর্যায়ের বৈঠকে।” আজকের (গতকালের) আলোচনায় আমরা একটি বিষয়ে উভয় পক্ষই একমত যে সম্পর্ক ‘খুবই ভাল’ এবং সামপ্রতিক বছরগুলোতে ‘এটা নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।’ এটা ভবিষ্যতে আরও জোরদার হতে থাকবে। আগামী ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসে মোদির ভারত সফর নিয়ে দু’দেশের গণমাধ্যমে খবর বেরুলেও শহিদুল হক বলেন, এ বিষয়ে তারা সুনির্দিষ্ট কান আলোচনা করেননি। ‘আমরা দিন তারিখ আলোচনা করিনি। তিনি যথাসময়ে সফর করবেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী আগেই তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এবং তিনি তা গ্রহণও করেছেন।’ তিনি বলেন, উপ-আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে তারা বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে পানি, বিদ্যুৎ, সংযোগ ও ট্রানজিট বিষয়ে আলোচনা করেছেন। সম্মিলিতভাবে সার্কের উদ্যোগ সফল হওয়ায় উপ-আঞ্চলিক পর্যায়ে সহযোগিতার উপর জোর দিচ্ছে ভারত। আনুষ্ঠানিক পর্যায়ে বড় দুটি অংশের বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে এখন আলোচনা চলছে। একদিকে আছে- পানি ও বিদ্যুৎ অন্যদিকে সংযোগ ও ট্রানজিট। এ বছরের দ্বিতীয়ার্ধে চার দেশের কর্মকর্তাদের মধ্যে এ বিষয়ে আগামী বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা উভয়ে আরও সহযোগিতা চাই।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভীর সঙ্গে দেখা করেন জয়শঙ্কর। এর পর তিনি জাতীয় সংসদে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। রাতে ভারতীয় হাই কমিশনের ডিনারে অংশ নেন। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে প্রথম পর্বের সফরে আজ সকালে পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়বেন তিনি। সেখান থেকে বুধবার যাবেন আফগানিস্তান সফরে।
মানব জমিনের সৌজন্যে
মানব জমিনের সৌজন্যে
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন