বাসা থেকে ধরে নিয়ে অস্বীকার করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। পরে এসব মানুষের লাশ পাওয়া যাচ্ছে। পুলিশ এসব ঘটনাকে চালিয়ে দিচ্ছে বন্দুকযুদ্ধ বলে। এমনই ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আনিসুর রহমান তালুকদার খোকনের ক্ষেত্রে। গ্রেফতারের পর তাকে আদালতে উপস্থাপন করা হয়নি। এই ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে তার পরিবারের সদস্যরা। রংপুরে পুলিশের গুলীতে শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের ইউনিয়ন সভাপতি ও সাবেক উপজেলা ছাত্রশিবির সেক্রেটারি নাজমুল হুদা লাভলু (৩০) নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের নির্যাতনে মারাত্মক আহত আক্কেলপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান রাশেদুল আলম সবুজ। তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পরে পুলিশ তাকে সাজানো মামলায় গ্রেফতার দেখিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুলিশ ও র্যাবের পাশাপাশি গুম-খুন এবং নির্যাতনে অংশ নিচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং দলটির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এক্ষেত্রে বিরোধী মতের লোকজনের সঙ্গে ভয়াবহ অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে। কাউকে গুলী করে হত্যা করে বন্দুক যুদ্ধের নাটক সাজাচ্ছে। আবার কাউকে কাউকে ধরে নিয়ে অস্বীকার করে পরিবারকে লাশ উপহার দিচ্ছে। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে অমানুষিক নির্যাতন করে পুলিশের কাছে সমর্পণ করছে। আগে কেবল আইনশৃঙ্খলাবাহিনী করলেও সাম্প্রতিক সময়ে গুম খুন এবং অমানবিক নির্যাতনে অংশ নিচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং দলটির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এসব করে যেন তারা বিরোধী মতের মানুষের রক্ত নিয়ে হলি খেলায় মেতে উঠেছে। এসব ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন নির্যাতনের শিকার পরিবার এবং দেশের সাধারণ মানুষ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরা চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন হলেও আইন কারো কাছ থেকেই ন্যূনতম সহায়তাটুকু পাচ্ছে না। উল্টো তাদের বিরুদ্ধে দেয়া হচ্ছে ভয়াবহতম অপবাদ। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন সকল জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে চলে গেছে। ভাবখানা এমন যে তাদের আর কোনদিন জবাব দিতে হবে না। তার সব সময় ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবেন। আইন আদালত ভবিষ্যতে তাদের টিকিটিও ধরতে পারবে না। চিরদিন ক্ষমতায় থেকে যাবেন তারা। গতকাল সোমবার এরকম কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। তাদের নির্যাতন থেকে রেহাই পাচ্ছে না জনপ্রতিনিধিরাও।
গতকাল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আনিসুর রহমান তালুকদার খোকনকে গ্রেফতারের পর আদালতে উপস্থাপন না করায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে তার পরিবারের সদস্যরা।
গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে আনিসুর রহমান তালুকদার খোকনের পরিবার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের আশংকা খোকনকে গ্রেফতারের পর অস্বীকার করায় যে কোন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আমরা মনে করি, দেশে যেভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদেরকে গ্রেফতারের পর অস্বীকারের এবং পরবর্তীতে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ মিথ্যা গল্প ফেঁদে হত্যা করার যে রেওয়াজ চালু হয়েছে তাতে এখন রাষ্ট্রেও কোন নাগরিকেরই জানমালের নিরাপত্তা নেই।
আমাদের বক্তব্য-ছাত্রনেতা আনিসুর রহমান তালুকদার খোকন-এর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকলে তাকে আদালতে উপস্থাপন করা হোক। অন্যথায় আনিসুর রহমান তালুকদার খোকনের কোনো ক্ষতি হলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এবং সরকারকে সম্পূর্ণরূপে এর দায়-দায়িত্ব বহন করতে হবে। আমরা অবিলম্বে আনিসুর রহমান তালুকদার খোকনের অবস্থান তার পরিবারের নিকট ফিরিয়ে দেয়া অথবা তাকে আদালতে উপস্থাপনের জোর দাবি জানাচ্ছি।
এদিকে খোকনকে গত শুক্রবার রাজধানীর শুক্রাবাদ এলাকা থেকে গোয়েন্দা পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতারের পর আইনশৃংখলা বাহিনী তা স্বীকার না করায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী। তিনি অবিলম্বে তাকে আদালতে উপস্থাপনের দাবি জানান। রোববার রাতে এক বিবৃতিতে আলতাফ হোসেন চৌধুরী এ কথা বলেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আনিসুর রহমান তালুকদার খোকনকে আটক এবং পরে তা অস্বীকার করায় আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
আমাদের রংপুর অফিস জানিয়েছে, জেলার মিঠাপুকুরের বলদিপুকুরে পুলিশের গুলীতে শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের ইউনিয়ন সভাপতি ও সাবেক উপজেলা ছাত্রশিবির সেক্রেটারি নাজমুল হুদা লাভলু (৩০) নিহত হয়েছেন। নিহতের পরিবারের দাবি তাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে পুলিশ গুলী করে হত্যা করেছে। এ ঘটনার বিচার দাবি করেছে জামায়াত ও শিবির নেতৃবৃন্দ।
নিহত লাবলু শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের মিঠাপুকুর উপজেলার লতিফপুর ইউনিয়নের সভাপতি ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক উপজেলা সেক্রেটারি। তিনি উপজেলার লতিফপুর ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামের নুরুন্নবী শাহ-এর পুত্র।
নিহতের বড় দুলাভাই মাসুদ জানান, ‘রোববার সন্ধ্যা ৭টায় পীরগঞ্জ উপজেলার শানেরহাটের কালানুর শাহপুর গ্রামে আমার বাড়ি থেকে সাদা পোশাকের আইনশৃংখলা বাহিনী আমার ভাই নাজমুল হুদা লাবলুকে অস্ত্রের মুখে ধরে নিয়ে যায়। পরে রাত সাড়ে ৩টায় মিঠাপুকুরের বলদিপুকুরে নিয়ে গিয়ে তাকে পুলিশ গুলী করে হত্যা করে। পরে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার লাশ রাখে। তারা জানান, তার ডান চোখে গুলী করে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় নিহতের পিতা নুরুন্নবী শাহ জানিয়েছেন, পুলিশ আমার ছেলেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজিয়েছে। এ ঘটনায় দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তিনি।
অন্যদিকে পুলিশ জানিয়েছে, ‘রোববার রাত সাড়ে তিনটার দিকে রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের বলদীপুকুর এলাকায় একদল দুর্বৃত্ত গাছ কেটে সড়ক অবরোধ করছিল। এ সময় টহল পুলিশ তাদের বাধা দিলে দুর্বৃত্তরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল ও পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করে। পুলিশ আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলী ছুঁড়লে সংঘর্ষ বাঁধে। এক পর্যায়ে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। পরে পাশের একটি পুকুর থেকে শাহ নাজমুল হুদা লাবলুকে গুলীবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত্যু ঘোষণা করে।’’ তিনি জানান, “এসময় দুর্বৃত্তদের ছোড়া ককটেল ও পেট্রোল বোমায় একজন এসআই আহত হন। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে গাছ কাটার অস্ত্র, ৪টি পেট্রোল বোমা, বিস্ফোরিত ককটেলের অংশবিশেষ ও দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। লাবলু মিঠাপুকুরে পেট্রোল বোমা হামলার এক নম্বর আসামী বলেও জানায় পুলিশ।
এ ঘটনায় জামায়াত নিন্দা জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে জামায়াত নেতৃবৃন্দ বলেন, নাজমুল হুদা লাবলুকে গত রোববার রাত ৮টার দিকে পীরগঞ্জ উপজেলার বিশমাইল নামক স্থানে তার বোনের বাড়ি থেকে সাদা পোশাকধারী আইন শৃংখলা বাহিনী অন্যায়ভাবে গ্রেফতারের পর রাত ৩টার দিকে পুলিশের সদস্যরা তাকে ঠাণ্ডায় মাথায় গুলী করে হত্যা করে। পরে লাশ মিঠাপুকুর বলদিপুকুরে ফেলে রেখে ক্রসফায়ারের নাটক সাজায়। আইনশৃংখলা বাহিনীর এহেন ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন রংপুর জেলা জামায়াতের আমীর মাওলানা এ টি এম আজম খান, নায়েবে আমীর অধ্যক্ষ আব্দুল গণি ও জেলা সেক্রেটারি মুহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ সালাফী।
এক যুক্ত বিবৃতিতে তারা বলেন, জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির কোন নাশকতার সাথে অতীতে জড়িত ছিল না বর্তমানও নেই। তাই পুলিশ নাশকতার নাম দিয়ে এহেন বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালিয়ে জনগণের আন্দোলনকে দমিয়ে রাখতে পারবে না। ইতিপূর্বেও আইন শৃংখলা বাহিনী মিঠাপুকুরের সাতজন জামায়াত-শিবিরের নেতা কর্মীকে হত্যা ও উপজেলা নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যানসহ তিনজনকে গুম করেছে, গুমকৃতদের আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি। নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দোষী পুলিশ কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান। সেই সাথে জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থাসহ সকলের প্রতি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের আহ্বান জানান।
জয়পুরহাট সংবাদদাতা জানান, আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন জেলার আক্কেলপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান জামায়াত নেতা রাশেদুল আলম সবুজ। সোমবার দুপুরে নতুনহাট এলাকায় রাস্তা থেকে উঠিয়ে নিয়ে বেদম মারপিট করে আহত করে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। এ সময় তার মোটরসাইকেল, মোবাইল ও টাকা পয়সা ছিনিয়ে নেয় তারা। পুলিশ তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে জয়পুরহাট জেলা আধুনিক হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে তার অবস্থার অবনতি ঘটলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরের পরামর্শ দিলেও ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে তাকে জেল হাজতে পাঠানো হয়।
প্রতক্ষদর্শী ও আহত রাশেদুল আলম জানান- আক্কেলপুরে একটি জানাযা শেষে জয়পুরহাট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আইন শৃংখলা কমিটির সভায় যোগদানের উদ্দেশ্যে মোটরসাইকেলযোগে জয়পুরহাটের পথে রওনা দেন। তিনি জয়পুরহাট-আক্কেলপুর সড়কের পাকারমাথা নামক স্থানে পৌছলে ওঁতপেতে থাকা আওয়ামী সন্ত্রাসীরা তার পথরোধ করে তাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। জয়পুরহাট পৌরসভার নতুনহাট এলাকায় নিয়ে তাকে লোহার রড, লাঠি, হকিস্টিক ও ইট দিয়ে বেদম মারপিট করে জখম করে। মারাত্মকভাবে আহতাবস্থায় তাকে উদ্ধার করে পুলিশ তাকে জয়পুরহাট জেলা আধুনিক হাসাপাতালে ভর্তি করে। সেখানে তার অবস্থার অবনতি ঘটলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য স্থানান্তরের (রেফার্ড) পরামর্শ দিলেও স্থানান্তর না করে তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে জেল হাজতে প্রেরণ করে। কোর্ট তাকে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছে বলে আক্কেপুলপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকতা জানিয়েছেন। পরে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বগুড়ায় পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।
আদালতে দাখিলকৃত পুলিশ রিপোর্টে জানা গেছে- হরতালের সমর্থনে মিছিলকালে জনগণ রাশেদুল আলম সবুজকে ধরে মারপিট করে পুলিশে সোপর্দ করেছে। জয়পুরহাট সদর থানার ওসি (তদন্ত) সিরাজুল ইসলাম জানান- জনগণ রাশেদুল আলম সবুজকে গণধোলাই দিয়েছে। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছলে লোকজন সরে পড়ে। পুলিশ তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে।
নির্বাচিত নিরপরাধ জন প্রতিনিধি আক্কেলপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান এসএম রাশেদুল আলমের উপর বর্বরোচিত হামলার ঘটনায় জামায়াতে ইসলামী জয়পুরহাট জেলা শাখার আমীর ডা. ফজলুর রহমান সাঈদ ও সেক্রেটারি মো. নজরুল ইসলাম তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। অবিলম্বে দোষীদের আইনের আওতায় আনার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান।
tazakhobor.org/bangla এর সৌজন্যে
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন